মোখলেছুর রহমান : আকাশের রং হলদেটে হয়ে উঠছে। এখনই সূর্য উঠবে। দূর দিগন্তময় বিস্তৃত ফসলের মাঠ। মৃদু বাতাস বয়ে চলেছে, যা মনের মধ্যে প্রশান্তির এক উন্মাদনা সৃষ্টি করে তুলছে। কৃষকেরা মাঠে আসছে কাজের জন্য। কিন্তু তাদের মুখগুলো আর হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত নেই। তারা যেনো তাদের সোনালী ফসলকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে আর ভালোবাসেন না। তাদের সমস্ত চিন্তা ধারা যেনো হঠাৎ বিচিত্র গোলক ধাঁধায় ঢুকেছে। তারা এই গোলক ধাঁধা থেকে মুক্তি চাই।

নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষকের ইচ্ছা গুলি আজ উদ্দেশ্যবিহীন, লক্ষ্য অকেজো এবং অর্থহীন হয়ে গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব আমাদের মতো দেশের সাধারন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারকে অসহায়ত্ব বরণ করে নিতে বাধ্য করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কৃষি নির্ভর পরিবারের ভয়াবহ বাস্তবতার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। তাদের উপার্জন দরকার, তাদেরকে নতুন জীবিকার সন্ধান করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা দেখা দিয়েছে, সেটা উপলব্ধি করতে পারছে কৃষক এবং উপকূলীয়বাসীরা। এই মৌসুমে সময় মতো বৃষ্টি না হওয়ায় ধান রোপন করতে দেরী হয়েছে। যার ফলে ফসল পেতে তাদেরকে আরও বেশি অপেক্ষা করতে হবে। ততদিন তাদের গচ্ছিত খাওয়ার ধান আর থাকবে না। তাদের অবশেষে চাল কিনতে হবে।
গ্রামের কৃষকদের ধান বিক্রির দাম ও চাল কেনার দামের সাথে আকাশ আর ভূমির মতো অসামঞ্জস্য। তাদের সংসার চালানো এখন দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। তাদের উপার্জন করতে হবে। তারা আজ হতাশায় আচ্ছন্ন। তেমনই একজন হলেন করিম মোল্লা। জীবনযুদ্ধে হার মানতে চাওয়ার মত ব্যক্তিত্ব তার না। তার পরিবারকে তিনি আগলে রাখার জন্য সাহসী মুখোভঙ্গি নিয়ে নতুন আশা সঞ্চার করছেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, পশ্চিমে ভারতের বর্ডার, দক্ষিণে সুন্দরবন। পরিবারসহ এই উপকূলে বসাবাস করিম মোল্লার। তার বিশেষ কোনো পরিচয় নেই। হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্বের ভালো মনের মানুষ। অবশ্য তার একটা পরিচয় আছে, তিনি একজন বাবা। তার তিনটা কন্যা সন্তান আছে। তার বড় মেয়েটার বিয়ে দিয়েছে কিন্তু সে সুখে নেয়।
দিনমজুর বাবা তার শ্বশুরবাড়ির দাবি পূরণ করতে পারেন না। গ্রামাঞ্চল এখনো সেই যৌতুকপ্রথার ভয়াবহ গ্রাস থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। নির্যাতিত হতে হয় যৌতুকের জন্য। মেয়ের বাবা গরিব হলে ঘটক যায় না তার বাড়িতে। এখন সে বেকার দেয়ার মতো কিছু নেই তার কাছে। ফসল পেতে অনেক দেরি, উপার্জনের কোনো পথও সে খুঁজে পাচ্ছে না। তার দারিদ্রের কথা, তার হতাশার কথা শোনার কেউ ছিলো না। সমসাময়িক দোটানা, সময়ের সাথে পূর্ণতা-অপূর্ণতার হিসাব-নিকাশ, অপ্রত্যাশিত ভবিষ্যত তার মনকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলো। মানুষ আশায় বেঁচে থাকে তেমনি তিনি জীবনের মায়া ভুলে কিছু আশা সঞ্চার করেন।
তিনি সিদ্ধান্ত নেন, সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাবেন। যেখানে স্থলে বাঘ আর নদীতে কুমির। সুন্দরবন এলাকার মানুষদের এটা কোনো ভয়ের কারণ হতে পারে না। এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান মাধ্যম ছিলো সুন্দরবন। এখনো বনের উপর নির্ভর করে সংসার চলে অনেক পরিবারের । ডিঙি নৌকা নিয়ে তারা যায় মাছ ধরার উদ্দেশ্য। অনেক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে ভয়কে জয় করে তারা এক ভাটা নৌকা চালানোর পর তাদের গন্তব্যে পৌঁছান। জীবিকা যেখানে মুখ্য বিষয় ভয়টা তখন অপ্রয়োজনীয়।
গভীর সুন্দরবনের ভিতরে খালে মাছ ধরতে যান তারা। কিন্তু তার জীবনের আকাশ যে কিছু সময়ের মধ্যে কালো মেঘে গ্রাস করেবে তিনি কি তা জানতেন? আশা করি পৃথিবী একদিন শান্ত হবে, নতুন জাগরণ শুরু হবে। খেটে খাওয়া মানুষ সুখে শান্তিতে নিরাপদ জীবিকার মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করবে। পৃথিবীটা এমন হোক, যেখানে কর্মসংস্থানের জন্য, জীবিকার জন্য মৃত্যুর মুখোমুখি হতে না হয়।
তখন সময়টা বিকাল তিনটা কি চারটা হবে। তিনি বুঝতে পারে বিষাক্ত সাপের কামড়ে তার মাথা ঘুরাচ্ছে। এখান থেকে লোকালয়ে পৌঁছাতে না পারলে তার নিশ্চিত মৃত্যু। তার জীবন রক্ষার জন্য তাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তার সঙ্গীরা আপ্রাণ প্রচেষ্টা করতে থাকে। তার প্রাণবন্ত শরীর ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে পড়তে থাকে। তার হাত, পা সে আর ব্যবহার করতে পারছে না শীতল হয়ে যাচ্ছে তার গরম রক্ত। অসহায়ের মতো জীবন দিতে হবে কি তাকে? অপলক দৃষ্টিতে দেখছে চারিদিক। তার সঙ্গীরা লোকালয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে কিন্তু মোবাইলের নেটওয়ার্কের বাইরে তারা।
অবশেষে অনেক চেষ্টার পর সুন্দরবনের উঁচু গাছে উঠে মোবাইলের নেটওয়ার্কের সিগন্যাল পাওয়া গেলো। তারা অবশেষে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। তার সঙ্গীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছে নৌকা দ্রুত চালানোর কিন্তু উজানে তারা এগোতে পারছে না। এখনো সে বেঁচে আছে, তার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। সে অপলক দৃষ্টিতে দেখছে চারিদিক এই সবুজের সমারোহ। আর কিছুক্ষণ পর সে কি আর এই সৌন্দর্য দেখতে পাবে!
আজ অনেক ক্লান্ত তিনি, বাড়ি ফেরার তাড়নাই আচ্ছন্ন তার মন। রাত যখন চারটা তখন তারা কবিরাজের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হন। কিন্তু ততক্ষণে সে একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে, কথা বলার ক্ষমতাটাও হারিয়ে ফেলেছে। তখন কবিরাজের আর কিছুই করার ছিলো না। নিরুপায় হয়ে তার পাশে বসে থাকতে হয়েছে তাঁকে। বার বার তার হৃদস্পন্দন শুনতে চেষ্টা করছেন কবিরাজ, শ্বাস-প্রশ্বাসের উপস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন কান পেতে। কিন্তু কোথাও কোনো শব্দ নেই।
সীমাহীন রাস্তা, অন্তহীন রাত। তাকে নৌকা থেকে নামানোর পর গাড়িতে করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলো। তখন তার মুখটা নীল বর্ণ ধারণ করছে। দ্রুত ডাক্টারকে ডেকে নিয়ে আসা হলো। ডাক্টার পরীক্ষা করে বললেন, আর কিছু করার নেই। সমাপ্তি ঘটে একটা সংগ্রামী জীবনের। তাদের মানতে হলো, সে চলে গেছে। ফিরবে না আর কোনো দিন। পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে তাকে চলে যেতে হলো। প্রিয়জন দেখার আশায় অশান্ত মন নিয়ে তাকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়েছে।
এই পৃথিবীর উন্মাদ মানুষগুলো একদিন শান্ত হবে, কিন্তু তার পরিবারের মন কি কখনো শান্ত হবে? পৃথিবীর স্বার্থপর মানুষগুলো ক্ষমতার জোরে আগ্রাসনবাদের জন্য পৃথিবীকে উন্মাদ করে ফেলছে। আজ এই আকাশের নীচে এক অদ্ভুত আতঙ্ক কাজ করছে, জীবনের আতঙ্ক। সবার হাস্যোজ্জ্বল মুখগুলো বিষাদময় হয়ে উঠেছে। এলাকা জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ভালো থাকুক তার পরিবার। ভালো থাকুক সেই সমস্ত মানুষগুলো, যারা জীবিকার জন্য মৃত্যুর ভয়কে ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। জীবনের টানে লবণ জলে।