ধ্রুব নীলের রম্য সায়েন্স ফিকশন
‘কম্পিউটারের গুষ্টি কিলাই।’
কথাটা শব্দ করে বলতে পারলেন না কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সদ্য সাবেক প্রধান সিফরু খন্দকার। মনে মনে গজগজ করলে ক্ষতি নাই। তার মন পড়ার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় কম্পিউটার ওরফে কেক’কে দেওয়া হয়নি। অবশ্য কাউন্সিলের সদ্য সাবেক প্রধানের মন পড়তে পারলেও কেক সেটাকে বিশেষ পাত্তা দিত না। কারণ তার গুষ্টির কেউ নেই। তার পূর্বপুরুষ কেক-৪১৯ সিরিজের কম্পিউটারটাকে আপডেট করেই তাকে বানানো হয়েছে। সুতরাং চাইলেই তার গুষ্টিকে কিলানো সম্ভব নয়।

কিন্তু কেন কেক-এর গুষ্টি কিলাতে চাচ্ছেন এইমাত্র সাবেক হওয়া সিফরু খন্দোকার? কারণটা দ্বিতীয়বার জানাল কেক-৪২০। আরও ভদ্রোচিতভাবে, যেন বোঝাতে চাচ্ছেন কম্পিউটার হলেও সে চায় না সিফরুর মনে আঘাত দিতে। কম্পিউটার হলেও তার মাদারবোর্ড বেশ নরম।
‘জনাব সদ্য সাবেক কাউন্সিল প্রধান সিফরু, আপনার মেয়াদ শেষ হওয়া মাত্র আমি নেটওয়ার্ক সার্চ করে নতুন কাউন্সিল প্রধান খুঁজে পেয়েছি। রসুলপুর গ্রামে তার বাস। নাম ইসমিনি। সবকটা অলিম্পিয়াডে সে ফার্স্ট। বয়সও গতকাল আঠার পেরিয়েছে। আমার হিসাবে বর্তমানে দেশ চালানোর জন্য তার চেয়ে উত্তম আর কেউ নাই। আমি ইতিমধ্যে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। সে কাউন্সিল প্রধান হতেও রাজি।
‘শেষপর্যন্ত একটা পুচকা মাইয়ার হাতে দেশ তুলি দিবা কেক ৪২০? তুমি আসলেই ফোর টুয়ান্টি করতেসো আমার লগে?’
‘আপনি জানেন সিফরু। আমি কোটিকোর প্রসেসর দিয়ে তৈরি। আমার মধ্যে আছে আবেগ-২৩ কোডিং। আমি মিথ্যে বলি না। চাইলে পারি। তবে বলি না। তাতে আমার মাদারবোর্ডে প্যাঁচ লাগে।’
‘হয়েছে থামো। নিজের গুণকীর্তন গাইতে হবে না। তার আগে ইসমিনির লগে আমার বাতচিত আছে, সেটা তো জানো।’
‘কাউন্সিল বিতর্ক হবে আগামীকাল। সব শিডিউল করা আছে।’
কেক ৪২০ হলো অনেকটা সুপ্রাচীন মধ্যবর্তী সরকারের মতো। কম্পিউটার হওয়ার কারণে তার পক্ষপাতিত্ব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি। নির্দিষ্ট মেয়াদের পর দেশের সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোকটার হাতে দেশের দায়ভার তুলে দেয় ও। এর বাইরেও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ থেকে বিস্তর প্রশাসনিক কাজ সামলায়। ‘কোথায় কী ঘটে না ঘটে সব জাইনা যায় শয়তানডা। ওরে বানানিডাই এই দেশের ইতিহাসের মহাভুল! মহাভুল!’। সিফরু ভেবে পাচ্ছেন না কোথাকার কোন ইসমিনি কী করে তার চেয়ে বুদ্ধিমান হলো। তার আমলে দেশে উন্নয়ন হয়েছে হু হু করে। তারপরও ঘাটতি রয়ে গেল কোথায়? প্রশ্ন অনেক। উত্তর মিলবে আগামীকাল।
যথাসময়ে কাউন্সিল বিতর্ক শুরু। প্রতিপক্ষকে দেখে দমে গেলেন সিফরু। গ্রাম আর মেয়েটার নাম শুনে একবার ভেবেছিলেন হাড় জিরজিরে গরিব টাইপ হবে। কিন্তু তা না। ইসমিনি বেশ স্মার্ট। মোটেও রোগাপাতলা নয়। চোখে মাঝারি পাওয়ারের আই-চশমাও আছে। দুনিয়াদারির খবর রাখে। সিফরু খন্দোকার অনেক চেষ্টা করে আই-চশমার ব্যবহার শিখতে পারেননি। পারলে তিনিও নিজেকে আরো বুদ্ধিমান প্রমাণ করতে পারতেন।
‘তা, ইসমিনি মা, তোমাকে অভিনন্দন।’
‘শুধু শপথ নেওয়াটা বাকি। এরপর থেকে আমাকে মাননীয় কাউন্সিল প্রধান বলবেন।’
‘আইচ্ছা ঠিকাছে বাপু! তা তোমার মন্ত্রিসভাটা কেমন হইবো শুনি? তুমি নাকি কী কী সব বদলাইবা।’
‘জ্বি ঠিক শুনেছেন। কাউন্সিলের সব দপ্তর একইভাবে চলে আসছে। এভাবে এক ধরনের উন্নয়ন হয় ঠিকই, এটা এমনিতেই হয়। তবে নতুন কিছু হয় না। নতুন সভ্যতা হয় না। আমি এমন কিছু করবো যাতে অন্য দেশ আমাদের অনুকরণ করে। এর জন্য দরকার বুদ্ধি। তাই আমার প্রথম মন্ত্রণালয় হবে বুদ্ধি মন্ত্রণালয়। দেশের সেরা বিজ্ঞানী আর চিন্তাবিদদের এখানে কঠিন পরীক্ষার পর চাকরি দেওয়া হবে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র করবে কেক-৪২০।’
‘জো হুকুম।’
কেক-৪২০ এর ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল ইসমিনি। কেন্দ্রীয় কম্পিউটারের এরইমধ্যে ইসমিনির এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সেটা দেখে জ্বলুনি আরো বেড়ে গেল সিফরুর।
‘আর কী করবা শুনি?’
‘বই মন্ত্রণালয়, আইডিয়া মন্ত্রণালয়, বিকল্প জ্বালানি মন্ত্রণালয়, সরকারি চাকরি পেতে হলে কমপক্ষে তিনটা অতিরিক্ত গুণ, যেমন বেহালা বাজানো কিংবা মার্শাল আর্ট কিংবা বাঁশ বেতের কাজ জানা বাধ্যতামূলক করা…’
‘বুঝছি বুঝছি.. গাঁজাখুরি সব সায়েন্স ফিকশন পইড়া তোমার মাথায় এসব গজাইছে।’
‘আমি নতুন কিছু করতে চাই। উন্নয়ন-অনুন্নয়ন বুঝি না। মানুষ এমনিতে সরকারি দপ্তরগুলোতে কোনো সেবা নিতে আসে না এখন। বেশিরভাগ মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে। এই মুহূর্তে একটা জরিপ চালিয়ে দেখুন তো, আপনার সংস্কৃতি, শিক্ষা কিংবা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কী কী কাজ করে সেটা প্রতি একশ জন মানুষের মধ্যে ক’জন বলতে পারবে? আমার মন্ত্রণালয়গুলোর কাজ সম্পর্কে লোকে জানবে। আর যে বই পড়ে না, সে তো বইমন্ত্রী হতে পারবে না। আইডিয়ামন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে প্রতিদিন পাঁচটি করে নতুন আইডিয়া দিতে হবে। তা না হলে চাকরি থাকবে না। সুতরাং বুঝতেই পারছেন। এদের ঘুষ খাওয়ার কোনো উপায়ই রাখবো না। আর কেউ যদি ঘুষের বিনিময়ে বুদ্ধি বা আইডিয়া পেতে চায়, তবে মন্দ কী! হি হি হি।’
সিফরু খন্দোকার এমনিতে একটু খিটখিটে টাইপের হলেও আদতে তার মনটা ভাল। বুদ্ধিতেও কম যান না। এমনি এমনি তো আর কেন্দ্রীয় কাউন্সিল প্রধান হননি।
‘তা মামণী, তোমার আইডিয়া ভালো মানলাম। কিন্তু এত বড় একটা পরিবর্তন করাটা এক রাতের কাম না। এক মাসেরও না। এর জন্য তোমার দরকার অভিজ্ঞতা। সবাইকে একসঙ্গে প্রশিক্ষণ দেওয়া..।’
‘ওটার জন্য আপনাকে প্রশিক্ষণমন্ত্রী করেছি আমি। আপনি দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন। আপনার কথায় সবাই ওঠেবসে। আপনি যদি একটা গরুকে বলেন ঘাস খাওয়া ছেড়ে প্রগ্রামিং শুরু করতে, আমার ধারণা সে চেষ্টা করে দেখবে। সুতরাং…। তা ছাড়া মানুষকে প্রশিক্ষিত করা আর অনুপ্রেরণা দেওয়ার মতো মহান কাজ অবসরে গিয়ে আপনি করতেই পারেন। পাশের গ্যালাক্সির আমিকিরি গ্রহের রাষ্ট্রপ্রধান বিরিক্রি উবুমুর কথাই ভাবুন। এক সময়ের এত ক্ষমতাধর লোকটার কী করে সময় কাটছে এখন সে খোঁজ রাখেন?’
‘না মানে ইয়ে..।’
একদিকে পদ হারানো ও অন্যদিকে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কাজ, তারওপর আবার তার সঙ্গে মহান নেতা উবুমুর তুলনা; সব মিলিয়ে সিফরুর ভেতর এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হলো। মনে মনে বললেন, নাহ মাইয়াডা আসলেই বুদ্ধিমান।