Site icon গল্প

ভয়ানস্কির সিনেমা

ধ্রুব নীল : লাইট! ক্যামেরা! অ্যাকশন!

‘অ্যাঁ, ইয়ে মানে, আঁমাদের এঁকন কী কঁরতে হবে? ইয়ে অ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়েচে, আমাদের শাকচুন্নিকে উদ্দার করতে যেঁতে অঁবে..’

‘কাট!’

চেঁচালে ভয়ানস্কির তিনটি চোখই ইঞ্চি দুয়েক ফুলে যায়। তাকে দেখতে তখন প্রাগৈতিহাসিক রাক্ষসদের মতো মনে হয়।

‘মামদো! কত্তোবার বলেছি! নো নাকি নাকি ভয়েস! নিজেকে হিমেশ ভাবা শুরু করেছ? নো! এসব চলবে না! আই নিড অ্যাক্টিং! সিরিয়াস অভিনয় করতে হবে! বুঝলে!’

মামদো বেচারার আর কী দোষ। পড়াশোনা বেশি করেনি। তাই উচ্চারণে একটু আধটু ত্র“টি রয়ে গেছে। তারপরও দেখতে কিছুটা ভয়ংকর বলে ভয়ানস্কি তাকে নায়কের রোল না দিয়ে পারলেন না।

‘দেখ মামদো! শেষবারের মতো বলছি, তোমাকে ডায়ালগ দিতে হবে। ভাবতে হবে, যা ঘটছে তা সত্যি ঘটছে। নিজেকে সত্যি সত্যি ভলিউডের মহানায়ক সর্বভুক খান ভাবতে হবে। আন্ডারস্ট্যান্ড? চুপ কেন! বুঝেছ!’

মামদো চিন্তায় পড়ে গেছে। এরই মধ্যে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে, ভয়ানস্কির সঙ্গে আর জীবনেও কাজ করবে না। ভয়ালপুর ফিল্ম সোসাইটি তথা ভলিউডের সীমানাতেও ঢুকবে না। কিন্তু হাতের কাজ শেষ করতেই হবে। চুক্তি ভাঙা সম্ভব নয়। ভাঙলে পঞ্চাশ গ্যালন চাঁদের আলো জরিমানা দিতে হবে।

‘ইঁয়ে স্যার, আসলে স্ক্রিপ্ট নাই তো, তাই..’

‘নো স্ক্রিপ্ট! আমি কাহিনী লেখা পছন্দ করি না। যা হবে, বাস্তবের মতো। নিজের মতো করে সংলাপ দিতে হবে। ভাবতে হবে যা ঘটছে, তা সত্যি। তবেই তুমি অভিনেতা হতে পারবে। আর সবাই তখন আমাকে ফলো করবে। আমি হবো বিখ্যাত পরিচালক। ভুত সমাজের প্রথম ও একমাত্র সিনেমা পরিচালক। সবাই অটোগ্রাফের জন্য আমাকে ঘিরে ধরবে। তখন আমি বলবো, নো, আমার অটোগ্রাফ দেয়ার সময় নেই। আমি..’

ভয়ানস্কি চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পরিচালক হওয়ার পর তিনি মাঝে মাঝেই এমন দিবাস্বপ্নে হারিয়ে যান।

ক্যামেরাম্যান কেলেমিয়া উসখুশ করছে। শেষে বলেই ফেলল, ‘স্যার, ক্যামেরা অন করবো?’

‘ক্যামেরা? ও ইয়া। হ্যাঁ হ্যাঁ, ক্যামেরা। লাইট? লাইট কোথায়?’

লাইটম্যান শ্যাওড়ার লিকলিকে শরীর। তারপরও পাঁচ হাতে কোনোমতে ছটা লাইট ধরে আছে। দেখে মনে হবে ভূত হওয়ার পর থেকেই যেন সে লাইটম্যান। ঘেমে একাকার। ঘাম মোছার জন্য আরেকটা হাত থাকলে বেশ হতো।

মামদো! গেট রেডি। আমি দশ পর্যন্ত গুনবো, এর মধ্যে প্রস্তুতি নাও!’ ভয়ানস্কি হুঙ্কার ছাড়লেন।

বড় করে দম নিলো মামদো। ভয়ানস্কির চোখ মুখ শক্ত। ক্যামেরার পাশে রাখা মিনি স্ক্রিনে দম আটকে তাকিয়ে আছেন।

‘সাত! আট! নয়! দশ!’

‘অ্যাঁ! বলেচেন দশ পর্যন্ত!’

‘আমি এক থেকে গুনবো বলিনি মামদো! নাও অ্যাকশন!’

মামদোর সামনে প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এককালের মঞ্চ কাঁপানো তারকা কমেডিয়ান ডেভিড স্কন্ধকাটা। সে তার প্রথম ডায়ালগটা দিল।

‘সর্বভুক! মহাবিপদ হয়ে গেছে! গুপ্তধনের মানচিত্রটা রাক্ষসরা পেয়ে গেছে! কারণ ওটা ছিল শাকচুন্নির কাছে। আর শাকচুন্নি এখন রাক্ষসদের হাতে বন্দি! আমি নিজের চোখে সব দেখেছি!’

মামদো ওরফে সর্বভুক খান চোখ কুঁচকে স্কন্ধকাটার দিকে তাকালো। তবে কোনো ডায়ালগ দিচ্ছে না। ভয়ানস্কির তিনটে চোখ ক্রমে রাগি রাগি হয়ে আসছে। মামদোর সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই। সে তার হাতা গোটাচ্ছে।

আচমকা ধড়াম করে স্কন্ধকাটার ঘাড়ে একটা থাপ্পড় বসালো মামদো। ভাগ্যিস স্কন্ধকাটার মাথা নেই। থাকলে থাপ্পড়টা খেত গালে। আর তাতে মামদোর আট আঙুলের জ্বলজ্যান্ত ছাপ বসে যেত। বেশ আত্মবিশ্বাসীর মতো গজগজ করে বলল মামদো, ‘মিথ্যেবাদী! তোর তো মাথাই নেই। তুই কী করে নিজের চোখে দেখলি!’

মার খেয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে স্কন্ধকাটা। ইতিউতি ঘাড় ঘোরাচ্ছে। এদিকে ফিসফিস করে ভয়ানস্কি বললেন, ‘কিপ রোলিং! কিপ রোলিং!’

মামদো কিছুটা আয়েশী ভঙ্গিতে বলল, ‘হুমমম, ম্যাপটা তাহলে রাক্ষসদের হাতে।’ পরের ডায়ালগ দিয়ে ঘাড়ের ব্যাথাটা ভোলার চেষ্টা করলো স্কন্ধকাটা।

‘না! ওদের হাতে না! ওরা ম্যাপটাকে একটা নদীর তলায় বাক্সের ভেতর রেখে দিয়েছে। আমাদের এখন ঐ নদীর তলায় অভিযান চালাতে হবে বস্।’

মুহূর্তে ধড়াম করে আরেকটা থাপ্পড়। এবার তাল সামলাতে না পেরে পড়েই গেল স্কন্ধকাটা।

‘কী করতে হবে না করতে সেটা আমি বুঝবো! তুই কে বলার! রাক্ষসদের মগজের আনাচে কানাচে কখন কী খেলা করে, তা আমি ভাল করেই জানি! ওরা যদি চলে পাতায় পাতায়, না না, (একটু ভেবে নিয়ে) ওরা যদি চলে ডালে ডালে, তবে আমি চলি পাতায় পাতায়। কারণ, আমি, হ্যাঁ, আমিই হঁচ্ছি সঁর্বভুক খান। আমাকে দেখে ভয়ে কাঁপে কে? শাঁহরুখ খান, সোঁলায়মান খান। বুঁঝলি!’

‘সোলায়মান না ওস্তাদ, ওটা হবে সালমান খান।’ মিনমিন করে জবাব দিল স্কন্ধকাটা। তবে এবার নিরাপদ দূরত্বে থাকায় তৃতীয় থাপ্পড় থেকে বেঁচে গেল।

খুশিতে আট দু গুণে ষোলখানা হয়ে আছেন ভয়ানস্কি। মামদোই হাত উঁচিয়ে কেলেমিয়াকে ইশারায় ক্যামেরা বন্ধ করতে বলল। পরমুহূর্তে ভয়ানস্কির চিৎকার, ‘কাট!’

স্কন্ধকাটা তড়াক করে লাফিয়ে পেছনে সরে গেল। হাত দুটো সামনে এনে বলল, ‘বস্, ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দ্যান। দয়া করে কাটবেন না!’

‘আজকের মতো প্যাকাপ। মানে শুটিং বন্ধ। কালকে আবার এই সময়ে আসবে সবাই। মধ্যরাতের পর। শুটিং হবে শ্যাওলা দীঘির তলায় দুনম্বর ফ্লোরে।’

হুশশ করে দম ফেললো মামদো। নিজেকে সত্যি সত্যি আজ নায়ক মনে হয়েছে তার। এক অদ্ভুত ব্যাপার টের পেয়েছে। যখনই সে ভেবেছে সে নায়ক, যেন হুট করে অনেক ক্ষমতা এসে গেছে। তখুনি কোত্থেকে হড়বড় করে একগাদা ডায়ালগও চলে এসেছে। ব্যাপারটা আসলেই আজব। 

স্কন্ধকাটা প্যাকাপ শব্দটা শুনতে পায়নি। ক্যামেরা লাইট বন্ধ করে সবাই চলে গেলেও সে ডায়ালগ দিয়েই যাচ্ছে। ‘হ্যাঁ সর্বভুক, আই মিন বস্, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। রাক্ষস সেজেই যাবো ওদের আস্তানায়। তারপর? বস? শুনতে পাচ্ছেন? কেউ আছে? অ্যাঁ! কেলেমিয়া! শ্যাওড়া!  ওরে আমার ভাই কেলেভূত! ওরে লক্ষী শ্যাওড়া, আমায় ফেলে যাসনে! আমি পথ চিনবো না যে!’

পরদিন মধ্যরাত। সবাই রেডি। আজ শাকচুন্নি ও গুপ্তধন উদ্ধারের দৃশ্য নেয়া হবে। দুচারজন রাক্ষসকে দাওয়াত দিয়ে আনা হয়েছে। ওরা সচরাচর অভিনয় করতে চায় না। কিন্তু বিজ্ঞানী ভয়ানস্কি বিজ্ঞানচর্চা ছেড়ে সিনেমা বানাচ্ছেন, এমন খবর পাওয়ার পর আর না এসে পারলো না। ওদেরও দেখিয়ে দিতে হবে, শিল্প সাহিত্যে কেবল ভূতরা নয়, রাক্ষসরাও পারে একটা কিছু করে দেখাতে।

অভিনয় করবে দুজন রাক্ষস। সঙ্গে এসেছে আরো গোটা পঞ্চাশ। ওরা হচ্ছে স্পেশাল ফোর্স আরপিটি (রাক্ষস প্রোটেকশন টিম)। কিছুই বলা যায় না। ভূতে-রাক্ষসে ইদানীং সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না।

ভয়ানস্কিও কিছুটা চিন্তিত। একে তো সিনেমার কাহিনী কী হবে তা তিনি নিজেও জানেন না। অভিনেতারা ঘটনা যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই গড়াবে। শেষে নায়কের জয় নাও হতে পারে। নির্ভর করছে সর্বভুক খানের ওপর।

যথারীতি আজো মামদোর সঙ্গে আছে স্কন্ধকাটা। ভয়ানস্কি বলে দিয়েছেন ক্যামেরা যেন বন্ধ না হয়। যা যা ঘটবে সবই রেকর্ড হবে। অভিনেতাদের ডায়ালগ নিয়ে চিন্তা করতেও নিষেধ করেছেন। যার যা ইচ্ছে হবে তাই যেন বলে। গতকালের পর থেকে মামদোর ওপর ভয়ানস্কির বিশ্বাস অনেক বেড়েছে। তাই মামদোর ডায়ালগ ঠিক থাকলেই হলো। বাকিদের নিয়ে তিনি মোটেও চিন্তিত নন।

‘সব রেডি?’ ভয়ানস্কির খোশমেজাজে আছেন।

‘ইঁয়েস স্যার!’ স্কন্ধকাটা তার ঘাড়ে ভাল করে ন্যাকড়া পেঁচিয়ে নিচ্ছে। কারণ মামদোর হাতে আজ শক্ত গ্লাভস।

সিনেমায় রাক্ষস দুজনের নাম হালু কালু। ওরা বসে আছে পুকুর পাড়ের এক পুরনো আমগাছের ডালে। ডালের শেষ প্রান্তে দড়ি দিয়ে শাকচুন্নিকে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাকে খুব একটা অসহায় দেখাচ্ছে না। কিছুটা বিরক্ত। মামদোর মতো একটা বিদঘুটে ভূত তাকে উদ্ধার করতে এসেছে, ভাবতেই ভয়ানস্কির ওপর রাগে তার ছাপ্পান্নটা দাঁত কিড়মিড় করে উঠছে। ভলিউডের সেরা নায়িকা হয়েই যতো বিপত্তি। ভয়ানস্কিকে কিছু বললেই পরদিন হইচই শুরু হয়ে যাবে।

‘ক্যামেরা চলছে। তোমরা অভিনয় শুরু করে দাও।’ লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন শোনেনি, তাই ঠিকমতো প্রস্তুত হতে পারলো না মামদো। তারপরও হাত দুটো পিঠের পেছনে নিয়ে ‘আরামে দাঁড়াও’ ভঙ্গিতে রাক্ষস দুজনের দিকে এগিয়ে আসছে। হালু কালু কেমন যেন আমুদে একটা হাসি দিল। চোখ না থাকায় স্কন্ধকাটা বুঝতে পারলো না ওরা আসলে তার দিকে তাকিয়েই হাসছে।

স্কন্ধকাটা মামদোর সাথেই। বলল, ‘বস্ ওরা কি আপনাকে দেখে ভয় পাচ্ছে?’

‘চুপ! গবেট কোথাকার। তোর মাথা ভর্তি দেখি.. ও না, তোর তো মাথাই নেই।’

‘বস্ আমিই প্রথম ধমকটা দেই? এরপর তুমি তো আছোই।’

এদিকে হালু কালুর দিকে তাকিয়ে কিছুটা জোর গলায় বলল, ‘কালু তোর লাস্ট ক্রিকেট ম্যাচটার কথা মনে আছে? ঐ যে এক ছক্কায় সোয়া দুই কোটি রান করেছিলাম? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে একটা লম্বা বল এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। ছক্কা মারার জন্য হাত দুটো খুব চুলকাচ্ছেরে।’

‘হুম, বেশি খুশি হওয়ার কিছু নাই। সঙ্গে মটকুটাকে দেখছিস না? একটু সাবধানে।’

মামদো এসে হালু কালুর সামনে বুক উঁচিয়ে দাঁড়ালো। ভাবখানা এমন যে, তোরা আর কী করবি, আমি হচ্ছি সিনেমার নায়ক। জয় তো আমার হবেই। কিন্তু মামদো এটা ভুলে গেছে যে ভয়ানস্কি কাহিনী ছাড়াই সিনেমা বানাচ্ছেন। ঘটতে পারে যেকোন কিছু।

স্কন্ধকাটা মিনমিন করে বলল, ‘হেই রাক্ষসের দল, তোরা শাকচুন্নিকে কোথায় রেখেছিস বল!’

একথা শুনে গাছে ঝুলতে থাকা শাকচুন্নি গেল খেপে। চেঁচিয়ে বলল, ‘গাধা! আমি তোর সামনে। গাছের ওপর। দেখছিস না!’

মামদো বিব্রত। ভয়ানস্কি মিটিমিটি হাসছেন। সিনেমায় কমেডি থাকলে দ্বিগুন দর্শক।

হালু বলল, ‘হে হে হে। এ সিনেমায় তো যা ইচ্ছে তাই করতে পারবো, তাই না? হে হে। কালু, আয় হাত লাগা।’

মামদো আরেকটু বিব্রত। তার নায়কসুলভ ভাব উধাও। সিনেমায় তো নকল মারামারি হয়। কিন্তু ভয়ানস্কি বলে দিয়েছেন সব যেন বাস্তবের মতো হয়। তার মানে কি!’

ভাবার সময় পেল না। তার আগেই পেটে একটা বত্রিশ টনের ঘুষি। ঘোঁৎ শব্দ করে মামদোর পেটের সব বাতাস বের হয়ে গেল। স্কন্ধকাটা বুঝতে পারছে না কিছু। সে বলেই যাচ্ছে, ‘বস্, প্রথমে আমরা রাক্ষস দুটোকে হালুয়া বানাবো, এরপর শাকচুন্নিকে উদ্ধার করবো, এরপর নদীর তলায় যাবো, এরপর বাক্স খুঁজবো, এরপর… উহ। ও মাগো! গলা চেপে ধরলো কে! দম আৎকে আসচে! বস্! বাঁচান!’

মামদো অতিকষ্টে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আশপাশে তাকিয়ে দেখলো ভূতপাড়ার সবাই হাজির। শুটিং দেখতে এসেছে। যা ঘটবে সবই শুটিং বলে ধরে নেবে তারা! বিপদের মাত্রা হাড়ে হাড়ে টের পেল মামদো। রাক্ষসের সঙ্গে লড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। কিন্তু ক্যামরা চলছেই। আজ বোধহয় এখানেই মরে ভুত থেকে টুত হয়ে যাবে। সবাই ভাববে সিনেমার শেষটা বুঝি এমন দুঃখের!

এক হাত দিয়ে স্কন্ধকাটার গলা চেপে আছে কালু। অন্য হাতে শাকচুন্নিকে গাছ থেকে নামার ইশারা করছে। মামদো চোখ কুঁচকে শাকচুন্নির দিকে তাকালো। শাকচুন্নিকে হাসি হাসি মুখে বলল, ‘সর্বভুক খান, তোমার নাম হওয়া উচিৎ ছিল বোকা খান। কারণ তুমি আমাকে চিনতেই পারোনি। হাহাহা। আমিই বুদ্ধি করেই তোমাদের এখানে নিয়ে এসেছি। এখন বল ম্যাপটা কোথায়! তা না হলে বেঁচে ফিরতে পারবে না।’

মামদো বড়সড় ঢোক গিলল, ‘ইয়ে, ম্যাপ? কোন ম্যাপ? আমি কোনো ম্যাপট্যাপ চিনি না।’

হালু পেট দুলিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘দশ পর্যন্ত গুনবো এরমধ্যে ম্যাপ না দিলে তোমার মাথাবিহীন বন্ধুর বাকি শরীরটাও নাই হয়ে যাবে।’

মামদো চিঁচিঁ করে বলল, ‘কেন ভাই, তুমি কি একশ পর্যন্ত গোনা শেখনি? এতো বড় হয়ে গেছ, এখনো কেবল দশ পর্যন্ত?’

হালুর রাগ একলাফে ডাবল হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গোনা শুরু করলো, ‘এক! তের! বিয়াল্লিশ! পঁয়ষট্টি!’

মামদো কাতর দৃষ্টিতে শুটিং দেখতে আসা ভূতদের দিকে তাকালো। হাত উঁচিয়ে বলল, ‘আমাদের বাঁচান। ওরা আমাকে সত্যি সত্যি মারবে! হেল্প হেল্প!’

মামদোর চিৎকারে কেউ কান দিল না। বাঁচাতে গিয়ে ভয়ানস্কির সিনেমা যদি নষ্ট করে ফেলে! স্কন্ধকাটা এতোক্ষণ তার পকেটে হাত ঢোকানোর চেষ্টা করছিল। মামদোর চিৎকার শুনে তার মেজাজ গেল বিগড়ে। বস্ কোনো কাজেরই না! মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে স্কন্ধকাটার হাত খানিকটা লম্বা হয়ে যায়। ব্যস পকেটে হাত ঢুকে গেল। বেরিয়ে এলো মোক্ষম অস্ত্র। একটা টর্চলাইট!

সবাই স্থির। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। পঁচানব্বই পর্যন্ত গুনে হালুও চুপ। কেবল ক্যামেরার ঘড়ঘড় শব্দ।

চোখ না থাকায় সবার আতঙ্কিত চেহারা দেখতে পেল না স্কন্ধকাটা। কালু অনেক আগেই গাছের আড়ালে লুকিয়েছে।

মামদো বিড় বিড় করে বলল, স্কন্ধকাটা! এটা কি সত্যি সত্যি জ্বলে! নাকি খেলনা?’

‘বস্, এক্কেবারে খাঁটি এক নাম্বার ব্যাটারির হাই পাওয়ার টর্চলাইট। দিনের বেলার মতো আলো। এখন বলেন, গরু দুইটা কই লুকাইছে। ইয়ামি ইয়ামি! আজকে ওদের খেলা শেষ।’

স্পেশাল ফোর্স আরপিটির রাক্ষসরা সব গায়েব। টর্চ-প্র“ফ জ্যাকেট নেই তাদের। স্কন্ধকাটা হাতড়ে হাতড়ে অন করে দিল টর্চের সুইচ। মুহূর্তে আলোর একটা সরু রেখা বেরিয়ে এলো। ব্যাটারির চার্জ কম থাকায় রক্ষে। তা না হলে এর তেজে মামদোই জ্ঞান হারাতো। স্কন্ধকাটা আন্দাজ করে আলোটা এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে। আর তাতেই হুলুস্থুল লেগে গেল। ভূতপাড়ায় যেন আগুন লেগেছে। যে যেদিকে পারছে ছুটছে। স্কন্ধকাটা হাতড়ে হাতড়ে গাছের কাছে এগিয়ে গেল। কালু নড়তে পারেনি। ভয়ে স্ট্যাচু হয়ে গেছে।

‘রাক্ষস! বেরিয়ে আয়! যা নদীর তলা থেকে ম্যাপটা নিয়ে আয়! এক থেকে দুই পর্যন্ত গুনবো!’ পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘হে হে, বস্, এর বেশি গুনতে শিখি নাই।’

টর্চ দেখে কেলেমিয়া পালিয়েছে। তাই ভয়ানস্কি নিজেই ক্যামেরা ধরে আছেন। ভাবছেন ম্যাপের কথা। গুপ্তধনের ম্যাপ বলে আসলে কিছু নেই। রাক্ষস দুটো কিছুই খুঁজে পাবে না। স্কন্ধকাটা সিনেমাকে কোনদিকে নিয়ে যাবে কে জানে! তবে ঝামেলা ছাড়াই একদল আতঙ্কিত গ্রামবাসীর দৃশ্য নিতে পেরে তিনি বেজায় খুশি। পরে অন্য সিনেমায় এ দৃশ্য জুড়ে দেয়া যাবে।

রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল শাকচুন্নি। হালু কালু ডুব দিয়েই যাচ্ছে। টর্চ হাতে পাহারা দিচ্ছে স্কন্ধকাটা। মাঝে মাঝে মামদোর দিকে তাকিয়ে ডায়ালগ দিচ্ছে।

‘বুঝলেন বস্, আসলে সত্যিকার সিনেমায় সত্যি সত্যি তৈরি হয়ে আসতে হয়। এই জন্যই এটা নিয়ে এসেছি।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, গুড। ঠিক বলেছ। ঠিক ঠিক।’ ভয়ানস্কির দিকে তাকিয়ে মামদো ফিসফিস করে বলল, ‘স্যার! সিনেমা শেষ হবে কবে? আমি যাই?’ ভয়ানস্কি চিৎকার করে উঠলেন, ‘কাট না বলা পর্যন্ত অভিনয় না করলে একদম কেটে ফেলবো!’

Exit mobile version