ধ্রুব নীল : স্মৃতিবিজড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রকেট উড্ডয়ন ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়াতেই নস্টালজিক হয়ে গেলেন বিজ্ঞানী বজলু। ক্যাম্পাসে কত স্মৃতি! তাদের সময় এক হাজার তেপ্পান্ন টাকায় চা সিঙ্গাড়া পাওয়া যেত। এখনও সেই একই দাম। সিঙ্গাড়ার সাইজ ছোট হলেও সঙ্গে জিলুবিনিয়ামের সন্দেশ যোগ হয়েছে। চিনির চেয়ে বহুগুণ বেশি মিষ্টি জিলুবিনিয়াম ডায়াবেটিস রোগীরা অনায়াসে খেতে পারেন।
বিজ্ঞানী বজলুর ডাক পড়েছে বিশেষ মহল থেকে। মানে বিশেষ রাষ্ট্রীয় মিশনে যেতে হবে। মিশনে যাওয়ার আগে খানিকটা ঘুরে বেড়ান বজলু।

তবে আজ ঘোরাঘুরির মুড নেই। আন্তঃগ্যালাক্টি দুর্নীতির সূচকে পৃথিবীর অবস্থান ১৩তম। দুর্নীতি নিয়ে কারো বিশেষ মাথাব্যথা নেই। ১৩ সংখ্যাটা নিয়েই যত আপত্তি। আর্থ কাউন্সিলের সভায় প্রতিনিধিদের ঘোর আপত্তি- বারো কিংবা বিশ তিরিশ হলেও কথা ছিল বাপু, গুনে গুনে ১৩-ই হতে হবে! ছে! ছে! কী অলক্ষুণে সূচকরে বাবা। নিকুচি করি এসব গ্যালাক্টিক রিপোর্টের।
সকালেই রেডিও বিভাগের প্রধান উহু মিয়ার জরুরি টেলিগ্রাম পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের কেনিবির (কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বিভাগ) ইনবক্সে। ওই টেলিগ্রামের সারকথা কী তা বিজ্ঞানী বজলু জানেন না। শুধু জানেন, দূরের একটা গ্যালাক্সিতে অনেকগুলো গ্রহ ধরা পড়েছে। গ্রহগুলোতে বুদ্ধিমান প্রাণীর বাস আছে। এমন গ্রহ অহরহই পাওয়া যায়। তবে সদ্য আবিষ্কার হওয়া এই গ্যালাক্সি নিয়ে একটু রাখঢাক রাখা হচ্ছে। এটাই রহস্য।
‘হ্যালো বজলু সাহেব। আপনার হাই জাম্পের রকেটটা রেডি তো?’
ফোন করলেন কেনিবি প্রধান শি। প্রাগৈতিহাসিক একটা বই থেকে নিজের নামটা রেখেছেন তিনি। তার নেমপ্লেটের পাশে এক লাইনের ছোট্ট স্লোগানও আছে- ‘শি, যাকে মানতেই হবে।’ কেনিবি প্রধানকে অবশ্য এমনিতেই সবাই মেনে চলে। কারণ বেজায় বুদ্ধি তার। বিনয়ের সঙ্গেই বললেন বিজ্ঞানী বজলু, ‘আজ্ঞে ওটা হাই জাম্প নয়, হাইপার জাম্প। সে যাকগে। মিশন বৃত্তান্ত পাঠিয়ে দিন। স্পেসশিপ আছে টঙ্গি গ্যারেজে। যেতে ঘণ্টা তিনেক লাগবে।’
এই একটা বিষয় বজলুর মাথায় কিছুতেই ঢোকে না। ছেলেপেলেরা এখন আইফোন ৩৯৮ মডেল ব্যবহার করে, স্থান-কালের চাদরটাকে বাঁকিয়ে রকেটে করে গ্যালাক্সি পার হতে লাগে কয়েক মুহূর্ত। কিন্তু শাহবাগ থেকে টঙ্গি যেতে লাগে তিন ঘণ্টা!
বিকেলের দিকে গ্যারেজে পৌঁছেই দেখেন তার আগে আরেকজন হাজির। চেহারা দেখেই বুঝে গেলেন রোবটটা তার ভদ্রবেশী পাহারাদার। বিশেষ কোনো বাহিনির অতিচালাক রোবট।
নেমপ্লেটে নাম লেখা ডাবল এক্সেল নিমাইচন্দ্র। রোবটদের পদবীগুলো অদ্ভুত। অতিচালাক বলেই নিজেকে মানুষ প্রমাণ করার কোনো চেষ্টা দেখা গেল না নিমাইচন্দ্রের মধ্যে। রোবটিক কণ্ঠেই অভিভাদন জানাল বিজ্ঞানী বজলুকে। হুঁ হাঁ জবাব দিয়ে স্পেসশিপে চেপে বসলেন।
কক্ষপথ অতিক্রম করতেই আড়মোড়া ভাঙলেন বজলু।
‘নিমাই তোমার চা-বিড়ির অভ্যাস আছে?’
‘স্যার, কেনিবির মিশনে আমরা। বিরতি নেওয়া ঠিক হচ্ছে?’
বজলু কিছু বললেন না। চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলেন। নিমাইচন্দ্র কঠিন দৃষ্টি হেনে যাবতীয় স্ক্যান করে নিল। তারপর চুমুক দিল সাবধানে।
‘গন্তব্যটা লোড দিয়া দাও। আর কী করতে হইবো কও।’
‘আপনার আবিষ্কার করা অর্গানিক স্ক্যানারে হাবুলু নক্ষত্রপুঞ্জের কয়েকটা গ্রহের প্রাণীদের…।’
‘বুঝছি বুঝছি। অতি সহজ কাম। মগজ পঠন যন্ত্র দিয়া কার মাথায় কী আছে সেটা বাইর করতে হইবো, তাইতো? তা আমারে পাঠানোর কী দরকার। তুমিই তো পারতা।’
‘এটা আপনার রিপোর্ট হিসেবে প্রকাশ পাবে স্যার। আমি নিতান্তই কামলা রোবট। আমার রিপোর্ট কেউ বিশ্বাস করবে না।’
দমে গেলেন বজলু। নিমাইচন্দ্রের মতো তিনিও হতাশ। কারণ তাকে গুটির মতো ব্যবহার করছে কেনিবি। তিনিও যেন একটা রোবট। কিছু করার নেই। একচুল উনিশ-বিশ হলেই কুচিন্তা মামলায় জেলে ভরে দেওয়া হবে।
হাইপারজাম্প মানে কয়েক সেকেন্ডে কয়েক কোটি আলোকবর্ষ পার। দরজার খুলে বেঢপ সাইজের স্পেসস্যুট করে খানিকক্ষণ শূন্যে ভাসলেন বজলু। নিমাইচন্দ্র রোবট হওয়ায় তার স্পেসস্যুটের দরকার হলো না। তবে ফরমাল স্যুট টাই পরে মহাকাশে কেউ ভাসছে, এটাও দৃষ্টিকটূ ঠেকলো বিজ্ঞানী বজলুর কাছে।
‘কেউ দেখলে তোমারে ভূত মনে করতে পারে। হেলমেট পইরা লও।’
‘গ্রহ তো মনে হচ্ছে হাজার হাজার স্যার। সবকটা থেকেই সিগনাল আসছে। স্যাটেলাইটও আছে দেখছি।’
‘হ, পুরাই বস্তি। যাও স্ক্যানার নিয়া আসো।’
উড়ে উড়ে অনেকগুলো গ্রহ স্ক্যান করলেন বজলু। নিমাইচন্দ্রের কথামতো সবার আগে দুর্নীতি পরিমাপের সেটিংস সেট করে নিলেন বজলু। একযোগে গ্রহগুলোর যত দুর্নীতি আছে সব রেকর্ড হতে শুরু করলো।
ধীরে ধীরে কপাল কুঁচকে যেতে লাগল বিজ্ঞানী বজলুর। গ্রহগুলোর দুর্নীতির আগামাথা বুঝতে পারছেন না তিনি। রুজুস্যু নামের একটা গ্রহে উঠতে বসতে এমনকি টয়লেট করতেও ঘুষ দিতে হচ্ছে সবাইকে। সেখানে বাসাবাড়িতে টয়লেট নির্মাণ অবৈধ ঘোষণা করেছে সরকার। অবশ্য ওটা ট্যাক্স না ঘুষ, তা ধরতে পারছে না বিজ্ঞানী বজলুর স্ক্যানার।
পিলুশু গ্রহের অবস্থা আরো খারাপ। সেখানে সদ্য স্কুলে ভর্তি হওয়া কোমলমতি শিশুদের শেখানো হচ্ছে কোন অবস্থায় কার কাছ থেকে কত ঘুষ নিতে হবে। কী করে মহাকাশের হোভারক্রাফট চালিয়ে আসা পর্যটকদের ভুয়া মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করে নিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
উকালক্সি গ্রহে খাবার দাবারের অভাব নেই। তবে এখানকার প্রাণীগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা সব ধরনের অভিযোগ করতেই ব্যস্ত। কেউ কারোর দিকে আড়চোখে তাকালেও দিয়ে দিচ্ছে হত্যার হুমকির মামলা।
সাবরুজুস্টু নামের খটমটে গ্রহটা স্ক্যান করতে গিয়েতো নিমাই পর্যন্ত হেসে উঠল। ‘স্যার দেখেন! কেমন ছেলেমানুষের মতো ঠেলাঠেলি করছে সবাই।’
ঘটনা সত্য। গ্রহটায় কিলবিল করছে প্রাণীরা। সবাই সবাইকে ঠেলছে আর বলছে, ‘এই সর, এটা আমার জায়গা।’ আরেকজন এসে আবার তাকে সরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে ধাক্কাধাক্কি চক্র চলছেই।
অন্যদিকে শিককু গ্রহে চলছে অদ্ভুত এক মেলা। বিভিন্ন বিষয়ের সার্টিফিকেট ও আগামী দশ বছরের সকল ধরনের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বেচাকেনা হচ্ছে প্রকাশ্যে। ‘নিমাইরে, এ তো দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য.. না না.. স্বর্গগ্যালাক্সি। আমাদের পৃথিবী কোন ছার!’
‘স্যার, আমার মনে হয় আমাদের মিশন সাকসেসফুল। চলুন ফিরে যাই।’
বিজ্ঞানী বজলু খানিকটা বিমর্ষ হলেও খুশিতে নিমাইচন্দ্রের চোখের নিচের দুটো অতিরিক্ত বাতি জ্বলছে নিভছে।
পৃথিবীতে ফিরে আসার পর রাতারাতি বিজ্ঞানী বজলু আন্তর্জাতিক হিরো বনে গেলেন। কারণ তার রিপোর্ট প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে দুর্নীতির সূচকে পৃথিবীর অবস্থান অনেক পেছনে চলে গেছে।
হাবুলু গ্যালাক্সির গ্রহগুলোর তুলনায় দুর্নীতিতে পৃথিবী নিতান্তই শিশু। কেনিবিসহ আরো অনেকে খুশি হলেও বিজ্ঞানী বজলুর মনের খচখচানিটা রয়েই গেল।
যোগাযোগ: dhrubonil@yahoo.com