Site icon গল্প

শেয়ালমারা পালোয়ান 

সাঈদুর রহমান লিটন 

স্কুল ছুটি হয় চারটা পনেরতে। বাইকে চেপে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে চারটে বাজে। সেদিনও তাই হলো। বাড়ি ঢুকতেই বউ গরম গরম খবর দিলো, শুনছো, পাশের বাড়ির সঞ্জয় দাশের ছেলেকে শেয়াল কামড়েছে।

আমি তো হতভম্ব। বউ জানাল, সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে টীকা দেওয়া হয়েছে। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়নি। সঞ্জয়ের ভাইস্তে যখন প্রথম দেখেছিল, তখন বাচ্চাটাকে বাঁচাতে গিয়ে সেও শেয়ালের আক্রমণের শিকার হয়। ভাগ্যিস লোকজন দৌড়ে এসে বাঁচালো, নাহলে হালুয়া হয়ে যেত! শেষমেশ হৈচৈয়ের মাঝে শেয়ালটা প্রাণ বাঁচাতে একটা ঘরে ঢুকেছিল, কিন্তু গ্রামের লোকজন ধাওয়া করে মেরে ফেললো।

শেয়ালটির অকাল ইন্তেকাল হলো বটে, কিন্তু গ্রামজুড়ে যেন এক উৎসব শুরু হয়ে গেল। কেউ বলছে, আমাদের গ্রাম তো বেশ সাহসী! শেয়াল ধরে মেরেছে। কিন্তু যে দুঃখী সঞ্জয় দাশের দুই বছরের ছেলেটাকে কামড়ে দিয়েছে, সেটা যেন সকলে ইচ্ছে করেই ভুলে গেল।

আমি এখনও ঘটনা গুছিয়ে নিচ্ছি, এর মধ্যে বউ আবার ফোন ধরলো। কানে তুলতেই গম্ভীর কণ্ঠে জানাল,
জানো, কালাম কাকাকেও শেয়াল কামড়েছে।

আমি তো অবাক! একদিন আগে শেয়াল মারা পড়লো, আজ আবার আরেকটা হাজির হলো! মনে হচ্ছে পুরো গ্রামে যেন শেয়ালের কারখানা বসেছে।

বউ জানাল আরও চমকপ্রদ খবর। কুসরের জমিতে কুসর বেঁধে দিচ্ছিলেন কালাম কাকা। হঠাৎ পিছন থেকে শেয়াল ঝাঁপিয়ে পড়লো। কিন্তু কালাম কাকার হাতে তখন কাঁচি ছিলো।  বীর বিক্রমে তিনি কাঁচির এক পোঁচ মারতেই শেয়ালটির পেট কেটে যায়। সঙ্গে সঙ্গে স্পট ডেড।

বউ মুগ্ধ গলায় বলল,
কালাম কাকা দারুণ সাহসী! এরকম মানুষ দেশে কয়টা জন্মায়?

আমি শুধু বললাম, ঠিকই বলেছো।

বাড়ি ফিরতে ফিরতেই দেখি, গ্রামের রাস্তায় লোকারণ্য। সবাই ভিড় জমাচ্ছে কালাম কাকাদের বাড়িতে। যেন নায়ক দেখে সিনেমাহলে হইচই! কালাম কাকা এখন গ্রামজোড়া খ্যাতি। শেয়াল মারা পালোয়ান উপাধি তার কাঁধে এসে বসেছে।

তাঁর উঠোনে চেয়ার পেতে বসে থাকেন কাকা। নাকে মোচটা পাকানো, গলায় কণ্ঠে আভিজাত্য। লোকজন আসে, হাত মেলায়, ছবি তোলে। কেউ বলে, এমন সাহসী মানুষ গ্রামে জন্মে ভাগ্যগুণে! কেউ আবার ফিসফিস করে, শেয়াল বেচারারও তো কপাল খারাপ।

কাকা অবশ্য খুব উপভোগ করছেন খ্যাতির আলো। লোকজন আসুক, ছবি তুলুক, গল্প হোক সবই তাঁর আনন্দ। কাকা এখন নিয়মিত বীরপুরুষ সাজে।

কেউ কেউ নাকি ভাবছে, গ্রামের মেলায় তাঁকে নিয়ে শোভাযাত্রা করা হবে। হয়তো শের-ই-জগন্নাথদী নামেও গান বাঁধবে কেউ। গ্রামে আর যা-ই হোক, রসিকতার অভাব নেই।

তবে আমি মনে মনে ভাবলাম, শেয়ালের কামড়ে যে দুজন আহত হলো, তাদের বীরত্বের খবরটা কি কেউ মনে রাখলো? সঞ্জয় দাশের শিশু আর তার ভাইস্তে, তাদের কষ্ট গ্রামের লোকজন বেমালুম ভুলে গেলো!

কিন্তু সত্যি কথা হলো, বীরত্বের গল্পে দোষে-গুণে সব ঢাকা পড়ে যায়। এখন আমাদের গ্রামে একটাই নতুন ইতিহাস, শেয়াল মারা পালোয়ানের বীরত্ব। একা একা একটা শেয়াল মেরে ফেলা কম বীরত্ব নয়।

গ্রামঃ জগন্নাথদী পোঃ ব্যাসদী গাজনা 

উপজেলাঃ মধুখালী জেলাঃ ফরিদপুর 

Exit mobile version