Site icon গল্প

শেষ ট্রেনের অপেক্ষা

waiting for train abstract story

মামুন সরকার

কমলাপুর স্টেশন

রাত প্রায় ১১টা। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।

প্ল্যাটফর্মের বাতিগুলো হলদে পাতার মত ঝাপসা। ক্ষণে ক্ষণে বৈরী বাতাসে বৃষ্টির ছাঁট এসে যাত্রীদের গায়ে লাগছে। প্ল্যাটফর্মে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা।  এদিক সেদিক দৌড় ছুট করছে। কিছু তরুণ যুবা দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে উঠানামা করছে।আবার কেউ কেউ দাঁড়িয়ে ভ্রাম্যমান টোকাইয়ের কাছ থেকে চা সিগারেট পান করছে। গরম চায়ের ধোঁয়া আর সিগারেটের গন্ধ মিলেমিশে অদ্ভুত একটা পরিবেশ।

ভেজা রেললাইন ঝিকমিক করছে ট্রেনের হেডলাইটের আলোয়।

একটা ট্রেন ধীর লয়ে  ঢুকে চার নম্বর প্লাটফর্মে, আরেকটা ছেড়ে যায় ছয় নম্বর থেকে।রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে প্লাটফর্মের পিলার ঘেষে এক কোণে। তার ট্রেন রাত বারোটায়। রুদ্র যাবে রাজশাহী। হাতের 

ব্যাগটা পায়ের কাছে রেখে চারদিকে চোখ ঘোরায়, একহাতে ধরা পুরনো মুঠোফোন। শরীরে পালস ধীরে চললেও বুকের ভিতর কিছু একটা ঘণ্টায় শত মাইল বেগে ছুটছে। এক তরুণীকে সামনে আসতে দেখে রুদ্রের চোখ আটকে যায়।

চার বছর আগের কিছু স্মৃতি সিনেমার মত চোখের পর্দায় বিচ্ছুরিত হয়।

চারটা ঋতু কম কিছু না, দীর্ঘ একটা সময়। চৌদ্দ শত ষাট  দিবারাতের একটা মহাকাব্য। বুকের ভেতর একটা নাম হৃদপিণ্ডের সাথে মিশে আছে। চোখের ফ্রেমে বাঁধা আছে পুষ্পের মত ফুটফুটে কলেজ জীবনের প্রেমিকা সেতুর মুখচ্ছবি। যার  নামটা চার চারটি বছর ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারেনি। হঠাৎ কোনকিছু না বলে সেতুটা কোথায় যে নিরুদ্দেশ হলো, অনেক খোঁজা খুঁজি করেও কোন ক্লো বের করতে পারেনি। বড় ভুলটা ছিলো সেতুর কোন ঠিকানা জানা ছিল না রুদ্রের। ভার্সিটির ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে চুকিয়ে প্রেম করেছে কেউ কারো বাসা বাড়ির ঠিকানা রাখেনি। শুধু জানত সেতু তার এক খালার বাসায় থাকে। বাসা মগবাজার। আর রুদ্র থাকত শাজাহানপুর রেল কলোনিতে।  আজ  অপরিচিতা তরুণীকে দেখে বুকের ভেতরে একটু কম্পন অনুভূত হয়। মনে হয় সেতুই তার সামন দিয়ে হেঁটে গেলো।

রাত সারে এগারটা বাজলেও প্লাটফর্মে রাজশাহী গামী ট্রেন আসার নামগন্ধ নেই। কেউ কেউ বলছে বৃষ্টিও ঝড়ো হাওযার কারণে ট্রেন আসতে খানিকটা সময় দেরী হবে। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করতেই হঠাৎ মুঠোফোনে টিং করে একটা মেসেজ আসার শব্দ হয়।

ওপেন করতেই ছোট্ট একটা টেক্সট চোখে পড়ে।

“আমি স্টেশনে। তোর সাথে দেখা করতেই এসেছি। যদি তুই অনুমতি দিস। তোর হারানো প্রেমিকা সেতু।

সেতুর নাম দেখে রুদ্রের পালসে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গা হিম হয়ে আসে। কী ঘটতে যাচ্ছে আন্দাজ করতে পারে না। যার সাথে দীর্ঘ চার বছর কোন যোগাযোগ নেই সেই সেতু কি না বৃষ্টি ঝরা মাঝরাতে দেখার করার জন্য অপেক্ষা করছে। রুদ্র  কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সারা শরীর শীতকাটা দিয়ে হাত কাঁপতে থাকে। একটা অজানা অস্থিরতায় সিগরেটটা হাত থেকে পড়ে যায়। পানির তেষ্টায় ঠোঁট শুকিয়ে আসে।

খানিক সময় চোখ বন্ধ করে নিজেকে অন্যভাবে আবিস্কার করে। রুদ্রের সন্ধানী চোখ সেতুকে খুঁজে। সেতুও এক্সিট গেট অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকে রুদ্রকে খুজতে থাকে। পরনে মেরুন রঙের সালোয়ার কামিজ। মাথায় কালো হিজাব জড়ানো। স্টেশনের মিনমিনে আলোতে সেতুর মুখ পূর্ণিমার চাঁদের মত মনে হয়। হিজাব হালকা ভেজা। বৃষ্টিভেজা বৈরী বাতাসে গা একটু কাঁপছে। সেতুর। একসময় দু’জন মুখোমুখি হয়। সেতু মুখ তোলে সরাসরি রুদ্রের চোখে চোখ রাখে। দীর্ঘ চার বছরের পাথর চাপা অভিমান, দুঃখকষ্ট আর অপেক্ষা—এক মুহূর্তেই বরফের মত গলে জল হয়ে ঝরে।

রুদ্র চোখের দৃষ্টি না সরিয়ে, একটু কাঁপা গলায় জানতে চায়, সত্যিই তুই এলি? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?

সেতু কোন  জবাব দেয় না। অপলক দৃষ্টি রুদ্রের দিকে।ঠোঁট মৃদু কাঁপছে, কিন্তু শব্দ বের হচ্ছে না।

একটা ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। কিছু যাত্রী ছুটাছুটি  করে দ্রুত ট্রেনে উঠে পড়ে। তবু সেতুর দৃষ্টির সুতো টুটে না। সেতু  ফিসফিস করে বলে,

তুই রাজশাহী চলে যাচ্চিস শুনে আর স্থির থাকতে পারলাম না। এই স্টেশনে তোকে পাব ভেবেই এসেছি।

রুদ্র বলে, চার চারটা বছর তোর সাথে আমার দেখা নেই, কথা নেই, মোবাইলে কোন যোগাযোগ নেই, আমি রাজশাহী চলে যাচ্ছি তুই জানলি কি করে? 

সেতু বলে, আমি তোকে কষ্ট দিয়ে দূরে থাকলেও, তোর মন থেকে পালাতে পারিনি। 

তাই বলে চার চারটা বছর কোন যোগাযোগ থাকবে না। অনন্ত একটা ফোন তো দিতে—

রুদ্র কথা শেষ করতে পারে না। সেতু কথা কেড়ে নিয়ে বলে,সে অনেক কথা রুদ্র। তুই কি সত্যিই রাজশাহী  চলে যাচ্ছিস? 

হ্যাঁ, তুই যা শুনেছিস তা সত্যি। আমার একটা ভালো চাকরি হয়েছে। রাজশাহীতে পোস্টিং। আমার তো আর কেউ নেই যে তার অপেক্ষায় থাকবো। 

সেতুর ভেতরটা কেঁপে উঠে। চোখের কোণে জল চিকচিক করে। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সে বলে, তুই যদি চলে যাস, আমি বাঁচব কাকে নিয়ে। তুই জানিস না রুদ্র। আমি তো মরেই গিয়েছিলাম। শুধু তোকে পাবার আশে বেঁচে আছি।

রুদ্র সেতুর কথার কোন আগামাথা বুঝতে পারে না। 

রুদ্রও একটা কষ্টের নিঃশ্বাস গোপন করে। হাজারো মানুষের ভিড়ের মাঝে তাদের দু’জনের মাঝখানে যেন একটা রেললাইন। যার দুই পাশে—দুইটা হারানো মানুষ। রুদ্র বলে,  আমি তো শুনেছি তোর বিয়ে হয়ে গেছে। ঘর সংসার নিয়ে ভালোই আছিস। 

সেতু চুপচাপ। ওরা একটা বেঞ্চে বসে। বেঞ্চে তেমন লোকজন নেই। লম্বা হুইসেল বাজিয়ে রাজশাহী গামী ট্রেন এসে পাঁচ নাম্বার প্লাটফর্মে দাঁড়ায়। হুড়মুড় করে যাত্রীরা নামছে। রুদ্র  ট্রেনের দিকে তাকায়। সেতু বলে, যা শুনেছিস সব মিথ্যে। মা বাবা আত্মীয়-স্বজন জোর করে আমাকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। আমি রাজি হয়নি বলে আমাকে অনেকটা গৃহবন্দী করে রাখা হয়। বিয়ের দিন তারিখও ঠিক। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো গ্রামের বাড়িতে। বাইরে যাওয়া নিষেধ। মোবাইলে কথা বলা নিষেধ। মোবাইল সিম ডিসকানেক্ট করা হলো। যার কারণে তোর সাথে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। 

তুই কি জানিস, আমি প্রতিদিন ফোন করতাম,

দিনের পর দিন, রাতে ঘুম ভেঙে গেলেও ফোন করতাম। অপর পাশ থেকে শুধু শুনতাম, ‘এই নম্বর আর চালু নেই’।

এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে তোকে খুঁজিনি।

কিন্তু তুই… কোনোদিন একবারও খোঁজ করলি না।

আমার সে সুযোগ ছিল না রুদ্র। আমাকে সবাই চোখে চোখে রাখতো। কোথাও গেলে মা সাথে থাকতো। আর মোবাইল না থাকলে যা হয়, আমার তাই হয়েছে।

তা আজ কি করে জানলি আমি এখানে আছি। 

কোন কারণে বিয়েটা ভেঙে গেছে। গোপন সূত্রে বাবা জানতে পারলো, ছেলে প্রবাসী হলেও তার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল। বিয়ে ভেঙ্গে গেলেো বাবা আমাকে আর ঢাকা আসতে দিল না। শুধু অর্নাস ফাইনাল দেয়ার সুযোগ দিল। পরিক্ষা দিলাম পাশও করতাম। এখানে আমার শিক্ষা জীবনে ইতি ঘটলো। আত্মীয়-স্বজন আরো কয়েকটা পাত্রের খোঁজ দিয়ে ছিল কিন্তু আমার পছন্দ হয়নি। আজ একসপ্তাহ হয় বাবা মা’র সাথে খালার বাসায় এসেছি।  বাবা হার্ডে র রোগী। চিকিৎসা চলছে। ডাক্তার বলেছে দুটো রিং পড়াতে হবে। সেদিন তোর বন্ধু সজলের সাথে দেখা। সজলই তোর সব ইনফরমেশন দিয়েছে। আজ রাত বারোটায় তোর ট্রেন তাও বলেছে।

তা এত রাতে এখানে যে এলি তোর বাবা মা কী জানে?

না। না বলে এসেছি। শুধু তোর হাতটা ধরব বলে।

কিছু সময়ের জন্য রুদ্রের কথা থেমে যায়। তার চোখের ভেতর গাঢ় বিষন্নতা। একবার সেতুর মুখের দিকে তাকায়, আবার প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের দিকে তাকায়। রাজশাহী গামী রাতের শেষ ট্রেনে যাত্রীদের উঠানামার কাজ শেষ। প্লাটফর্মে মানুষের তেমন একটা ভির নেই। কিছু ঠিকানাহীন মানুষ ঘুরাফেরা করছে। কেউ কেউ সুবিধামত জায়গা খুঁজে বিছানা পাতছে। সারাদিনের ক্লান্তির চোখ দুটো বুজার জন্য।

রুদ্র বেঞ্চ থেকে উঠে ধীর পায়ে ট্রেনের সামনে এসে দাঁড়ায়। সাথে সেতুও আসে। মাইকে ঘোষণা শোনা যায়, আর কিছুক্ষণের মধ্যে “রাজশাহী এক্সপ্রেস পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে যাবে। সেতু ধরা গলায় বলে, তুই কি সত্যিই চলে যাবি?

চার বছর তোকে হারিয়ে মরার মত বেঁচে আছি। চাকরিটা হারালে বাঁচার আর কোন পথ থাকবে না।

আমিও তোর সাথে বাঁচকে চাই রুদ্র।

রুদ্র কষ্টমাখা কন্ঠে বলে, না রে সেতু। আমি আর নতুন করে স্বপ্ন দেখতে চাই না। স্বপ্ন মানুষকে বড় কাঁদায়। তুই তোর বাবা মা’র অবাধ্যে কিছু করিস না। তোর বাবা হার্ডের রোগী। আমার সাথে তোর সম্পর্কটা মেনে নিতে পারবে না। তাছাড়া তুই তো জানিস। আমার কোন ঠাঁই ঠিকানা নেই। আমার মা মারা যাওয়ার পর বাবা আরেকটা বিয়ে করেন। আমার মায়ের আমিই একমাত্র সন্তান। সৎ মায়ের সংসারে আমার আরো দুই ভাইবোন আছে। তাদের সাথে আমার মিলে না। 

রুদ্রের কথা শুনে সেতুর চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। সেতু বলে, আমার হৃদয়ে তোর যে শক্ত অবস্থান, সেখানে তুই ছাড়া আর কাউকে বসাতে পারবো না। 

আমার দিবারাত্র স্বপ্ন শুধু তোকে নিয়ে। তুই ছাড়া আমার জীবন অন্ধকার। বাবা এখন আর আগের মত নেই। অনেকটা বদলে গেছে। একদিন তোর নামটা শুনতে পারত না। অথচ, সেদিন কাছে ডেকে নিয়ে তোর কথা জিজ্ঞেস করলো। জানতে চাইল তোর সাথে কোন যোগাযোগ আছে কিনা। বাবার এমন মহৎ আচরণে আমি হতবাক। আমার কাছে কোন জবাব ছিল না। শুধু দুচোখে শ্রাবণের বৃষ্টি ঝরলো। বাবা বুঝে নিয়েছে তোর সাথে যোগাযোগ নেই। আজ তোকে পেয়ে হারাতে পারব না। তুই যদি এই ট্রেনে উঠে যাস, আমি জানি—আমার জীবন থেকে সব আলো নিভে যাবে। তোর কাছে কিছু চাইতে আসিনি। শুধু বলতে এসেছি, আমার গায়ে আজও তোর ভালোবাসার গন্ধ লেগে আছে। আমি চাইলেও আমার হৃদয়ে যে রুদ্র শিকড় গেঁড়েছে তাকে আমি ভুলতে পারব না। 

সেতুর কথা শুনে রুদ্রের চোখেও মেঘ জমে। চারটি বছর  রুদ্রও সেতুকে ভুলতে পারেনি। আয়নার প্রতিচ্ছবির মত সেতুর মুখাকৃতি দিবারাত্র তার দৃষ্টিতে ছিল। রুদ্র বলে, আমি তোকে ভুলে যেতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। একটা মানুষ কিছু না বলে কিভাবে যে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, ভাবতেই বুক ফেটে কান্না বরিয়ে আসত। জীবন থেকে চারটা বসন্ত হারিয়ে গেল, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম এ শহরে আর থাকবো না। 

 কথা বলতে বলতে রুদ্রের কণ্ঠ ধরে আসে। বাহিরে বৃষ্টি থেমে গেছে। শীতল বাতাসে পঁচা মাটির সোঁদা গন্ধ ভেসে আসে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রুদ্র বলে, 

তোর গায়ের গন্ধটা ভুলতেই আমি রাজশাহী যাচ্ছি।

একটা নতুন শহর, নতুন কর্মস্থল, নতুন জীবন।

কিন্তু তুই এসে, আমার সব গুছানো নতুন স্বপ্নকে এলোমেলো করে দিলি। তুই কী চাস সেতু?

প্রশ্ন করে রুদ্র সেতুর চোখে চোখ রাখে। সেতুও দৃষ্টি রাখে রুদ্রের চোখে। চার চোখের মহামিলনে তৈরী হয় অন্যরকম এক অনুভূতি। যে অনুভূতি চার বছরের জমে থাকা দুঃখকষ্টের মেঘ শীতল বৃষ্টি হয়ে ঝরে। সেতু ওড়নার আঁচলে চোখ মুছে বলে, আমি বলতে চাই,তুই আর একা না তোর পাশে আমিও আছি। কথার বলার মাঝে সেতু রুদ্রের হাত চেপে ধরে এবং বলে, তুই শুধু বল্ এই হাতের বন্ধন আর  টুটবে না। আমি কথা দিলাম আমি আমৃত্যু তোর পাশে থাকব। অনাগত ঝরতুফানে তুই আমার মাথার ছাতা। শুধু তোর বুকে আমার মাথা রাখার ঠাঁইটুকু আমাকে দে। 

কথা কথা বলতে বলতে সেতু রুদ্রের বুকে মাথা গুঁজে নিরবে কাঁদকে থাকে। 

লাইন ক্লিয়ারের ফ্ল্যাশিং আলো লাল হয়। রাজশাহী এক্সপ্রেসের হুইসেল বেজে উঠে। চারপাশে সুনসান নীরবতা। রুদ্র চোখ বন্ধ করে সেতুর মাথা বুকে চেপে ধরে একটা গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,  এই ভালোবাসার বুকটা আগেও তোর ছিল, আজও তোরই আছে। এই বুকে তুই ছাড়া আর কারো ঠাঁই নাই।

 লাইনম্যানের সবুজ সংকেত পেয়ে ধীর লয়ে ট্রেনের চাকা ঘুরতে থাকে। রুদ্র বুক থেকে দু’হাতে মাথা সরিয়ে সেতুর একটা হাত ধরে  বলে, চল ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে,  উঠে পড়ি। 

রুদ্র সেতুকে নিয়ে ট্রেনের হেন্ডেল ধরে  উঠতে যাবে এমন সময় একজন মাঝ বয়স্ক লোক সামনে হাত বাড়িয়ে বলেন, না, তোমরা এভাবে পালিয়ে যেতে পারো না। যারা কাপুরুষ তারাই পালিয়ে যায়। সাহসীরা কখনো পালায় না। 

ওরা দু’জন ট্রেনে উঠতে পারে না। এক যুবক রুদ্রের হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিয়ে দূরে সরে দাড়ায়। রুদ্র ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই সেতু বলে উঠে, আব্বু তুমি?

হ্যাঁ আমি। তোরা ভেবেছিলি আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাবি। আমি তা হতে দেব না। 

আচমকা সেতুর বাবার আগমনে রুদ্র বিস্মিত হয়। রুদ্র কখনো সেতু বাবাকে দেখিনি। আজই প্রথম দেখলো। কি ঘটতে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। একটা অজানা ভয়ে দুজনের বুক ধরফর করছে। ট্রেন প্লাটফর্ম অতিক্রম করছে। এর মধ্যে সেতুর মা এসে সামনে দাঁড়ায়। সেতু বলে, মা তুমিও এখানে!

সেতুর মা বলেন, তুই পালিয়ে যাবি আর আমরা ঘরে বসে থাকবো। 

কথার মাঝে রুদ্রের বন্ধু সজল এসে পাশে দাড়ায়।

সেতু আর রুদ্রের বুঝতে বাকি থাকে না, ওদেরকে ধরিয়ে দেয়ার পেছনে সজলের হাত আছে। রাগে দুখে রুদ্রের গা জ্বলতে থাকে। ইচ্ছে হয় সজলের গারে ঠাস করে একটা চড় মারে। যে যুবক ব্যাগ কেড়ে নিয়েছে সে আর কেউ নয়, সেতুর একমাত্র ছোট ভাই রাকিব। রাকিব ওর বাবা মাকে লক্ষ্য করে বলে, আব্বু আম্মু তোমরা যাই বলো, আপুর পছন্দ আছে। দুলাভাই অনেক সুন্দর।  চিত্র জগতের নায়কের মত। 

রাকিবের কথা শুনে সেতু আর রুদ্র কাঁদবে না হাসবে কিছুই বুঝতে পারে না। লাজে দুজনই মাথা নিচু করে ফেলে। পিছন থেকে সেতু বাবা দুজনের কাঁধে হাত রেখে বলেন, ভয়ের কিছু নেই। আমরা তোমাদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছি। তোমরা বাসায় যাবে চলো। 

কথা বলতে বলতে সেতুর বাবা দুজনকে বুকে টেনে নেন। মা এসে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রেখে বলেন, কাল সকালে কাজী ডেকে তোমাদের কাজটা সেড়ে ফেলব।

সজল বলে, দোস্ত আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি শুধু চেষ্টা করেছি আঙ্কেল আন্টিকে বুঝিয়ে তোদেরকে  মিলিয়ে দিতে। আঙ্কেল আন্টি আমার কথা রেখেছে। আমি তো দেখি সুবিধা চাই। তোরা দুজনে একটু হাস তো দেখি। 

মেঘের আরে চাঁদের হাসির মত সেতু আর রুদ্রের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। সেতুর বাবা-মা সস্বরে বলেন, আর দেরি নয় আবার চলো। 

রাকিব রুদ্রের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে সামনে এগোয়। সাথে বাবা-মা ও সজল। রুদ্র সেতুর হাতের আঙুলে আঙুল ঢুকিয়ে ধীর পায়ে এক্সিট গেটের দিকে অগ্রসর হয়। সমান্তরাল রেল লাইনের বুক বিদীর্ণ করে রাতের শেষ ট্রেন রাজশাহী এক্সপ্রেস ছুটে চলে তার গন্তব্যে।

Exit mobile version