Friday, December 5
Shadow

“আত্মার বন্ধন”

রাহেলা আক্তার 

অবনী থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। সামনে ফাইনাল এক্সাম। ভীষণ চিন্তায় ভুগছেন। একমাত্র ভাই এবার এস এস সি এক্সাম দিবে। ছোট বোন ক্লাস এইটে পড়ে। তিন ভাই বোনের মাঝে অবনীই বড়। অবনীর “মা” নীলিমা চৌধুরী আজ দশ বছর ব্রেস্ট ক্যান্সারে ভুগছেন। প্রথম চার বছর চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হলেও বছর খানেক পরে আবার দেখা দেয়। এবার ফারমেন্ট চট্টগ্রাম মেরিন সিটি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তিন মাস পরপর কেমোথেরাপি চলে, থেরাপি দিতে দিতে নীলিমা চৌধুরীর চুল প্রায় উঠে গেছে, পশম খসে পড়তেছে। অবনী রাতদিন হাসপাতালে মায়ের সেবা করে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে মায়ের শারীরিক অবস্থা একটু ভালো দেখা দিলে মাকে নিয়ে হাসপাতালের পাশেই অবনীর আন্টিদের বাসায় বেড়াতে নেন।

অবনীর বাবা আদনান চৌধুরী নিউইয়র্ক থাকেন। স্ত্রী অসুস্থ হবার পর থেকে তিনি তেমন দেশে ফিরেন না। চিকিৎসা বাবদ কিঞ্চিৎ খরচ দেন। অবনীর নানার বাড়ি থেকেই বেশির ভাগ খরচ বহন করে। অবনীর মায়ের অবস্থা ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে, তার চিন্তার শেষ নাই। মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে, তার কিছু হলে মেয়েকে বিয়ে দিবে কে? ছেলে মেয়ের দেখাশুনা করবে কে? অবনীর বাবাও তেমন খোঁজ রাখেনা। নিজে অসুস্থ অন্যদিকে অবনীর বাবার যোগাযোগ কমে যাওয়ার কারণে তেমন ভালো পাত্র আসেনা। এবার  নীলিমা  চৌধুরী  বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারছেন না। শেষ বারের মতো স্বামী কে দেখতে চাচ্ছেন। ডাক্তার বললেন উনি হয়তো আর মাস খানেক আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। সবার কান্নার রোল পড়ে গেল। নীলিমা  চৌধুরীর অঝোরে দু’নয়নের জল গড়িয়ে  পড়ছে, কোনো ভাষা নেই। শুধু মনে মনে ভাবছেন মেয়েটাকে বিয়ে দিতে পারলে, মরেও তার আত্মা শান্তি পাবে। যেমন ছেলেই প্রস্তাব দিক এবার বিয়ে দিয়ে দিবে।

যে কথা, সে কাজ।  মহান রাব্বুল আলামিন তার ইচ্ছা পূরণ করেছেন। মহিলা ওয়ার্ডের সামনেই পুরুষ ওয়ার্ড। তুহিনের বাবা শেখ আহমদ দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী। হাসপাতালে ভর্তি করার পর পরিক্ষা নিরীক্ষায় ধরা পড়লো ব্রেইন টিউমার।  তুহিনের মা জুলেখা বেগম  স্বামীর দেখাশুনা করছেন। চট্টগ্রাম শহরেই তুহিনদের বাড়ি।  তুহিন সকাল বিকাল এসে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দিয়ে যান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছে। আপাতত একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি তে জব করে। অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ছেলে।  এদিকে তুহিনের মা অবনীর দিকে লক্ষ্য করে। মেয়েটি খুব ভালো তার ছেলে তুহিনের সাথে বেশ মানাবে। বিষয়টি তুহিন এবং তার স্বামী কে জানান। তারা সানন্দে রাজি হয়ে যায়। অবনীরাও কোনো অংশে কম না। তুহিনের মা হাসপাতালে অবনীর মেজো আন্টির সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। অবনীর আন্টি তাদের পরিবারের সাথে আলোচনা করে জানাবেন বলে। অবনীর মা তো ভীষণ খুশি। তুহিন কে ও তার খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু সবার মনে একটা প্রশ্ন দোল খেয়ে যাচ্ছে, অবনী রাজি হবে তো, তূহিন কে বিয়ে করতে! বিয়ে মানে সারাটা জীবন একে অপরের পাশে থেকে  সুখে- দুখে কাটিয়ে দেওয়া। দুই পরিবার অবনী এবং তুহিন কে তাদের মতামত ব্যক্ত করতে ছেড়ে দেয়।

তুহিন অবনীকে চট্টগ্রাম একটা পার্কে দেখা করতে বলে। অবনী নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হয়। এক পলকেই একজন আরেকজনের চোখের ভালোবাসার সমুদ্রে হারিয়ে যায়। কেউ কোনো কথা বলছেনা। চোখের ভাষায় বলে দেয়, যেনো ওরা কতো যুগের চেনা। তুহিন কিছু না বলেই অবনীর ডান হাতটা  আলতো করে ধরলো, ওমনিই অবনীর সারা শরীর যেনো শিহরে উঠলো। তুহিন অবনীর হাতটা কাছে এনে  চুম্বন একে দিল। অবনী লজ্জা পেয়ে মাথাটা নিচু করে পেললো।  তুহিন অবনীর চিবুকটা তুলে যুগল চোখে  চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো,,, 

 Will you marry me?

অবনী কিছু না বলেই তুহিনের কাঁধে মাথা ঝুকে দিল। তুহিনের বুঝতে বাকি রইলো না আর, অবনী তাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে পেতে চায়। তুহিন ও অবনীর কাঁধে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। এভাবে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে দু’জনেই একসাথে হাসপাতালে চলে এলো। দু’ পরিবার কে তাদের অভিমত জানানো হয়। তারা শুনে খুব খুশি হলো। 

এক সপ্তাহ পরে বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হয়। একেকটি দিন অবনীর কাছে মনে হয় একযুগ। কতো না বলা কথা জমে আছে, তুহিন কে কাছে পেলে হৃদয় উজাড় করেই সব বলবে। ইচ্ছে করছে তুহিনের হাতে হাতা, চোখে চোখ রেখে এক অজানা স্বপ্ন পুরিতে হারিয়ে যেতে।

ওমনিই তুহিনের কল এলো,,,,,।

— কি করো অবনী?

— মাকে ফলের জুস খাওয়াচ্ছি।

— বিকালে একটু বের হতে পারবা?

— “মা” একা।

— আন্টিকে আসতে বল। বলবা তুহিন দেখা করতে বলেছে।

— আচ্ছা।

অবনী তার আন্টিকে কল দিয়ে জানায়, তার আন্টিও সায় দিল। বিকাল ৫ টায় অবনী আর তুহিন চট্টগ্রাম পার্কে দেখা করে। দু’ জনেই কিছুক্ষণ পার্কের অপার মুগ্ধতা অনুভব করে। 

— অবনী তুমি কি খেতে পছন্দ কর? 

— অবনী, তুহিন কে চিমটি কেটে বলে, আপাতত ঝাল খাব। পরে তোমার ওষ্ঠের  মিষ্টি চুম্বন খাব। 

— তুহিন হাসতে হাসতে তখনই, অবনীর ঠোঁটে চুম্বন একে দিল। 

অতঃপর রেস্টুরেন্টে গিয়ে তারা চিকেন রোল খেলো, ওমনি একটা ফুসকাওয়ালা ফুসকা,,ফুসকা করতে থাকলো।  অবনী ফুসকা খাবো বলে তুহিন কে ফুসকার দোকানে নিয়ে গেল। ফুসকা খেয়ে দু’ জনেই একটা ফুল বাগানের কাছে গিয়ে বসলো। বাগানের সৌন্দর্যের সাথে ওদেরকে ও খুব সুন্দর লাগছে। দু’ জনেই বাগান বিলাসে প্রেমের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। কেউ কাউকে কিছু বলতে পারছেনা। কিছুক্ষণ নিরবতা কাটিয়ে তুহিন অবনীর হাতটা টেনে পকেট থেকে একটা ডায়মন্ড রিং বের করে অবনীর ডান হাতের মধ্যমা আঙুলে পরিয়ে দেন।  অবনী নিতে অমত করলো। তুহিন, অবনীকে পাঁজরে টেনে বলে তুমি আমার কাছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।  তোমার চেয়ে এই ডায়মন্ড রিং কিছুইনা। অবনী আবেগাপ্লুত হয়ে তুহিন কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। তুহিন কপালে চুম্বন একে দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলে দূর পাগলী কাঁদছো কেন? আমি তো আছি। আর মাত্র কয়েকটি দিনই তো। রাত ৮.০০টার দিকে দু’জনেই হাসপাতালে ফিরে যায়। 

নির্ধারিত দিনে চট্টগ্রাম একটা ক্লাবে ছোটখাটো অনুষ্ঠান করেই ওদের বিয়ে হয়ে যায়। অবনীর “মা” ভীষণ খুশি, কিন্তু  মায়ের বেলা পুরিয়ে এল। অবনীর বাবা আর এলোনা। বিয়ের ঠিক চারদিন পর অবনীর মা অবনীর শ্বাশুড়ির হাত ধরে বললেন, আমার ছোট মেয়ের দায়িত্ব আপনার হাতে তুলে দিলাম। আপনি নিজের মেয়ে মনে করে তাকে মানুষ করবেন। এই কথা বলে নীলিমা  চৌধুরী  কাঁদতে লাগলেন আর শেষ বারের মতো বললেন, আমার স্বামীকে দেখার অনেক ইচ্ছা ছিলো,  কিন্তু পূরণ হলোনা। আমার লাশটা হলেও  উনাকে দাফন করতে বলিয়েন। এই কথা বলেই নীলিমা  চৌধুরী  শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। দীর্ঘদিন ধরে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, পুরো হাসপাতালের সবার চোখে জল গড়িয়েছিল। 

অবনীর বাবাকে কল দেওয়া হয়, আর অবনীর মায়ের শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়ে  দেওয়া হয়। আদনান চৌধুরী লাশ হিমাগারে রাখতে বলেন। উনি টিকেট কেটে আসতেছেন বললেন। ১০ দিন পর আদনান  চৌধুরী দেশে ফিরলেন, স্ত্রীর লাশ দাফন করলেন। স্ত্রীর লাশ দাফন করে এক সপ্তাহ না ফুরাতেই অবনীর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলেন। যেনো ঘৃতে তৈল ঢালা।  মায়ের মৃত্যুর শোক পার না করতেই বাপের দ্বিতীয় বিয়ে, ছেলে -মেয়ে  আরো ভেঙে পড়ে। অসহায়ত্বের হাতছানি ঘিরে ফেলল ছোট দুই ছেলে-মেয়ের জীবন। প্রবাদ আছে, মা মরলে বাপ নাকি তালুই। 

তাদের জীবনে ও তাই হলো, কিন্তু মহান রাব্বুল আলামিনের ইশারা বুঝা বড় দায়।  তিনি একটা দরজা বন্ধ হয়ে গেলে হাজার টা দরজা খুলে দেন। অবনীর মা মৃত্যুরকালে অবনীর ছোট দুই ভাই বোনের দায়িত্ব তুলে দেন অবনীর শ্বাশুড়ির হাতে। অবনীর শ্বাশুড়ি ও তা  অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। দু’জন কে সাথে করে নিয়ে যায় অবনীর শ্বাশুড়ি নিজের বাড়িতে। ওরাও ভীষণ খুশি। বোন আর বোনের জামাইকে কাছে পেল। অবনীর স্বামী তুহিন ওদের কে ছোট ভাই-বোনের মতো স্নেহ করেন। অবনীর ছোট ভাইকে চট্টগ্রাম কলেজ আর বোনকে চট্টগ্রাম  নবম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন।

পৃথিবীতে কিছু কিছু সম্পর্ক আছে, যে সম্পর্ক গুলোর নাম হয় না। রক্তের বন্ধন বড় নয় আত্মার বন্ধনই বড়। আর এই বন্ধনের জোরে মানুষ পরিবারে আবদ্ধ থাকে।

রাহেলা আক্তার 

পানিরছড়া,হোয়ানক, মহেশখালী, কক্সবাজার। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *