Friday, July 4
Shadow

একজন মায়ের গল্প

কবির কাঞ্চন: জীবনের ঘানি টানতে টানতে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষদের অন্যতম বিল্লুরাণী। একমাত্র ছেলে দীলিপ যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তো তখনই তিনি স্বামীকে হারালেন।

বিল্লুরাণীর স্বামী হরিপদ ছিলেন একজন প্রান্তিক জেলে। মহাজনের নৌকায় বছরব্যাপী কর্মচারী ছিলেন। সংসার খরচ মেটানোর জন্য আগে আগে মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিতেন বলে অনেকটা গৃহপালিত কর্মচারীর মতো আচরণ করা হতো তার সাথে। সেবার একটানা আকাশের অবস্থা খারাপ ছিল। তারওপর হরিপদের শরীরের অবস্থাও ভালো ছিল না। সে নৌকায় না গিয়ে বাসায় ফিরে আসে। অসুস্থ শরীরে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে থাকে।
কিছুক্ষণের মধ্যে মহাজনের লোকজন এসে তাকে জোর করে কাজে নিয়ে যায়। যাবার বেলায় ছেলে দীলিপকে তিনি বলে গেলেন,  ” ঠিকমতো লেখাপড়া করিস, বাবা। তোকে অনেক বড় হতে হবে। গরীবের লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুই কাজে আসে না। আমি না থাকলেও লেখাপড়া সারাজীবন তোর পাশে থাকবে। তোকে পথ দেখাবে।”
এরপর বিল্লুরাণীর মুখের দিকে তাকিয়ে দু’ফোঁটা চোখের জল ছেড়ে বললেন,
” আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি কাজ শেষে আবার ফিরব। ঈশ্বরের কৃপায় তোমরা সবাই ভালো থেকে।”
এই কথাটাই ছিল শেষবারের মতো স্বামীর মুখ থেকে শোনা কথা। হরিপদরা নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে সমুদ্রে পাড়ি জমালেও আর ফিরে আসেনি। লোকমুখে শুনেছে, প্রবল ঝড়ের কবলে পড়ে হরিপদদের নৌকা ডুবে যায়। সেই থেকে নৌকায় থাকা কারো সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি। নৌকাডুবির সেই ঘটনার পর মহাজন নিজে এসে তাদের সান্ত্বনামূলক কিছু নগদ টাকা দিয়ে চলে যান। আর কোনোদিন যোগাযোগও করেননি।

সেই থেকে অভাগিনীর ললাটে জুটেছে দিনে গার্মেন্টসে চাকরি আর রাতে সেলাইমেশিনের কাজ করা। তবু দু’চোখে তার অসীম স্বপ্ন। একদিন দীলিপ বড় হবে। অনেক বড়। স্বামীর শেষবারের মতো বলে যাওয়া কথাগুলো এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যাননি।
দীলিপও সেপথে হাঁটছে। নিয়মিত পড়াশোনা করছে। আর ক’দিন পরই সে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে।

হঠাৎ করে করোনাভাইরাস আতঙ্কে সারাদেশে ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা করা হয়েছে। দীলিপের মায়ের ফ্যাক্টরী বন্ধ। সেলাইমেশিনের কাজেরও কোনো অর্ডার নেই। হাতে জমা টাকা নেই। বাসায় বাজারও নেই। ফ্লোরে বসে দীলিপ নিরিবিলি পড়ছে। বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিঃশব্দে মাকে বাসার বাইরে যেতে দেখে দীলিপ বলল,
– মা, তুমি বিশ্রাম নাও; বাজারে আমি যাই।
বিল্লুরাণী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, 
– না বাবা, তুই মনযোগ দিয়ে পড়। আমি বাজারে যাই।
একথা বলে বিল্লুরাণী বাসার বাইরে চলে গেলেন।

পড়ার ফাঁকে দীলিপ মোবাইলটা টেনে নিয়ে ফেসবুকে চোখ বোলাতে লাগল। হঠাৎ সে দেখতে পায়, কতকগুলো মানুষ অসহায়ের মতো ত্রাণ নিচ্ছে। দীলিপ ছবিটায় মন্তব্য করতে যাবে এমন সময় একজোড়া চোখে চোখ পড়তেই সে থমকে যায়। চোখজোড়ার স্নেহময়ী চাহনি গত সতেরো বছর ধরে সে দেখেছে। শাড়ির আঁচলে মুখ লুকালেও চোখদুটো লুকাতে পারেননি তিনি।

দুপুরবেলা। দীলিপ মায়ের সাথে ভাত খাচ্ছে। হঠাৎ মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– মা, প্রতি কেজি চাল কত করে নিয়েছো?
বিল্লুরাণী ভাতের লোকমাটা মুখে তুলতে গিয়ে কাঁদো গলায় বললেন,
– ওসব তোর জানার দরকার নেই।

তারপর দীলিপের আর মায়ের মুখের দিকে তাকানোর সাহস হয়নি।

কবির কাঞ্চন
কবি ও গল্পকার
সহকারী প্রধান শিক্ষক
জেলা প্রশাসন স্কুল এন্ড কলেজ (ইংরেজি ভার্সন), নোয়াখালী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *