ধ্রুব নীলের ফ্যান্টাসি রোমান্টিক উপন্যাস
১
পাশের বাড়ির ছাদে এক রূপবতী হেঁটে বেড়াচ্ছে এবং আমি তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছি। মেয়েটাকে দেখে একবারও মনে হলো না যে আমার স্ত্রী রেশমা এ অবস্থায় আমাকে দেখলে দুচার কথা শুনিয়ে দেবে।
মনে হলো মেয়েটার দিকে এভাবেই তাকিয়ে থাকতে পারবো। অনন্তকাল না হোক, আপাতত অফিস কামাই করা যায়। কারণ ছাদের মেয়েটা অবিকল লুনার মতো।
অবিকল কথাটা বাড়িয়ে বলিনি। চোখ, কান বা নাকে নয় শুধু। যমজদের মতো হুবহু মিল! তবে একটা বড় কিন্তু আছে। যে কিন্তুটার জন্য আমার তাকিয়ে থাকার ধরনটা ছিল হ্যাংলা। মেয়েটা দেখতে অবিকল পনের বছর আগের লুনার মতো। এখনকার লুনার মতো নয়। মানে মেয়েটা যে লুনাই হতে পারে সেটাও সম্ভব নয়। কারণ লুনা মারা গেছে তের বছর আগে। সে ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা।
মহাবিশ্ব মানেই রহস্যের ছড়াছড়ি। ইলেকট্রনের দুই রকম আচরণ, কোয়ান্টাম এনটেঙ্গলমেন্ট, স্পেস-টাইম; এসবের ছিঁটেফোঁটা আমার সাত বছরের দাম্পত্য জীবনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। তারপরও ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা যে লুনা নয়, এটাকে অমীমাংসিত রহস্য বলে মেনে নিতে পারছি না। এর একটা মীমাংসা দরকার।
হাত নাড়ল মেয়েটা। যেন আমাকে চেনে, অনেক দিন ধরে। পনের বছর আগে থেকে চেনার প্রশ্নই আসে না। বয়স কত হবে মেয়েটার? পঁচিশ? আঠাশ? লুনা বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো আটত্রিশ। আমার চেয়ে দুই বছরের বড় ছিল ও।
হাত নাড়ানো থামিয়ে মেয়েটা এবার ছাদে পায়চারি করছে। আমাকে দেখছে না। যেন যা দেখার দেখে নিয়েছে।
লুনার সঙ্গে আমার প্রেমের বয়স পনের দিনের। এরপর কঠিন ছ্যাঁকা। আচমকা একদিন লুনা আর আমাকে চিনতে পারল না।
তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে। দুবার ইন্টার ফেল করার পর লুনা ভর্তি হলো আমার বাড়ির পাশের একটা কলেজে। বাড়ি গিয়েই ছুটে যেতাম তার কাছে। ছ্যাঁকা দেওয়ার প্রথম ও শেষ লক্ষ্মণ হিসেবে লুনা একদিন আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। গটগট করে হেঁটে চলে গেল। সেবারই শেষ দেখা।
মারা যাওয়ার আগে দুয়েকবার কথা হয়েছিল। সেসব টেনে আনবো না এখন। এখন টেনে আনতে হবে ছাদের মেয়েটার কথা। যে আবার আমার দিকে তাকিয়েছে। এবার অন্যদিকে ঘুরে আড়চোখে দেখছে।
ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়াল রেশমা। আমার স্ত্রী। হাতে একগাদা কাপড়। আমি সতর্ক হওয়ারও প্রয়োজন বোধ করলাম না। রেশমা জানতে চাইল, ‘দশটা বাজে। লেট হবে না?’
‘ছুটি নেব আজ।’
‘নেবেই তো। আজ আমার মারিয়ার বাসায় যাওয়ার কথা, আর তুমি বসে থাকবে ঘরে।’
‘আমার কিছু হবে না।’
‘নাও ছুটি। আমার যাওয়ার আমি যাব। ওর বোনের বিয়ে। না করতে পারব না।’
‘অনলাইনে খাবার অর্ডার দেব। রান্না নিয়ে টেনশন করতে হবে না।’
‘টেনশন করার ঠেকা পড়েনি আমার।’
‘একটা লেখা লিখতে হবে। খাওয়ার সময় পাই কিনা তারই ঠিক নাই।’
যথারীতি রেশমা এসব ফালতু ও অপ্রয়োজনীয় কথায় কান দিল না। আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সে চলে গেল বেডরুমে, ড্রেসিং টেবিলের সামনে। যেখানে প্রকাণ্ড একটা আয়না। রেশমা তাতে নিজেকে দেখে? কে জানে।
নিজেকে খুব ভাল দেখতে পেত লুনা। সে কী ব্যক্তিত্ব! ওই কঠিন কঠিন চেহারাই আমাকে প্রেমে পড়তে বাধ্য করেছিল। বেঁচে থাকলে সেও কি এখন রেশমার মতো এখন জাঁদরেল টাইপ শাড়ি পরে বান্ধবীর বোনের বিয়েতে যেত?
এই ফাঁকে আমি আবার বারান্দা থেকে সামনের ছাদ দেখার সুযোগ পেলাম। লুনা নেই। মানে ওই মেয়েটা নেই। আছে আরেকজন। বাচ্চাকে ছাদে ছেড়ে নিজে বসে আছে সিঁড়ির মুখে। এবার আর তাকানোর ইচ্ছে হলো না। লুনার জন্য এতদিন চেপে থাকা হাহাকারওয়ালা স্মৃতিটা গুটিসুটি মেরে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত গুহায় ঢুকে গেল।
একটা কিছু করতে হবে। কী করবো? পাশের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেব? কী জিজ্ঞেস করবো? কাকে করবো? কে আবার কী মনে করে। আমার অত সাহস কোনো কালেই ছিল না। আমি চিকনচাকন চুপচাপ গোছের মানুষ। সাত বছর ধরে বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছে না। আমি সেটা নিয়ে বিচলিত হইনি কোনোদিন। বিচলিত হচ্ছি পাশের বাড়ির মেয়েটা দেখতে অবিকল লুনার মতো কেন, সেটা ভেবে।
এখন বিষয়টা পরিষ্কার যে আমি অপেক্ষা করছি কখন রেশমা বিদেয় হবে। ওর তৈরি হতেই এক ঘণ্টা। কিছু কিছু এক ঘণ্টা মানে একটা করে মহাকাল। সময় কাটাতে আমি প্রথমে অফিসে ফোন করে গলাটা খাদে নামিয়ে বসকে বললাম, ‘ব্যাক পেইনটা বেড়েছে খুব। বিছানা ছাড়তে পারছি না।’
স্কুলে থাকতে যেটা ছিল পেট খারাপ বা জ্বর, অফিসের কালে এসে সেটা হয়ে গেল ব্যাক পেইন কিংবা স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার অজুহাত। অফিস কামাইয়ের এসব কারণ বলতে কোনো এক রহস্যজনক কারণে আমার ও আমার মতো অনেকের ভেতর অপরাধবোধ কাজ করে না।
নিজেকে চাকরিজীবী মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পা দুলিয়ে গোল চত্বর কিংবা কলেজের মাঠে ইংরেজি স্যারের বাসার সামনে ঘুর ঘুর করছি। একটু পর লুনা বের হবে। তাকে দেখব এবং পিছু নেব।
রেশমার সঙ্গে ঝগড়া হলে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। ওই স্মৃতিসংক্রান্ত কোনো একটা রাসায়নিক বিক্রিয়া মগজে গিয়ে এই লুনাকে তৈরি করতে পারে। ছাদের লুনা হয়তো ছাদে নেই। আছে আমার মাথায়।
বিষয়টাকে মিথ্যে প্রমাণ করতেই যেন বেজে উঠল ফোন। অপরিচিত নম্বর। দ্রুত সাইলেন্ট বাটন চেপে দিলাম। রেশমা যথারীতি জানতে চাইল না কে ফোন দিল। আমি-ই বা কী মনে করে ফোন সাইলেন্ট করলাম জানি না।
ফোন হাতে ধীর পায়ে বারান্দায় গিয়েই চমকে ওঠার অভিনয় করলাম। অভিনয় বললাম কারণ, আমার মন যা বলছিল সেটাই ঘটেছে। চমকে ওঠার কারণ নেই। ছাদে মেয়েটা আবার এসেছে। তার হাতেও ফোন। কানে চেপে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সবুজ বাটন চেপে কানে ধরলাম ফোনটা।
২
‘আপদ বিদেয় হলো?’
‘না বিদেয় হয়নি। আপদ শাড়ি বদলাচ্ছে। এরপর আরো বহু কিছু বাকি। ঘণ্টাখানেকের মামলা।’
আমি অবাক হওয়ার গুণ হারিয়ে ফেলিনি। অভিনয় করছি কেবল। বুঝতে পেরেছি মোবাইলের খুদে স্পিকারে ভেসে আসা জাদুর মতো কথাগুলো আমাকে কব্জা করে ফেলছে। আমিও তার কব্জায় নিজেকে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমি চাই সে আমাকে আরো জোরে সোরে কব্জা করুক।
‘কেমন আছো?’
‘এই তো। তুমি?’
‘দেখছো না? দেখে কী মনে হচ্ছে?’
‘হুম।’
‘হুম আবার কী? বিয়ে করেছো, সংসার করছো। ভালোই তো থাকার কথা।’
‘তা হলে মনে হয় ভালোই আছি।’
‘লুনার কথা মনে আছে?’
‘কী আশ্চর্য, কেন থাকবে না!’
‘উঁহু। অনেক অনেক দিন আগের কথা তো। সে তো মরে গেছে, তাই না?’
আমার ভেতরটা খালি খালি লাগল আবার। মেয়েটার মুখে এ কথা আশা করিনি।
তার চোখজোড়া পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। চোখের কালো মণি দুটো টলটল করছে। তবে আমি নিশ্চিত ওটা কান্না নয়। লুনার চোখ এমনই। আরো অবাক করা ঘটনা, ওর চোখে আমি আমার প্রতিফলন দেখতে পেলাম। ছোটবেলায় খেলাটা খেলে সবাই, চোখে চোখ রেখে বলে তোমার চোখে আমাকে দেখা যায়!
লাইনটা কেটে গেল। ফোনটার দিকে তাকালাম। দুই কি তিন সেকেন্ড হবে। মাথা ওঠাতেই দেখি মেয়েটা নেই।
‘কার সঙ্গে কথা বলছো? তোমার এমন হাসি হাসি চেহারা তো চৌদ্দ বছরে দেখি নাই।’
ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে কানে দুল পরতে পরতে বলল রেশমা।
‘বিয়ে হলো সাত বছর। তার আগে এক বছরের সম্পর্ক। চৌদ্দ পেলে কোথায়?’
‘সাতে পাঁচে পনের বুঝিও না। তোমার চেহারায় জেল্ল¬া মারছে।’
‘আমার এক মেয়ে বন্ধু ফোন দিয়েছিল। খুব সুন্দরী। তার সঙ্গে চক্কর চলছে।’
‘আমার মতো বেকুব মেয়ে আরো আছে? শোনো, আমি চললাম। আজ ফিরবো না, সেটা তো বলেছিই। রাতে মদ গাঁজা সিগারেট যা মন চায় খেও।’
‘জ্বি খাবো।’
‘জ্বি জ্বি করছো কেন? আমি তোমার বড় আপা না। তোমার বউ।’
রেশমা বের হতেই ছাদের দিকে তাকিয়ে আছি নিষ্পলক। শূন্য ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে সমস্যা নেই। রূপবতী নারী থাকলেই সমস্যা।
রেশমার মনটা দিন দিন খোলা বইয়ের মতো হয়ে যাচ্ছে। সব পড়া যায়। সমস্যা হলো পড়ার মতো বস্তু দিন দিন কমে যাচ্ছে। আবার এমন হতে পারে, পড়ার মতো নতুন একটা বই পেয়েছি আমি এবং নিশ্চিত হয়ে গেছি, রেশমা দরজা খুলে চলে যাওয়া মাত্রই মেয়েটা আবার আসবে ছাদে।
মেয়েটা এলো না। রেশমা চলে যাওয়ার পরও প্রায় আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। আধা ঘণ্টা কম কথা না। কোথাও ভুল টুল হচ্ছে কিনা সেটা ভাবতে ভাবতে ভেতরে গেলাম। বেডরুমে গিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে রইলাম। ফ্রিজ খুলে ঠাণ্ডা পানিও খেলাম। অফিস নেই। কী করবো বুঝতে পারছি না। মুভি দেখবো নাকি একটা। নাহ মন বসবে না। আবার বারান্দায় দাঁড়ালাম। এবার ছাদটাকে মনে হলো আগের চেয়েও খালি। ধু ধু করছে যেন। আশপাশে কম করে হলেও শ খানেক বাড়িঘর। এত ধু ধু মনে হওয়ার কারণ নেই।
‘অ্যাই শুনছো?’
পরিষ্কার ডাকটা এলো বেডরুম থেকে। ভয় পেয়ে গেলাম। কণ্ঠটার মতো ভয়টা পরিচিত। ছোট থাকতে একবার ভূত দেখেছিলাম। কোনো দৈত্য বা অশরীরি প্রেতাত্মা নয়। চোখের সামনে কেবল পানি খাওয়ার জগটা শূন্যে উঠে গিয়েছিল আর গ্লাসে পানি ভরে কেউ তাতে চুমুক দিয়েছিল। আমি চিৎকার করতেই গ্লাস নিচে পড়ে চৌচির। এটুকুই। দৃশ্যটা দেখে এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে, আমার মস্তিষ্ক সেটাকে আমার নিজের কাজ বলে চালিয়ে দিল। সবার সঙ্গে সঙ্গে আমিও বিশ্বাস করে ফেলি যে আমি নিজেই জগ হাতে নিয়ে পানি ঢেলেছিলাম গ্লাসে। বেডরুম থেকে শব্দটা পেয়ে আমার পুরনো সেই অনুভূতিটা হলো।
‘ভয় পাবে না। তোমার দরজা খোলা ছিল। ঢুকে পড়েছি। আবার লাগিয়েও দিয়েছি। হুট করে কেউ ঢুকবে না।’
চিন্তার হাজারটা কারণ থাকা সত্ত্বেও হাঁফ ছাড়লাম। অতিপ্রাকৃত ভয়টা কেটে গেল। রেশমা চলে যাওয়ার পর দরজাটা নিজের হাতে লাগিয়েছিলাম কিনা সেটা আপাতত ভাবতে গেলাম না। একটা যুক্তি তো পাওয়া গেল। মানুষ যুক্তি ভালোবাসে।
তবে অনুভূতিটা দ্রুত বদলে যেতে শুরুর করলো। বাঘা সাহিত্যিক হলে কঠিন বর্ণনা দিতেন। আমি টুকটাক গল্প লিখি। মনে হলো আমার এই মুহূর্তের অনুভূতিটা কেমন সেটা কাউকে বোঝাতে যাওয়াটা বোকামিই হবে।
বেডরুমের কাছে আসতেই একটা টান অনুভব করলাম। প্রচণ্ড সে টান উপেক্ষা করার মতো নয়। আমাদের পৃথিবীটা মাধ্যাকর্ষণ টানটা কেমন অনুভব করে কে জানে। এমনই হয়তো। বেডরুম যেন একটা প্রাণী। আমাকে জালে ধরেছে। এখন ধীরে ধীরে টেনে তুলছে। যতই উঠছি ততই দম আটকে আসছে।
তার চোখে চোখ পড়তেই সব ঠিক, সব স্থির। একদম সাধারণ ঘটনা যেন। আবার সেই পরিচিত হাসি। হাসি বললে ভুল হবে। লুনার মতো দেখতে মেয়েটা সম্মোহন বিদ্যা জানে নাকি?
‘এদিকে আসো!’
এ ডাক উপেক্ষা করার মতো নয়। পনের বছর আগে যখন প্রেমটা হয়েই গেল, তখনও কোনোদিন লুনার গলায় এমন আবেদন শুনিনি। এ তবে সম্মোহনেরই খেল।
‘বুঝতে পারছি তুমি ভয়ে মরে যাচ্ছো। কাছে এসে বসো। আমি ভূত, লুনার ভূত। ভয় নেই, কামড় দেব না।’
‘ভয় পাইনি তো।’ আমি হাসলাম।
মেয়েটার কাছে এসে বসলাম। একটা বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে পুরো বিষয়টা আমার হেলুসিনেশন। হেলুসিনেশন জিনিসটা হয়তো এমনই। বাস্তবের মতো মনে হয়। তা না হলে সিজোফ্রেনিয়া রোগটা নিয়ে দুনিয়ায় এত মাতামাতি হতো না। আমার মন যা চাইবে, এখন সেটাই ঘটবে। মেয়েটা খাটে পা দোলাচ্ছে। মোনালিসা টাইপের হাসি লাগানো মুখটা ঘুরিয়ে রেখেছে অন্যদিকে।
‘আমি কৃ। লুনার ভূত না। ওর রূপ নিয়ে এসেছি। আমরা রূপ বদলাতে পারি।’
‘কৃ? শুধু কৃ? নামের আগেপিছে কিছু নেই?’
‘তুমি মানুষ, আমি কৃ। এটা আমার নাম না। আমার নাম তুমি উচ্চারণই করতে পারবে না।’
‘ও। জ্বিন ভূত টাইপ কিছু না?’
‘বললাম তো আমি কৃ। কোন টাইপের সেটা জানি না। আর তুমি যেটা ভাবছো মোটেও আমি সেরকম কিছু না। পরীটরি কোনোদিন দেখিনি। আর কারোর ওপর ভর কীভাবে করতে হয় সেটা জানা নেই। তুমি চাইলে তোমার কাঁধে চড়ে বসতে পারি। হি হি হি হি।’
আপাতত আর অবাক হবো না। এমন অদ্ভুত কিংবা ভয়ানক পরিস্থিতিতে পড়লে কী প্রতিক্রিয়া দেখাতে হয় সেটা আগেভাগে বলা মুশকিল। কেউ যদি দেখে তার সামনে একটা পানির জগ শূন্যে ভেসে উঠলো, তা হলে কী করবে মানুষটা? এর উত্তর যেমন জানা নেই, তেমনি আমিও জানি না যে আমার কেমন লাগছে বা লাগা উচিৎ। শুধু হলফ করে বলতে পারি যে, আমার একটুও ভয় লাগছে না।
‘কৃ তুমি কিছু খাবে?’
‘ফ্রিজে ঠাণ্ডা পানি আছে?’
‘হুম।’
‘হুম হুম করলে তো হবে না। যাও নিয়ে আসো।’
আমি পানি আনতে গেলাম। সম্মোহিতের মতো নয়, একদম স্বাভাবিকভাবে উঠে গেলাম। গ্ল¬াসে পানি ভরে দরজার কাছে আসতেই ঘটনাটা ঘটল। এক লাফে বিছানা থেকে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলো কৃ। ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরলো। আমার হাতে পানির গ্ল¬াস। শক্ত করে চেপে ধরে আছি ওটা। আরেকটু হলে হাতের চাপেই ভেঙে যাবে।
কী করা উচিৎ বুঝতে পারছি না। ভাবছিও না। কৃ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিটা মানবীর নয়। অতিমানবীয়? হবে হয়তো। তার চোখে স্পষ্ট বোকা বোকা চেহারার নিজেকে দেখতে পাচ্ছি। মনে মনে সায়েরি লেখার অভ্যাসটা মাথায় ঝনঝনিয়ে উঠল আবার, ‘আয়না তো বাজারেই পাবে। তোমার চোখে আমার প্রতিবিম্ব কী হবে এমন জলের মতো?’
কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল জানি না, কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম, পানি? কৃ আমার কানের কাছে ফিসফিস করে কী যেন বলল। একবর্ণ মাথায় ঢুকল না। ততক্ষণে চোখ বুঁজে এসেছে। আমি যেন চাইছি কৃ আমাকে আরো শক্ত করে ধরে রাখুক। কৃ মনের কথা বুঝতে পারে। এটা জানা হয়েছে এতক্ষণে।
‘চোখ খুলবে না!’
মনে মনে বললাম, প্রশ্নই আসে না। এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো গোটা কয়েক ঘণ্টা।
‘গ্ল¬াসটা রাখো।’
আমার হাতের ডানেই একটা টুল। গ্লাসটা রাখতেই বিপদে পড়ে গেলাম। হাত দুটো ঝপ করে নিচে ফেলে দেব নাকি আমিও কৃকে জড়িয়ে ধরবো?
‘প্লিজ!’
আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম কৃকে। এরপর যা ঘটল তার জন্য তৈরি ছিলাম না। মনে হলো কৃর ভেতর থেকে একটা শিহরণ আমার মধ্যে ঢুকে পড়ছে। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক একটা আবেশের সঙ্গে তুলনা করা যায়। আমার মুখের বাম পাশে কৃ তার গালটা চেপে ধরে রাখল। প্রিয় কাউকে জড়িয়ে ধরলে যে অনুভূতিটা হওয়ার কথা কৃ যেন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ঢেলে দিচ্ছে আমার ভেতর। অনুভূতিগুলো কণার মতো। বরফের তীক্ষ্ম ফলার মতো শরীর ভেদ করে সোজা চলে যাচ্ছে মগজে। নিউরনে নিউরনে ঝলকানি শুরু হয়ে গেল। থেমে গেল সময়টাও। সময় মানে যে সেকেন্ডের টিক টিক নয়, সেটাও বুঝতে পারলাম। এটা কৃর একটা ক্ষমতা? সময় আটকে দেওয়া?
‘উমম।’ একটা আলস্য ভরা শব্দ করে আচমকা আমাকে ছেড়ে দিল কৃ।
স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানির গ্লাসটা আবার বাড়িয়ে ধরলাম কৃর দিকে। গ্লাসের গায়ে কুয়াশার মতো পানি জমলো না। তার মানে ঘড়ির হিসেবে সময় বেশি যায়নি। ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে পানিটা খেল মেয়েটা। নাহ, কোনো অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ল না কৃর পানি পানের দৃশ্যে।
গ্লাসটা টুলে রেখে বিছানায় ফের ধপ করে বসল।
‘তুমি একটা গাধা।’
‘হুম।’
‘তুমি আমাকে সত্যি ভূত-পেত্নী ধরে নিয়েছো।’
‘হতেও পারো।’
‘এমনও হতে পারে আমি পাশের বাড়ির সাহসী কোনো তরুণী। যে তোমাকে দেখেই প্রেমে পড়ে গেছে এবং যে পাড়ার মোবাইল রিচার্জের দোকান থেকে তোমার নাম্বার কালেক্ট করেছে। তারপর তোমার বউকে বের হয়ে যেতে দেখে… আরো ব্যাখ্যা লাগবে?’
‘কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি দরজাটা লাগিয়েছিলাম। আর দরজাটা ছিটকিনিওয়ালা। নকল চাবি বানানোর সুযোগ নেই। তা ছাড়া লুনার কথা তোমার জানার কথা না।’
মেয়েটা মাথা নিচু করে আছে। ধরা পড়ে যাওয়ার দুষ্টুমি হাসি মুখে। আমার চোখে সেই হাসিতে কোনো কৃত্রিমতা ধরা পড়ল না। মেয়েটা সত্যিই অন্যকিছু। মজা করে মিথ্যে বলছে।
‘তোমাকে কৃ বলেই ডাকবো?’
‘যা ইচ্ছে ডাকতে পারো।’
‘তুমিই কি সেই ছিলে?’
‘মানে?’
‘না থাক, কিছু না। অনেক আগে একবার একটা পানির জগ…।’
‘আমি তোমার প্রেমে পড়েছি বছরখানেক হলো। এর আগে তোমাকে চেনার প্রশ্নই আসে না।’
‘মাই গড। ফলো করেছো এতদিন? এখন তবে আর ফলো করবে না?’
‘উফফ বড্ড বকবক করো। বলো কী খাবে?’
আমি টুল টেনে বসলাম। ইচ্ছে হচ্ছে তার গা ঘেঁষেই বসি। তবু বসলাম না। কিছু ইচ্ছে পূরণ না হলেই আনন্দ।
‘তোমার কী কী ক্ষমতা আছে? যা ইচ্ছে খাবার এনে দিতে পারো?’
‘এবার মনে হচ্ছে সত্যিই তোমার ঘাড় মটকে দেই! আমি চাইনিজ খাব। অনলাইনে অর্ডার করবো। তুমি কী খাবে বলো?’
‘আমি নাশতা করেছি একটু আগে। জুস কফি একটা কিছু খেতে পারি।’
মনের ভাবনাটা তাড়ানোর চেষ্টা করছি। যত চেষ্টা করছি ততই যেন ধরা পড়ে যাচ্ছি কৃর কাছে। আর কৃ ততটাই কৃত্রিম রাগ নিয়ে কটমট করে তাকাচ্ছে আমার দিকে। ভাবছিলাম কৃরা আবার কী খায় না খায়, মানুষের রক্ত, বাদুড়ের হাড়, কাকের হৃৎপিণ্ড…।
‘খবরদার!’
‘না মানে, হে হে অনলাইনে পাওয়া যায় কিনা ট্রাই করে দেখতে পারো।’
কৃত্রিম রাগ ঝেড়ে এবার খাটে দুই পা তুলে বসলো কৃ। একটু আগে কী পরেছিল সেটা মনে পড়লো না। কিন্তু এখন আকাশী নীল রঙের শাড়ি আর কালো ব্লাউজ। আবারো বিভ্রান্ত হলাম। মনে মনে এভাবেই কল্পনা করতাম লুনাকে। যদিও ওকে কোনোদিন সেটা বলা হয়নি।
‘শোনো এত ঘন ঘন বিভ্রান্তিতে পড়ার কিছু নেই। তুমি আমাকে যা খুশি ভাবতে পারো। আমি যাচ্ছি না। এমনকি তোমার বউ এলেও না!’
‘তোমাকে যেতে বললাম কখন? আর আমারও খিদে লেগেছে।’
‘একে বলে মনের খিদে। আমাকে খেতে দেখবে তো, তাই।’
কথাটা কৃ বলল ভ্রƒ নাচিয়ে। আহ্লাদের বাড়াবাড়ি নেই সেই চোখে।
আচমকা লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়ল কৃ। থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। জোরেসোরে হেসে উঠল মেয়েটা। পাশের ফ্ল্যাটের কেউ শুনে ফেলবে না তো? ওহ, কী সব ফালতু টেনশন!
হাসিতে দুলে উঠল কৃর লম্বা ঘন চুল। একটু আগেও কি তা-ই ছিল? মনে পড়ছে না। কিছুই মনে পড়ছে না। আমি যেন পৃথিবীর সবচেয়ে আত্মভোলা মানুষ। তারপর ঠিক যেমনটা চেয়েছিলাম, কৃ আবার আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আগের মতো ঘাড় পেঁচিয়ে নয়। সরাসরি আলিঙ্গন যাকে বলে। বুকে মাথা চেপে ধরলো। হালকা আমেজের বৈদ্যুতিক প্রবাহটা আবারো আমাকে ঘিরে ফেলল। শরীর ভেদ করে ঢুকতে শুরু করেছে লক্ষ কোটি কণা। আমি মিশে যেতে থাকলাম একটা অতিকায় অনুভূতির সমুদ্রে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাথাটা নামিয়ে নাকটা বসিয়ে দিলাম কৃর কাঁধে। মনে হলো মিষ্টি অচেনা নতুন একটা ঘ্রাণ আবিষ্কার করলাম এই মাত্র। ক্রমে শক্ত হচ্ছে কৃর বাঁধন। আমারও। সময় কি থেমে গেল? সামনেই দেয়ালঘড়ি। তাকাতে ইচ্ছে করলো না। চুলোয় যাক সময়।
মাথাটা খানিকটা সরালো কৃ। আলিঙ্গনে ঢিল পড়ল। এবার নাক চেপে আছে আমার বুকে। আমি আড়চোখে তাকালাম। কৃর চোখ বন্ধ। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। আমার কী করা উচিত? কৃর চিবুকে হাত রেখে উপরে তুলে চুমু খাওয়া? লুনাকে কোনোদিন বলা হয়নি এমন ইচ্ছের কথা। চোখ বন্ধ হলেও কৃর চোখে স্পষ্ট ব্যথা। লুনার কথা ভেবেছি বলে? নিজেকে অপরাধী মনে হলো।
বদলে যেতে লাগল তার চেহারা। মনে হলো ছাড়িয়ে গেল লুনাকেও। নিখুঁত সেই চিবুক, নাক আর ভ্রƒ আরো নিখুঁত হলো যেন। কৃ নিশ্চয়ই আমার মাথার ভেতর তৈরি করা লুনার রূপবতী চেহারাটা কপি করছে!
ধীরে ধীরে মুখ তুলল। চোখ বোঁজা নেই। পুরোপুরি খোলা। গভীর দৃষ্টিতে আমাকে পড়তে শুরু করেছে। আগাগোড়া পড়া শেষ নিমিষেই। আমি এখন পুরোপুরি উন্মুক্ত তার কাছে। কোনো লজ্জা নেই। বিকার নেই। আমার মনের আনাচে কানাচে যত বিচিত্র চাওয়া, ভয়, ফোবিয়া, স্বপ্ন সব জানা হয়ে গেল কৃর। কৃ-ই এখন আমার একমাত্র প্রেমিকা।
তারপর বোকা বোকা আমি নামিয়ে দিতে লাগলাম আমার ঠোঁট। আমার আগেই খপ করে সেটা নিজের করে নিল কৃ।
কতক্ষণ জানি না। হতে পারে এক মুহূর্ত কিংবা এক ঘণ্টা। কলিং বেলটা বেজে উঠতেই চমকে উঠলাম ফের। এতক্ষণ ভয় পাওয়ার অনেক কারণ থাকলেও পাইনি। এখন ভয়ে রীতিমতো অস্থির হয়ে গেলাম। কে হতে পারে! কারোরই আসার কথা নয় এই ভরদুপুরে।
৩
আমাকে ছেড়ে বিছানার এক প্রান্তে বসে পা দোলাতে শুরু করলো কৃ। একটা কথাও বলছে না। বোঝাতে চাইছে, তোমার সমস্যা তুমি সামলাও।
আমি সমস্যা সামলাতে দরজার ছোট্ট ফুটোয় উঁকি দিলাম। স্থবির হয়ে গেল পুরো শরীর।
‘দেখেছো তো, এবার খোলো! আমি তো চোর-ডাকাত না। তোমার বউ রেশমা।’
কী-হোলে চোখ রাখলে ওপাশ থেকে বোঝা যায়। সুতরাং দেরি করলেই ঝামেলা। আমার মগজটা নিজের মতো করে ব্যাখ্যা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। কৃ নামের একটা মেয়ে বিপদে পড়ে আশ্রয় নিয়েছে। কয়েকজন লোক তার পিছু নিয়েছিল। পরে আমাদের বাসায় আশ্রয়…।
‘সব রাস্তা বন্ধ। একটা মাছি ঢোকারও জায়গা নাই। আধা ঘণ্টা গরমের মধ্যে বসা। পরে শুনি গাড়ি আর যাবে না।’
হড়বড় করে কথা বলতে বলতে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেল রেশমা। পানি খেলো। আমি বোবার মতো তাকিয়ে আছি। এখুনি বেডরুমে ঢুকবে রেশমা। কৃ কি তার কোনো ক্ষমতা কাজে লাগাবে?
রেশমা বেডরুমে ঢুকতেই আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড করে সময় দেখছি। সময় আসলে দেখা যায় না। অনুভবও করা যায় না। সময়কে বুঝতে না পেরেই মনে হয় মানুষ ঘড়ি আবিষ্কার করেছে। না হয় বড় গণ্ডগোল লেগে যেত।
রেশমা বের হলো দশ মিনিট পর। সাজগোজ করতে যত দেরি হয়, তার ঠিক উল্টোটা ঘটে সাজ ছাড়ার সময়। আজ আর সেসব নিয়ে মাথা ঘামালাম না। পিঠ বেয়ে চিড়চিড় করে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল।
‘কই, তোমার অনলাইন অর্ডার করলে না? রান্না তো করিনি।’
আমার কিছু বলার আগেই কলিং বেল বেজে উঠল। এবার উঁকি দিল রেশমা। ‘ওহ’ বলে আমার দিকে তাকাল।
‘তোমার অর্ডার এসেছে।’
আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে।
‘কী অর্ডার করেছো? যাও নিয়ে আসো।’
‘মনে হয় চাইনিজ খাবার। দেখি।’
খাবারের প্যাকেট দেখে বিভ্রান্তির মাত্রা বেড়ে গেল। চাইনিজ খাবার আসেনি। এসেছে দুই প্যাকেট বিরিয়ানি। রেশমার প্রিয় খাবার!
শোবার ঘরে ঢুকলাম। কৃ নেই। হতাশ হলাম খানিকটা। ভাবলাম তাকে জিজ্ঞেস করবো এসবের মানে কী। সে কি জানতো রেশমা ফিরে আসবে? আমাকে ভয় দেখাতে সে বাসায় এসেছিল? অদ্ভুত এক হাঁফ ছাড়া ও অসহায় অনুভূতি ছেঁকে ধরতে শুরু করেছে।
আমার পাশে বসলো রেশমা। প্যাকেট খুলে খাওয়া শুরু করেছে। আমাকেও সাধলো। একটা প্যাকেট হাতে নিলাম। প্যাকেট হাতে নিয়ে বসে আছি।
রাত আটটা পর্যন্ত ঘুমিয়েই কাটিয়েছি। রেশমা রান্নাঘরে। বিকেলে ঘুম গাঢ় হলে মন খারাপ থাকে খুব। আমার মন একটু বেশিই খারাপ হলো। আমার পরিবারে বলতে গেলে কেউ নেই। শৈশব তারুণ্যের সব ঘটনা যেন অতীতের চেয়েও দূরে সরে গেছে। কৃ কি পারবে আমার সব ফিরিয়ে আনতে? নাকি সে শুধু আমার ফেলে আসা প্রেমটাই দিয়ে গেল এক ঝলক।
‘ডাটা দিয়ে চিংড়ি করলাম। আজ আর কিছু পারবো না।’
‘আমি পরে খাবো। তুমি খেয়ে নাও।’
‘আমি খাব না। বিরিয়ানি খেয়ে গ্যাস বেড়েছে মনে হচ্ছে। তুমি খাওয়া শেষে দয়া করে একটু গুছিয়ে রেখো। আমার আর শরীর চলছে না। পারলে মশারিটা টাঙিয়ে দাও।’
আমি মশারিটা টাঙিয়ে দিলাম। মন বিষণ্ন থাকলে কোনো একটা কাজ করলে সেটা কমে। আমি মশারি টাঙিয়ে মন ভালো করার চেষ্টা করলাম। অথবা আমার মনের কোণে ঘাপটি মেরে থাকা ইচ্ছেটা হলো, রেশমা যেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত এগারোটা পর্যন্ত টানা লিখে গেলাম। মিসড কল পেয়েই ছুটে গেলাম বারান্দায়। ছাদে অন্ধকার। অর্ধেক চাঁদের আলো। কাউকে দেখলাম না।
‘আমি এখানে।’
কেঁপে উঠলাম ভয়ে। লজ্জাও পেলাম। বারান্দাতেই এক কোণে চেয়ারে বসে আছে কৃ। পরনে আগের নীল শাড়িটাই।
‘ওহ।’
কৃর চেহারায় অভিমান।
‘খুব তো সময় কাটালে। বিরিয়ানিও খেলে, আবার ডাটা-চিংড়ির ঝোলও। ঘুমিয়েছো নাক ডেকে।’
আবারো অপরাধবোধ ছেঁকে ধরলো আমাকে। এবার আর অত চিন্তা করলাম না। কৃর পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়লাম। ওর হাত ধরতে ইচ্ছে হলো। দমিয়ে রাখলাম ইচ্ছেটা। ও বুঝুক। আমিও কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু কৃকে দেখে মনে হচ্ছে না..।
‘আমি জানি তুমি স্বার্থপর নও। তোমার সবই জানি। তবে আর জানবো না। সব জেনে ফেললে কোনো মজা নেই।’
কথা ঠিক। সব জানা হয়ে গেলে রহস্য কোথায়।
‘কৃ তুমি ভাত খাবে? নিয়ে আসি?’
‘যাও নিয়ে আসো। কিছু বলে দেব না তোমাকে। দেখি তুমি কী করো।’
আমার মাথার ভেতর ঢুকে আর বলে দিতে হলো না। আমি জানি কৃ কী চায়। ভাত আর ডাটা-চিংড়ির তরকারি নিয়ে এলাম। ওভেনে গরমও করে নিলাম। তারপর বারান্দায় এসে হাত বাড়িয়ে ধরলাম কৃর মুখে। আমার হাতেই খেল পুরোটা।
‘তোমার বউ তো ভালোই রান্না করে।’
‘হুম। সব পারে ও। আরেকদিন চাইনিজ করতে বলবো।’
‘তুমি তো দেখছি মানুষ ভালো না। বউ রান্না করে দেবে, আর সেটা প্রেমিকাকে খাওয়াবে?’
‘আমার বউ আমার প্রেমিকা কে বলল। সে আমাকে সহ্যই করতে পারে না।’
‘কারণ সে জানে তুমি তাকে ভালোটালো বাসো না।’
‘হতে পারে।’
‘এসব হতে পারে টতে পারে বললে তো হবে না। এটাই সত্যি।’
‘আর কী কী সত্যি জানো তুমি?’
‘খুব বেশি জানি না। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে বছরখানেক হলো।’
‘কেন? তুমি তো কৃ। আমাকে ভালো…।’
ধপ করে জ্বলে উঠল যেন চোখজোড়া।
‘ওটা আমার ইচ্ছে! আমি তোমাকে ভালোবাসবো, তাতে তোমার কী! এর সঙ্গে তোমার বিয়ে করাকরিরও সম্পর্ক নেই! তবে তোমার বিয়ে করাটা ঠিক হয়নি।’
‘কে জানে, ভুল তো মানুষই করে। কৃরা ভুল করে না?’
‘নাহ, অত ভুলশুদ্ধ বিচার করার সময় নেই আমার।’
এবার মনে হলো একটুখানি হাসতে দেখলাম কৃকে। চাঁদের আলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে তার মুখ থেকে ঠিকরে আসা আলো। তবে দৃষ্টিটা আবার আকাশের দিকে ফিরিয়ে নিতেই মনে হলো কোথায় যেন হারিয়ে যেতে লাগল কাজলচোখের মেয়েটা।
‘আমাকে নিয়ে তোমার সংসার করতে ইচ্ছে করছে না?’
‘করছে এখন। পরে নাও করতে পারে।’
‘চলো শুরু করে দেই। বউকে জানাও। ওকে শুধু শুধু আটকে রাখার দরকার কী।’
আমিও কৃর মতো আকাশে তাকিয়ে একটা কিছু খোঁজার চেষ্টা করছি। উত্তর দিলাম না।
‘নাহ, তোমাকে ভয় দেখানো কঠিন। তুমি মোটেও সাধাসিধে না। মগজে মগজে শয়তানি।’
‘তুমি তো আমার মগজ পড়ে ফেলেছো। কিছু বাকি নাই।’
এবার কৃ মুখে কিছু বলল না। হাসল। অদ্ভুত মায়াময় সেই হাসি। আমি আকাশ থেকে চোখ ফেরাতে বাধ্য হলাম।
কৃ আবার তাকাল আমার চোখে। টলটলে চোখ। সেই ভয়ানক আটকে ফেলার মতো দৃষ্টি। আমার ভেতর জেদ চেপে গেল। ধরা দেব না ঠিক করলাম। লুকোচুরি খেলতে শুরু করে দিল মনটা।
কৃ নাছোড়বান্দা। চ্যালেঞ্জ পেতেই তার চোখজোড়া ঝিলিক দিয়ে উঠল। রহস্যময় হাসিটা হয়ে গেল দুষ্টুমি হাসি। তারপর পা গুটিয়ে আমার দিয়ে ঝুঁকে এসে তাকাল চোখের ভেতরে। কখনো কোনো মাদক টানেনি আমাকে। তবে পরিষ্কার বুঝতে পারছি মাদকাসক্তের মগজের দখল কিভাবে চলে যায় মাদকের হাতে, ধীরে ধীরে। আমার আসক্তি বাড়ছে হু হু করে। আমি আমার ভেতর নেই আর। আমার কিংবা কৃর ঠোঁট, যেকোনো একটা এগিয়ে আসতে শুরু করলো আরেকটির দিকে। চুমু খাওয়ার সময়ই কৃ ফিসফিস করে কী যেন বলল। ওর নিজের ভাষায়। শুনতে মন্ত্রের মতো মনে হলো। এরপর পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘চলো উড়ে যাই।’
‘চলো!’
এরপর যা ঘটল তা অদ্ভুত ঘটনার সীমা ছাড়িয়ে গেল। আমি ধীরে ধীরে ডুবে যেতে লাগলাম কৃর মাঝে। কৃ তার বাঁধন আরো শক্ত করলো। বারান্দার গ্রিল গলে বেরিয়ে গেলাম দুজন। শূন্যে ভাসছি আমি!
৪
আমার বাসাটা পাঁচ তলায়। বারান্দা ছাড়িয়ে যেতেই কলজেটা ছ্যাঁৎ করে উঠল ক্ষণিকের জন্য। এক-দুই তলা হলে এতটা ভয় পেতাম না। আঁকড়ে ধরলাম কৃকে। কানের কাছে মৃদু হাসির শব্দ।
‘আস্তে! হাড় ভাঙবে!’
আমি জানি কৃ ব্যথা পায়নি। আমাকে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করলো কেবল। কিছু সময় লাগল ধাতস্ত হতে। ধীরে ধীরে চোখ মেললাম। পায়ের নিচে অপরিচিত শহর। ছাদের পর ছাদ। জনমানবশূন্য। সব দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। প্রচণ্ড বাতাস। কৃর চুল এসে বাড়ি খাচ্ছে আমার মুখে। আমার প্রচণ্ড ভয় পাওয়া উচিত। কিছুটা পাচ্ছিও। তবে কৃর ভেতর থেকে ছুটে আসা অনুভূতির কণাগুলো দলা পাকিয়ে আমার ভয়টাকে সরিয়ে দিচ্ছে।
‘ভয় পাচ্ছো? আবার নামিয়ে দিয়ে আসবো? বউয়ের পাশে গিয়ে ঘুমাবে?’
বিদ্রুপ গায়ে মাখলাম না। ভ্রƒ কুঁচকে তাকালাম কৃর দিকে। তারপর চিৎকার করে বললাম, ‘প্রশ্নই আসে না! আরো উপরে নিয়ে চল, শহর ছেড়ে বাইরে নিয়ে যাও। তোমার সঙ্গে মধ্যরাতে নদী দেখবো!’
ঠিকরে উঠল কৃর চোখ। যেন এমন কিছুই শোনার অপেক্ষাতেই ছিল। ওর বুকে মাথা গুঁজে দিতেই আবার পেঁজা তুলোর মতো হয়ে গেলাম। ঘুম জড়িয়ে আসলো চোখে।
ঘুমের ভেতরেই টের পাচ্ছি সব। কখনো মাটি ঘেঁষে, কখনো অনেক উঁচুতে। শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস প্রতিবাদ জানাচ্ছে কানে। কিন্তু কে শোনে ওই দুর্বল বাতাসের কথা!
ঘুম ভাঙতেই টের পেলাম শরীরের নিচে ঘাস। শার্টটা ভিজে গেছে শিশিরে। আশপাশে কোনো শব্দ নেই। প্রকৃতির একটা রহস্য বুঝি জেনে গেলাম। গভীর রাতে সে নিজেও মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে।
‘কতদূর এলাম?
‘উঠলে?’
‘হুঁ?’
নাহ স্বপ্ন নয়। ওই তো কৃ।
‘কয়টা বাজে?’
‘শূন্যটা বাজে! ঘড়িই সব কিছু! এত কষ্ট করে নিয়ে আসলাম, এখন উনার টাইম জানার দরকার!’
‘কোথায় আমরা?’
‘আমার মাথায়!’
কৃর নকল রাগ পাত্তা দিলাম না। হাতঘড়িতে চোখ গেল অভ্যাসবশত। রাত দুইটা। চোখ ডলে উঠে বসে চারপাশে তাকালাম। ঘুম আধাআধি হয়েছে। এখনো রেশ কাটেনি। কৃর চোখে ঘুম নেই।
‘না! আমরা ঘুমাই না! আমরা বাতাসে ভেসে বেড়াই! আর বাদুড়ের হাড্ডি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করি! এবার হলো!’
আহত দৃষ্টিতে তাকালাম। মনের কথা পড়ে ফেলাটা দেখলাম বড়ই ঝামেলার। আমার তরল দৃষ্টি সহজে তাকে কাবু করতে পারবে বলে মনে হলো না।
‘আর যাই করো, আমাকে এই অচেনা বিলের পাড়ে রেখে চলে যেও না আবার। কাল সকালে অফিস।’
‘তোমাকে আমি দিনের বেলায় অফিসে রেখে আসবো! একদম যেভাবে তুলে এনেছি, সেভাবে! সবার সামনে।’
‘ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যাবে। আমেরিকা থেকে লোক আসবে তোমাকে ধরে নিতে। বলবে, তুমি হলে সুপারম্যানের বোন সুপারগার্ল। আর সুপারগার্ল হলো আমেরিকান নাগরিক।’
‘চলে যাব আমেরিকায়! তোমার কী!’
নদী থেকে আসা ঠাণ্ডা বাতাসে আবার শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। কৃর দিকে তাকালাম। ও আমার মন পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। ও যখন মাথার ভেতর ঢোকে তখন টের পাই। মগজের ভেতর শিরশিরে একটা অনুভূতি হয়।
হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে বসলাম কৃর ঠিক পাশে। এবার আর হাত নয়, সরাসরি কোমর জড়িয়ে ধরে বসলাম। আমি কখনো এভাবে কারো সঙ্গে বসেছি বলে মনে পড়লো না।
কৃও ধরলো একইভাবে। আমি আলতো করে মাথাটা রেখে দিলাম তার কাঁধে। সঙ্গে সঙ্গে চুল ধরে ঝাঁকি দিয়ে আমার মাথাটা সোজা করে দিল কৃ।
‘ঘুমানো চলবে না!’
‘কই নাহ…।’
আমি মাথা নিচু করে ঘাস দেখছি। আধেক চাঁদের আলোয় বিলের মাঝে একটা নৌকাও দেখতে পেলাম এক ঝলক। একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে দূরে। তারার আলোয় নদীর শেষ প্রান্তের খানিকটা দেখা যাচ্ছে। তারপর আবার একরাশ অন্ধকার। পাখিটা ওই অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে। যেন সেখানে তার মধ্যরাতের অফিস ধরতে হবে।
কৃর নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কোন ভাবনায় ডুবে আছে কে জানে। চারদিকে ঘোর লাগা নীরবতা। এভাবে কোনো বিলের পাড়ে রাত দুটোয় প্রেমিক-প্রেমিকা বসে ছিল কিনা, নাহ.. হয়ত বসেছে। আমিই সেই তালিকায় ছিলাম না এতদিন।
ঘাড়ের কাছে কৃর বাম হাতের স্পর্শ পেলাম। আমার মাথাটাকে চেপে ধরলো নিজের কাঁধে। আহা.. এবার নিজেই তা হলে অপরাধবোধে ভুগছে তা হলে। বুঝুক মজা। আমি মাথা তুলে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কড়া চোখে তাকাল কৃ। এ আগুনে দৃষ্টি উপেক্ষা করার সাহস হলো না।
‘ভুলে যাচ্ছো কেন বার বার? আমি তোমার মতো মিনমিনে স্বভাবের মানুষ না। মেজাজ গরম হলে মাঝনদীতে চুবিয়ে আসতে পারি।’
একবার ইচ্ছে হলো বিলের পানিতে নেমে পড়ি। কিংবা কৃকে বলি বিলের ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতে।
‘আমি তোমার রাইড শেয়ারিং হেলিকপ্টার না! যখন বলবে বান্দা হাজির!’
‘তুমি মানুষের মতো কথা বলছো কেন কৃ। তুমি হবে ভয়ংকর! তুমি হবে কালবৈশাখী!’
বলতে বলতে আমার বিড়ালস্বভাব জেগে উঠল। মাথাটাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে এবার আলগোছে ছেড়ে দিলাম কৃর কোলে। এবার আরাম করে ঘুম দেওয়ার পালা। কিন্তু তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে হলো অচেনা খসখসে একটা মধ্যবয়সী পুরুষের কণ্ঠ শুনে।
‘ওমমমা! সাহেব বিবি দেহি রাইত বিরাতে প্রেমলীলা শুরু করবার লাগছেন!’
একজন নয়। তিনজন। পেছনের দুজনের হাতে চকচকে রাম দা। তারা কৃর দিকেই তাকিয়ে আছে। আমিও ভ্রƒ কুঁচকে তাকালাম তার দিকে। আর যাই হোক, উড়ে তো পালাতে পারবো। কিন্তু ভয় পাচ্ছি অন্য কারণে। আমার সূক্ষ্ম সন্দেহ কৃর মেজাজ গরম করা নিয়ে। মেজাজ বেশি চড়ে গেলেই বিপত্তি। মাথা ঘুরিয়ে লোকগুলোর দিকে তাকাল ও। বেশ রিনঝিন টাইপের কণ্ঠে বলল।
‘তোমরা এত রাতে? বিল দেখতে এসেছো নাকি।’
‘ছেমরি দেহি আবার তুমি তুমি করে। আদব লেহাজ শেখা হয় নাই। আসো তোমারে আদব লেহাজ শেখাই।’
আমি উঠে দাঁড়াতে যাব, তার আগে হাত ধরে থামিয়ে দিল কৃ। তিনজনের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনারা ডাকাত হোন আর যাই হোন, চলে যান। আমি কিন্তু সাংবাদিক। এখন কিছু ঘটলে দেখবেন বিরাট ঘটনা ঘটে যাবে। পরে ধরাও পড়বেন।’
রাম দা হাতে একজন কৃর দিকে এগিয়ে আসছিল। আমার কথা শুনে একটু থমকে গেল। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। দাঁত কেলিয়ে হাসল ডাকাত নেতা।
‘খুউব বালা। তুমি খবর লও, আর আমরা খবর বানাই। ওই, সাহেবরে কাগজ কলম দে। আমরা কী কী করি না করি, সেটা লিখবো! হে হে।’
কৃ চোখ মুখ শক্ত করে বিলের দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই। নড়াচড়ার জো নেই। ও কি আমার কাপুরুষতা দেখে বিরক্ত? নাকি অপেক্ষা করছে আমি আমার প্রচণ্ড গরম হয়ে থাকা মেজাজটা দিয়ে কী করি সেটা দেখার জন্য। আমার ধারণা পরেরটাই সঠিক।
ভাব ধরলাম খুব ভয় পেয়েছি। ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। রাম দা হাতে যে লোকটা কৃর দিকে এগিয়ে এসেছিল ও খানিকটা হ্যাংলা। তার পেছনে মেঠো পথ। সে পথে কেউ নেই। আমি চোখ বড় বড় করে শূন্য পথে তাকালাম। যেন বড়সড় এক দানব আছে সেখানে। লোকটাও পেছনে তাকাল। একটাই সুযোগ। হ্যাঁচকা টানে তার হাত থেকে রাম দা কেড়ে নিলাম। ভড়কে গিয়ে পিছু হটতে গিয়ে লোকটা পড়ে গেল দলনেতার গায়ে। দলনেতাও ক্ষণিকের জন্য ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। সময়কে আবার সেকেন্ডে মাপতে বসে গেলাম। আধা সেকেন্ডের মধ্যে দলনেতা গোছের লোকটার গলা বরাবর রাম দার কোপ বসিয়ে দিলাম। গলা থেকে ছিটকে আসা রক্ত আমার শার্টটাকে ভিজিয়ে দিল মুহূর্তে। পেছনের তিন নম্বর ডাকাতটা ভাবার জন্য সময় নিল কয়েক সেকেন্ড। আমি এগিয়ে যাব যাব করছি, এমন সময় পেছনে হ্যাঁচকা টান। আমাকে নিয়ে আবার শূন্যে ভাসল কৃ। হাত দিয়ে কেড়ে নিল রাম দা। ছুড়ে ফেলে দিল বিলে। এরপর উড়াল দিয়ে সত্যি সত্যি নিয়ে গেল বিলের মাঝে। পানিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম গায়ে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে দিতেই এ কাজ করলো। পাড়ে দাঁড়ানো দুই ডাকাতকে দেখলাম দৌড়াচ্ছে পাগলের মতো।
‘এখন যে ঠাণ্ডা লাগছে! একটু আস্তে উড়বে কিন্তু।’
কৃ একটা কথাও বললো না। তার চোখে মুখে নিদারুণ ব্যথার ছাপ। কোনো কারণে ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখেছে যেন। আমার দিকে তাকাল একবার। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কী যেন বলল। মাঝে একবার শুধু ‘স্যরি’ বলতে শুনলাম। সে আমাকে স্যরি বলবে কেন? প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবার আগেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। রকেটের মতো ছুটছে কৃ। এত গতিতে ছোটার জন্য আলাদা ট্রেনিং লাগে। আমার মনে হচ্ছে পেট আর মাথা এক হয়ে যাবে একটু পর।
থামল কৃ। নিজেকে আবিষ্কার করলাম বারান্দায়। গ্রিলের ওপাশে শূন্যে ভাসছে কৃ। তাকে এখন সত্যি সত্যি ডানাহীন পরীর মতো দেখাচ্ছে। সমস্যা হলো পরীটা কাঁদছে। এরপর যা বলল তাতেই বুঝতে পারলাম তার কষ্টের কারণ।
‘আমার কারণে তোমার এত বাজে একটা অভিজ্ঞতা হলো। তোমার কাছে আর আসবো না। আমি আসলেই ঝামেলা বাড়বে। অনেক ক্ষতি হতে পারে তোমার।’
‘কী বাজে বকছো! ঝামেলা ছাড়া জীবন চাই কে বলল! কী ভয়ানক বাজে ধারণা আমার প্রতি তোমার!’
‘সব চাইলেই হয় না। আমি শুধু শুধু.. উফফ কী ভালোই না ছিলে তুমি! এখন আমার কারণে হত্যাও করতে হলো তোমাকে।’
‘আমি এখন ভালো আছি কৃ! আর ওই ব্যাটাকে আরো দুটো কোপ বসিয়ে আসতে মন চাইছে।’
‘তুমি ভালো থেকো তুষার। আমি চললাম।’
আমি কিছু বলতে যাব, তার আগেই গলা ধরে গেল। প্রচণ্ড অভিমানে ভেতরে চলে এলাম। কৃ চলে গেলে যাক!
আবার বারান্দায় এলাম। আমার অভিমান ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু বারান্দায় আসার পর অভিমান কমলো না, বরং বেড়ে গেল। শূন্য বারান্দা। শূন্য আকাশ। ছাদের পর ছাদ। কোথাও নেই কৃ।
৫
ছয় মাস কেটে গেল। এর মাঝে কিছুই ঘটল না। শুধু আমার মনটাই খারাপ ছিল। মন খারাপের কোনো গল্প হয় না। এর মাঝে দুয়েকবার কিংবা তারও বেশি, আমি বারে গিয়েছিলাম। রেশমা বুঝতে পেরেও কিছু বলেনি। আমার মনে হয় প্রত্যেক মানুষের অবচেতন মনের ক্ষমতা প্রায় এক। রেশমার অবচেতন মন ধরে ফেলেছে আমার মন খারাপ, এবং তা অন্য কোনো নারীর কারণেই। প্রথম দিকে মদ খেতে মোটেও ভালো লাগতো না। এখন রীতিমতো অ্যালকোহলিক হয়ে গেছি। এবার মূল ঘটনায় আসা যাক।
গত তিন দিন ধরে আমি হাসপাতালে। সিরিয়াস টাইপ টাইফয়েড। হাসপাতালে গিয়ে স্যালাইনের ব্যাগে করে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। প্রতিরাতেই ভয়াবহ সব স্বপ্ন দেখছি। এর মাঝে একবার সেই ডাকাত দলটাকেও দেখলাম। রাম দা হাতে তিন মুণ্ডুহীন ডাকাত আমাকে তাড়া করছে। আমার পাশে রেশমা। সে আবার দৌড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েও গেল।
হাসপাতালে রেশমা আমার সঙ্গে ছিল প্রথম দিন। গতকাল থেকে সেও জ্বরের খপ্পরে। আজ আমি একা।
রাতে ঘুম ভেঙে গেল। জানালার কাচ বেয়ে ঘোলাটে চাঁদের আলো ঢুকলেও ঘড়িটা দেখতে পাচ্ছি না। একটু আগে বোধহয় ঝড় হয়েছে। ইলেকট্রিসিটি নেই।
শিরশিরে অনুভূতিটা আসি আসি করছে। কৃ কাছে থাকলে এমনটা হতো। এখন সে নেই। তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাকে নিছক কল্পনা বলে চালিয়ে দেওয়া যেত, যদি না আমি সংবাদটা না পড়তাম। হাকালুকি হাওড়ের কাছে এক ডাকাতের মরদেহ উদ্ধার করার সংবাদ। যে ডাকাতের ঘাড়ের ডান পাশে গভীর ক্ষত পাওয়া গেছে।
আমার পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি আর ট্রাউজার। এ অবস্থায় উড়ে যেতে অস্বস্তি লাগবে। এমনভাবে বললাম যেন আমি উড়তে পারি। কী মনে করে শার্ট-প্যান্ট পরে তৈরি হয়ে নিলাম। যেন এখুনি আমাকে কেউ নিতে আসবে।
অনেকক্ষণ কেটে গেলেও কেউ নিতে এলো না। দাঁড়িয়ে রইলাম বারান্দার গ্রিল ধরে। হাসপাতালের পনের তলার ওপর থেকে ঢাকার অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। আগের চেয়েও বেশি ছাদ। ছাদে মানুষজন নেই। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেমে থেমে। তবে বজ্রপাত হচ্ছে না।
ভেতরের তাগাদাটা উপেক্ষা করার মতো নয়। কেবিনের দরজা খুলে বের হলাম। এত রাতে পনের তলার গেইট বন্ধ থাকতে পারে। ইমার্জেন্সি গেট নিচতলায়। অতদূর যাব কী করে। ডিউটিতে থাকা নার্স চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে। তাকে পার হয়ে গেলাম সাবধানে। লিফট বন্ধ হলেও পাশের ইমার্জেন্সি এক্সিট ডোর দেখতে পেলাম। খুলবে কিনা জানি না। ধাক্কা দিয়ে দেখতে দোষ কী।
দরজাটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করলেও ঘুম ভাঙলো না নার্সের। হুড়মুড়িয়ে রাস্তায় নামতেই ইলেকট্রিসিটি চলে এলো। বৃষ্টিভেজা শহরের ঝলমলে বাতিগুলো আমায় ছেঁকে ধরলো। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটা শুরু করেছি। জ্বর বাড়ছে টের পাচ্ছি। ঠাণ্ডা বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠলেও বিশেষ পাত্তা দিচ্ছি না।
আমি যেন কী করে জেনে গেছি আমাকে কোথায় যেতে হবে। মগজের ভেতর সিগনালটা পরিষ্কার। অবৈজ্ঞানিক কিছু ঘটছে না। আমাকে কেউ একজন ডাকছে এবং জিপিএস-এর মতো পথটাও দেখিয়ে দিচ্ছে। গন্তব্যটাও আগে থেকে চেনা। মদিরা বার অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। কৃ চলে যাওয়ার পর সেখানেই গিয়েছিলাম বেশ ক’বার।
শহরটা যেন হঠাৎ করেই জেগে উঠল আবার। মদিরা রেস্তরাঁর আন্ডারগ্রাউন্ডে একটা সংরক্ষিত হলরুমের মতো আছে। ওটার ভেতর আবার অনেকগুলো ছোট ছোট খুপরি ঘর। মাদকের ক্রেতা আর যৌনকর্মীদের রমরমা লেনদেন চলে সেখানে। আমার সব জানা থাকলেও ওদিকে আগে যাইনি কোনোদিন। আজ আমার মনের সঙ্কেত সেদিকেই নিয়ে চলছে। আমি জেনে গেছি খুব তাড়াতাড়ি আমি ওই সঙ্কেতের উৎসে পৌঁছে যাব।
মদিরার একটা গোপন দরজা খুললেই অন্ধকার সিঁড়ি। কেউ বাধা দেয় না। হলিউড মুভির মতো দরজার সামনে বিশালদেহী কোনো গার্ড দেখা গেল না। যেন একদমই বাইরের একটা জগৎ। অন্ধকার সিঁড়ির শেষপ্রান্তে অল্প পাওয়ারের একটা বাতি। এ বাতি কখনোই নেভে না। বাতির আড়ালে অন্ধকার। ওই অন্ধকারেই ঘাপটি মেরে আছে ভারী আরেকটা দরজা। আগাগোড়া সাউন্ডপ্রুফ। বাইরে থেকে তিনবার টোকা দিলে একটা কী হোল খুলবে। ওটা দিয়ে আগন্তুককে দেখে সন্তোষজনক মনে হলে তবেই মিলবে ঢোকার অনুমতি।
আমি ঢুকেই সোজা হাঁটা দিলাম হলরুমের বাঁ দিকের কোণা বরাবর। কে এলো কে গেলো কারো নজর নেই কোনো দিকে। হলদে আর নীলাভ আলোয় চেহারাগুলো ঢাকা পড়ে আছে যতটা সম্ভব। কেউ কাউকে চেনে না, চেনার চেষ্টাও করে না। মদ আর মানুষের ভারী নিশ্বাস মিলেমিশে একাকার হয় এখানে।
একেবারে শেষপ্রান্তের বাঁ দিকে একটা সোফা রাখা। সোফার সামনে টেবিলে খালি বোতল, খালি গ্লাস। কিন্তু কাপড় ছেড়ে জড়াজড়ি করে কেউ শুয়ে নেই তাতে। একা একটা মেয়ে। পান করে বুঁদ হয়ে আছে। চুল কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা। পরনে টিশার্ট আর শর্টস। কেউ মেয়েটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না। হয় কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। বা পেলেও হয়তো বুঝে গেছে এর কাছে আসাটা কোনো কারণে ঠিক হবে না।
‘হ্যালো।’
মেয়েটার চিবুক তার বুকের কাছে ঠেকে আছে। আমার ডাক শুনে মাথাটা তোলার চেষ্টা করে আবার রেখে দিল বুকের কাছে। আমি পাশ ঘেঁষে উবু হয়ে চেহারাটা দেখার চেষ্টা করছি।
‘হেই.. আমাকে চিনতে পারোনি?’ মেয়েটাই বলল। মাথা না তুলেই।
‘পেরেছি বলেই তো এসেছি। কেমন আছো কৃ?’
‘কৃ? হু ইজ কৃ। আমি মিস কেইটি। ক্যাট বলে ডাকে সবাই।’
‘তুমি বিড়াল পছন্দ করো? আমি একদমই করি না। করি না মানে রীতিমতো ভয় পাই। একবার একটা বিড়াল…।’
‘হেই, রনি! রনি!’
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো একটা তাগড়া যুবক। আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন এখুনি তাজা চিপসের মতো কুড়মুড়িয়ে খাবে।
‘স্কচ নিয়ে আসো। যাও।’
‘ওকে মিস কেইটি। আর কেউ বিরক্ত করলে জানাবেন। ঘাড় ধরে বের করে দেব।’
‘কৃ! কৃ!’
আমি তার কাঁধ ধরে ঝাঁকালাম। এবার সে মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। চেহারা ঠিকঠাক থাকলেও আগের সেই দৃষ্টি নেই। ঢুলু ঢুলু চোখজোড়া আমার চোখে তাকালেও দৃষ্টি অন্য কোথাও।
‘কী চাও শুনি!’
মাতালের মতো নয় ঠিক। মদ খেয়ে কৃর মাতাল হওয়ার কথা কিনা আমি জানি না। তবে ঘুম জড়ানো গলা। আবার বিড়বিড় করে বলল, ‘কী চাও বলো না! কেন এসেছো আমার কাছে। আমাকে খুঁজে পেলে কী করে।’
‘আমি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এসেছি। আমার টাইফয়েড হয়েছিল। এখন মনে হয় সেরে গেছে।’
রনি ছেলেটা বোতল নিয়ে আসতেই আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। ঘাবড়ে যাওয়ার মতো একটা শীতল চাহনি দিলাম তার দিকে। আমার হাতে বোতলটা ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল সুড়সুড় করে। গ্লাসে ঢেলে এক ঢোকে চালান করে দিলাম গলায়।
‘বাহ, খুব ড্রিংকস করা শিখেছো দেখছি। বউ জানে?’
‘জানুক। তাতে তোমার কী।’
‘আমার কী? আমার আবার কী? তোমার কোনো কিছুতেই আমার কিছু না। তুমি চলে যাও। আই হেইট ইউ।’
‘ভালো তো, ঘৃণা করার জন্য অন্তত আগে ভালোবাসতে হয়।’
‘দেখো, তুষার। লক্ষী ছেলের মতো বোতলটা রেখে চলে যাও। কী যেন নাম। হ্যাঁ, রেশমার কাছে যাও।’
আমি খপ করে ধরে ফেললাম কৃর হাত। টেবিলে ছলকে পড়ল স্কচ। সাহস পেয়েছি কৃর কথাবার্তাতেই। এখনো আমার প্রতি দুর্বলতার রেশ কাটেনি তার। তা না হলে রেশমাকে নিয়ে খোঁচাটা দিত না। কৃর হাতটা টেনে আনলাম কাছে। অবিকল লুনার সেই হাত। চুমু খেতে গিয়েও খেলাম না। ধরে রাখলাম শুধু। থাকুক কিছু অপূর্ণ ইচ্ছা।
‘ছাড়ো! তা না হলে বিড়ালছানার মতো ঘাড় ধরে বাইরে ফেলে দিয়ে আসবো।’
‘কে ফেলে দেবে? ওই ছোকড়া? ডেকে দেখোই না।’
‘অ্যা.. আসছে আমার বীরপুরুষ। একটা ডাকাত মেরে একেবারে মহাবীর আলেকজান্দার হয়ে গেছেন।’
‘আরো দুচারটা মারতে কতক্ষণ! শুধু আরেকবার উড়তে দাও!’
‘হুহ..।’
ধরে ফেললাম ওর বাকি হাতটাও। টেনে নিয়ে আসলাম কাছে। কৃ মুখ তুলে আছে আমার অপেক্ষায়। অনেক কষ্টে খোলা রেখেছে চোখ। কাঁপছে চোখের পাতা। আমার মনে হচ্ছে ওই চোখের পাতার কাঁপুনি বন্ধ না হলে আমি এখুনি মারা যাব।
‘আমাকে এতই ঘৃণা করো? তবে হাত দিয়ে মদ খাইয়ে দাও। গ্লাসের দরকার নেই। আপাতত মদই যথেষ্ট।’
বদলে যেতে লাগল কৃর দৃষ্টি। এবার সেও পাল্টা আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। চোখ বুঁজে নিজেই এগিয়ে আসতে লাগল আমার নিঃশ্বাসের কাছাকাছি।
‘তোমার চুমুর দরকার নেই আমার। তুমি শুধু আমার সঙ্গে কথা বলো কৃ।’
কবিতাটা পরিচিত মনে হলো। তবে বাকি লাইনগুলো মনে পড়ল না। কিন্তু এ মুহূর্তে এরচেয়ে মানানসই আর কী হতে পারে! আমি কৃর সঙ্গে কথা বলতে চাই। অনন্তকাল ধরে। মনে হলো এই মাত্র আমি আবিষ্কার করলাম যে আমি ঠিক কী চাই।
একটু আগেও মাথায় ঘুরছিল অন্য চিন্তা। কৃ আমাকে ছয়টা মাস যন্ত্রণার একটা গুহায় চাপা দিয়ে চলে গিয়েছিল। পাল্টা অভিমানে প্রতিশোধের কূটকৌশল খেলা করছিল মাথায়।
ছেড়ে দিলাম ওকে। ছাড়া পেয়েই হাতে গ্লাস তুলে নিল। সেটাকে গালের কাছে ঠেকিয়ে কৌতুকভরা চোখে আমায় দেখছে। ও কী ভেবেছে, ওর এমন আচরণ দেখে রাগ দেখিয়ে বের হয়ে যাব? আর কখনোই ওর কথা ভাববো না?
ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলাম। কৃকে মনে হলো বিরক্ত। অথবা কিছু সহ্য করতে পারছে না এমনভাবে নড়েচড়ে বসলো। তারপর একেবারে ঝুঁকে এলো আমার দিকে। আমার নাকে নাক লাগিয়ে আদুরে গলায় বলল, ‘সেক্স করবে? পাশের রুমটা একদম খালি। কেউ ডিসটার্ব করবে না। তোমার যতক্ষণ খুশি থাকতে পারবে। যেভাবে চাইবে.. সব পাবে.. আমি তো জানি তোমার মাথায়… হা হা হা।’
উঠে দাঁড়ালাম। টেবিল থেকে বোতলটা তুলে ঢক ঢক করে গলায় ঢাললাম যতটা পারা গেল। তারপর সেটা ধরিয়ে দিলাম কৃর হাতে। কৃ ঠোঁট বাঁকিয়ে ভ্রƒ কুঁচকে আমার কাজকর্ম দেখল। তারপর কিছুটা হেঁটে পেছন ফিরে তাকালাম, ‘তোমার মন চাইলে অন্য কারো সঙ্গে যা খুশি করো। আমি চললাম।’
কৃ এতটা নাটকীয়তা আশা করেছে কিনা জানি না। আমি অন্তত করিনি। ভারী দরজাটা খুলে ফেললাম এক ধাক্কায়। তারপর সিঁড়ি বেড়ে উঠছি। অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে আচমকা আধা বোতল মদের রিয়েকশনে কিনা, আমার আর কিছুই খেয়াল নেই। ঠিক কোন পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়েছিলাম জানি না।
নিজেকে ধুম করে আবিষ্কার করলাম একটা ছোট্ট আলো আঁধারি ঘরের নরম এক বিছানায়। হাসপাতাল নয় নিশ্চিত। কারণ নাকে ফিনাইল নয়, মদের গন্ধ। আলোর ঝলকানি আর হাই ভলিউমের মিউজিক থেমে থেমে দোলা দিয়ে যাচ্ছে কানে। একবার মনে হচ্ছে ডেথ মেটাল, আরেকবার রবি শংকর। সব গুলিয়ে ফেলছি। একবার মনে হলো আমি আমার শরীরের ভেতরেই আছি, আবার মনে হলো উপর থেকে শূন্যে ভেসে ভেসে দেখছি নিজের উদ্ভট সব কাজকর্ম।
আমার শরীরের ওপর নগ্ন কৃকে দেখে আমার আর লুনার কথা মনে পড়ল না। কারণ লুনাকে কখনো নগ্ন দেখিনি।
এ অন্য এক কৃ। অন্য এক বিস্ময়। আমার খুব কাছে। যার নিশ্বাস পাখির ডানার মতো ঝাপটা মেরে চলেছে আমার কাঁধে, বুকে। আবারও কবিতা বলছি? আগের সেই অনুভূতির কণাগুলো এবার ফেনায়িত স্রোত হয়ে ছুটে আসতে লাগল আমার দিকে। একটু পর পর স্রোত হয়ে আছড়ে পড়তে লাগল আমার নিউরনগুলোতে। মগজের ভেতর নানা রঙের বর্ণালী ঝিলিক দিচ্ছে। মুখ দিয়ে শুধু একটা শব্দই বের হচ্ছে, ‘কৃ! ওহ কৃ!’
ঠিক কতক্ষণ আমাদের সঙ্গম স্থায়ী ছিল জানি না। ক্লান্তি ভর করতেই চিৎ করে শুয়ে রইলাম সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। আমার পেটের ওপর মাথা রেখে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ও। ক্লান্তিতে নয়। ওর ক্লান্ত হওয়ার কথা নয়। ফোঁপাচ্ছে। আলতো করে চেপে ধরলাম মাথাটা। টেনে উপরে তুলতে চাইলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার কাঁধের দুই পাশে দুটো হাত রেখে মাথা তুলে তাকাল কৃ। চোখে একসঙ্গে রাগ, প্রেম আর তৃপ্তির এক অদ্ভুত মিশেল।
চোখ রাখলাম কৃর চোখে। এতদিনের জমানো সব অভিমান আমার চোখেমুখে উপচে পড়ছে। সেসব পুরোটা কৃর চোখে মেখে দিলাম। চোখের ভেতর দিয়ে তথ্যপাচারের কৌশল ততদিনে আমার শেখা হয়ে গেছে। বললাম, ‘তুমি কৃ তাতে কী, আমি হচ্ছি মানুুষ। দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ। আমি পারি না এমন কিছু নাই। এবার পারলে তুমি পালিয়ে দেখাও আমার হাত থেকে।’
আহত চোখ জোড়া নামিয়ে ফেলল কৃ। যেন ভীষণ পরাজিত। আবার এও হতে পারে, আমাকে ইচ্ছে করেই জিতিয়ে দিল। সেটাই হবে হয়তো। সবই হয়ত কৃর প্ল্যান করা। সে জানতো আমি হাসপাতালের অসহ্য বিছানা ছেড়ে বারে আসবো। সে জানতো, আমাকে ছাড়তে না পেরে হেরে যাবে ও। তারপর পরাজয়ের বাহানায় হয়ে যাবে শারীরিক সম্পর্ক।
বাম হাত দিয়ে কৃর ঘাড় চেপে ধরলাম। ধীরে ধীরে নামিয়ে আনলাম ওর মুখটা। চুমু খাওয়ার আগেই কয়েক ফোঁটা পানি এসে পড়লো আমার গালে। কী আশ্চর্য! কৃ কাঁদছে এবং চোখ থেকে পানিও বের হলো, একদম আমার চোখের মতো!
৬
এরপর? আমি সময় গুলিয়ে ফেলেছি। এক সপ্তাহ আগের ঘটনাকে মনে হচ্ছে গতকালের ঘটনা। আবার গতকালটা মনে হয় ছিলই না।
এতসব সমস্যার মাঝেও আমার লেখালেখি ও অফিস চলল। মাস শেষে বেতনও পেলাম। এর মধ্যে নতুন ঘটনার মধ্যে যা ঘটল, আমি সে রাতের পর থেকে মদ খাওয়া একদম ছেড়ে দিলাম। কোন রাতের পর? ওই রাতটা ঠিক কোন রাত ছিল? কৃর সঙ্গে শারীরিক মিলনের কোনো স্মৃতি আমার মাথায় নেই। শুধু ডেথ মেটাল মিউজিক আর আলোছায়ার নাচানাচিটা মনে আছে। আর দুই জগতের মাঝে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সেই ভারী দরজাটা।
আমি ঠিক করেছি কৃকে পুরোপুরি ভুলে যাব। কিন্তু যতই বলি, ততই যেন আরো সূক্ষ্মভাবে তাকে মনে পড়তে লাগলো। যে রাতে আমরা প্রথম ও শেষবার উড়েছিলাম, সে রাতে তার শরীর থেকে কড়া বকুল ফুলের গন্ধ পেয়েছিলাম। সম্ভবত খোঁপায় একটা বকুল ফুলের মালা ছিল।
‘তুমি আমাকে সত্যিই ডিভোর্স দিতে চাও?’
‘অ্যাঁ.. কী?’
‘কোন দুনিয়ায় ছিলে তুমি? কোন দুনিয়ায় থাকো সারাটা দিন!’
তারমানে এতক্ষণ রেশমার সঙ্গে আমার ঝগড়া বা স্বাভাবিক কোনো বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। আর আমি কল্পনার চোখে কৃর নীল শাড়ির পাড়ের নকশাটা দেখছিলাম।
‘আমি ঘুমাবো।’
‘কথা শেষ করে ঘুমাও। ঘুমানোর জন্য সারা জীবন পড়ে আছে। তুমি ভেবেছো আমি কিছু জানি না?’
আমি মুখটাকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে রেশমার দিকে তাকালাম। ও কতটুকু কী জানতে পেরেছে? ঘুমের ঘোরে কৃ কৃ করলে ওর কিছু বোঝার কথা নয়। ঘুমের ঘোরে রেনু, বিথি কিংবা নাবিলা টাইপ নাম বলে বিড়বিড় করলে ধরা খাওয়ার কথা।
‘তুমি বাচ্চা চাও আমি জানি। ডিভোর্স দেবে দাও। কিন্তু দয়া করে সত্যিটা বলো।’
আমি কিছু বললাম না। রেশমা এখন কাঁদবে। এখন কয়টা বাজে? দেয়ালঘড়িতে আটটা। রাত আটটা না সকাল আটটা। মাথাটা গেছে। বাইরে তাকালাম। অন্ধকার।
‘আমি চললাম। তুমি থাকো তোমার লাইফ নিয়ে। মদ খাও, গাঁজা খাও। আরো যা যা খুশি খাও। বাসাটা ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নাও দয়া করে। দুমাস ধরে বাড়িভাড়াও দিচ্ছ না।’
আমি অবাক হলাম না। আরামদায়ক একটা আলস্য ছেঁকে ধরেছে। সব মনে পড়ল। ঘটনা কিছুই না। নিখুঁত অভিনেতা হয়ে উঠছি দিন দিন। দুটো বইয়ের জন্য গত মাসেই লাখ খানেক টাকা পেয়েছি। ব্যাংকেও আছে আগের জমানো টাকা। তার মানে বাসা ভাড়া ইচ্ছে করেই দিচ্ছি না। বাড়িওয়ালা বের করে দেবে এই অপেক্ষায় আছি।
রেশমার মা-বাবা যথেষ্ট ধনী। মেয়ের নামে ফ্ল্যাট জমি সবই দিয়েছেন। আমাকেও অনেকবার এটা ওটা দিতে চেয়েছেন। আমি পাত্তা দেইনি কোনোদিন। পাত্তা যতই দিচ্ছি না, ততই যেন তাদের আহ্লাদ আরো উপচে পড়ছে আমার জন্য। আমিও বোঝাতে পারি না, আমার কাছে জীবনের যে সংজ্ঞা, সেটার সঙ্গে তাদের কন্যার বানানো সংজ্ঞার যোজন যোজন ফারাক। তবে পার্থক্য নেই কৃর সঙ্গে। আমরা দুজনই জীবনকে সম্ভবত একই চোখে দেখছি।
আমাদের কাছে জীবন মানে বদ্ধ মাতাল হয়ে থাকা গুটিকয়েক ক্ষণ। আমার আর কৃর জীবনে সেটা এসেছে এ নিয়ে দুবার। দুবারই আমরা জীবনকে ছুঁয়েছি। নেশাও চড়েছিল খুব। তবে কব্জা করতে পারেনি। কে জানে তার সঙ্গে আমার জীবনের আর কোনো অধ্যায় বাকি আছে কিনা। তবে আমি নিশ্চিত এখন বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর পর সকালে উঠে দেখবো সব আমূল বদলে গেছে। কৃ ছাড়া বাকি সবই হয়ে যাবে আমার চোখের ভুল।
সকালে কিছুই বদলালো না। রেশমা যথারীতি ব্যাগ গুছিয়ে চলে গেছে। সাধারণত সিনেমায় আমরা যা দেখি, এভাবে বিদায় নেওয়ার সময় স্ত্রীরা কাগজে একটা নোট ফোট রেখে যায়। রেশমা আদিখ্যেতা দেখায় না। ও চলে গেল এমনভাবে যেন কোনোকালে সে আমার সঙ্গে ছিলই না। আদৌ কি ছিল?
টেনশনে পড়লাম সকালের নাশতা নিয়ে। কৃ থাকলে..।
‘অর্ডার দিয়েছি। এসে পড়বে একটু পর। আজ খাব মাসালা দোসা। সঙ্গে স্ট্রবেরি জুস। আহা!’
‘ওহ। তুমি! কোন ফাঁকে আসো আর যাও।’
যেন কৃ অনেক দিন ধরেই সকালে এভাবে সেলোয়ার কামিজ পরে আমার সঙ্গে ছিল। আমি পাশ ফিরে শুলাম। বাথরুম চাপলেও উঠতে ইচ্ছে করলো না। চোখ মেলে তাকালাম না, যদি আবার স্বপ্ন হয়ে সব ভ্যানিশ হয়ে যায়।
‘উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। আজ আমরা ওড়াওড়ির মধ্যে নেই। আজ আমরা ঘুরবো। তুমি অফিসে ফোন করে বলো তোমার গায়ে পক্সের মতো গোটা গোটা কী যেন উঠেছে। দেখবে পুরো দশ দিনের ছুটি পেয়ে গেছো।’
‘দশ দিন করবোটা কী?’
‘তুমি কিছু করবে না সোনা। যা করার আমি করবো।’
বলেই আমার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল কৃ। শীত শীত লাগছিল একটু। তার শরীরের উষ্ণতায় সেটা কেটে গেল। খেয়াল করলাম কৃর চুল আবার বড় হয়ে গেছে। চুল নিয়ে অবশ্য আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। বস্তুত কোনো কিছুতেই আমার মাথাব্যথা ছিল না। কৃ যেমনই হোক, তাকে আমার চাই।
এরপরের দশটা দিন খুব স্বাভাবিক। ধোঁয়াটে কিছু ঘটেনি। বিভ্রান্ত হইনি একটিবারের জন্যেও। রেশমাও নিরুদ্দেশ। একবার ফোনও করেনি। নাকি সে অপেক্ষায় আছে আমি গিয়ে আবার তাকে নিয়ে আসবো। সম্ভবত এই দশদিন আমার ফোনটাও বন্ধ ছিল। আর আমি সম্ভবত অন্য এক নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলাম বলেই..। কৃর নেশায়।
কৃর সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্তই আমার কাছে বিশেষ লাগার একটা কারণ আছে। প্রতিটি মুহূর্তেই তার সঙ্গে আমার ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালসের আদান-প্রদান ঘটে। ব্যাখ্যা করতে পারব না। তাই ইচ্ছে করেই খটমটে নামটা দিয়ে রাখলাম। শুধু আবেশ শব্দটা ব্যবহার করলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হতো না।
‘চলো নারিন্দা যাই।’
‘গেলাম।’
‘নারিন্দায় কেন যাব জানো তো?’
‘নাহ।’
‘ঝুনুর বিরানি খাবো।’
‘ঝুনু রান্না করবে?’
‘তুমি কিচ্ছু চেন না। আজ চেনাব।’
‘রিকশায় যাব?’
‘এই ভরদুপুরে তোমাকে কোলে করে নিয়ে যেতে হবে?’
‘হে হে। মন্দ হয় না। জ্যামে পড়লে অন্তত উড়িয়ে নিয়ে যেও।’
‘পরে সবাই লাইন ধরবে।’
‘তাও ঠিক। চলো রিকশায় যাই, হেঁটে যাই, তারপর ফাঁকা পেলে উড়ে যাব।’
‘তোমাকে ওড়ানোটা ঠিক হয়নি। লোভে পেয়ে বসেছে।’
আমি আবার সেই ভুবন ভোলানো হাসিটা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কাজ হলো না। আকাশে ঝড়ের ইঙ্গিত। এর মধ্যে রিকশা নেওয়াটা রিস্কি। আচমকা বাতাস বেড়ে গেলে উল্টে পাল্টে যেতে পারে। গেলেই ভালো। ঝড়ে রিকশা উল্টে গেলে কৃ তখন আমাকে নিয়ে উড়াল দেবে। লোকে দেখবে দুটো যুবক যুবতী ঝড়ে উড়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ ছবিও তুলে ফেলবে।
কৃ সঙ্গে থাকলে আমার কল্পনাগুলো বাস্তবে ঘটতে শুরু করে। হলোও তাই। ঝিগাতলা পেরোতেই তুমুল বাতাস। সাইনবোর্ড উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। কৃ আমাকে শক্ত করে পেঁচিয়ে রেখেছে। রিকশাওয়ালা সাইড করে রাখার চেষ্টা করছে। পারছে না। রিকশাটা উল্টো দিকে চলতে শুরু করেছে। আমি ভয়ার্ত চোখে তাকালাম কৃর দিকে। বোঝাতে চাইলাম, এ অবস্থায় রিকশা না ছেড়ে বরং রিকশাটাকে নিরাপদে নেওয়া দরকার আগে।
কৃ আমার কথা বুঝলো কিনা জানি না। তবে রিকশাটাকে দেখলাম একটা পিলারের গায়ে ধাক্কা লেগে দাঁড়িয়ে যেতে। রিকশাওয়ালা কোনোমতে চাকার সঙ্গে পিলারের শিকল পরিয়েই ছুট। এপ্রিলে এমন দমকা বাতাস হুটহাট আসবেই। তবে কৃ থাকতে আমি প্রস্তুতি নিয়ে ভাবি না। বস্তুত কোনো কিছু নিয়েই ভাবি না। কৃর চোখে চিন্তার ছাপ দেখলাম। এবার অন্যরকম একটা আনন্দ ছেঁকে ধরলো। কৃ আমাকে নিয়েই চিন্তিত! বাহ। এবার তার ক্ষমতার চূড়ান্তটা দেখা যাবে। দুহাত দিয়ে আমার কোমর পেঁচিয়ে রেখেছে। আমি চিৎকার দিয়ে বললাম, ‘এখুনি না। লোকজন দেখলে আরেক বিপদ। একটু অপেক্ষা করি। বাতাস কমে যাবে।’
কিন্তু বাতাস কমার কোনো লক্ষ¥ণ নেই। কৃ সামনের দিকে কেমন যেন বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে না সে ঝড় তুফান নিয়ে চিন্তিত।
‘কী হয়েছে?’
‘ওরা দেখে ফেলেছে।’
‘কারা?’
‘অন্য কৃ রা।’
‘তুমিই তো কৃ।’
‘আরে.. অন্য কৃ। আমার মতো।’
‘দেখুক।’
‘ওরা চায় না আমি..।’
‘ধুর.. আমি বাঘ না ভালুক। জানলে কী সমস্যা।’
‘ওরা চায় না।’
দুশ্চিন্তায় পড়ার মতো কথা। কিন্তু একচুলও ভয় লাগল না। ইচ্ছে করছে এই ঝড়ে সত্যিই উড়াল দিতে পারলে চমৎকার একটা স্মৃতি হতো। কৃর দিকে তাকালাম অনুনয়ের দৃষ্টিতে। ঝড় বা আমার কাতর দৃষ্টি নয়। কৃ তার দুশ্চিন্তামাখা চেহারায় রিকশার হুডটা সরিয়ে আমাকে ধরে পেছনের দিকে ছুট দিল। শোঁ শোঁ শব্দে কানের পর্দা ফাটার দশা। পেছনে বা সামনে না গিয়ে কৃ ছুটছে সোজা উপরের দিকে। বাতাসের সঙ্গে তাল মেলাতে সামান্য কোণাকুণি করে উঠছে। আমি যথারীতি আঁকড়ে ধরে আছি তাকে। ছুটে গেলে একটা কেলেংকারি ঘটে যাবে। পরদিন নিউজ হবে, ঝড়ে উড়তে উড়তে আছড়ে পড়লেন সাংবাদিক। উচ্চমার্গীয় গল্পটল্প যারা লেখেন, তারা লিখবেন মরে যাওয়ার আগে সে যতক্ষণ উড়েছিল।
এসব ভাবতে ভাবতে মনে হলো ঝড় কেটে গেছে। কৃ আমাকে নিয়ে এখন ছুটছে। কোন দিকে জানি না। চোখ মেলেও বুঝতে পারছি না। হেলিকপ্টারে চড়ার অভ্যাস থাকলে বোঝা যেত। ওপর থেকে আমার কাছে মহাখালী যা পটুয়াখালীও তা।
ল্যান্ডিংটা ঠিকমতো হলো। প্যারাসুটে আনাড়িরা যেভাবে নামে, অনেকটা সেভাবেই যেন আছড়ে পড়লাম। ভাগ্যিস কিছু ভাঙেনি। কৃ ছুটে এসে দেখতে লাগল আমি ব্যথা পেয়েছি কিনা।
‘তোমার চোখে এক্সরে পাওয়ার আছে?’
‘আমি ক্রিপটন গ্রহ থেকে আসিনি! গ্রহটা কোথায় সেটাও জানি না!’
কৃ আবার মন পড়ে ফেলল আমার।
‘ও, ওকে। কিন্তু ডান পা মচকেছে মনে হচ্ছে।’
আশপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারছি না কোথায় এসেছি। মফস্বলের মতো এলাকা। সামনে একটা খালের মতো। এখানে বৃষ্টি হয়ে গেছে একটু আগে। কারণ সারা গা কাদামাটিতে মাখামাখি। কৃর জামারও বারোটা বেজেছে। একটা গ্রামের বাড়ির মতো বাড়ি দেখা যাচ্ছে। আধাপাকা বাড়ি। ছাদে টিন। পাশে গোয়ালঘর। টিউবওয়েলও আছে। কৃর কাঁধে ভর দিয়ে ওদিকেই যাচ্ছি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
গ্রামের পরিবেশে এমন একটা ঘরের স্বপ্ন কি আমি প্রায়ই দেখতাম? কিন্তু আমি তো কোনো কাজই পারি না। নাহ, পাখি ছিল আমার একসময়। লাভ বার্ড আর একগাদা বাজরিগার। পরে সব ছেড়ে দেই। গ্রামর হাঁস-মুরগি পালা এর চেয়ে কঠিন কিছু নয়।
‘কৃ, আমরা এখানেই থেকে যাব নাকি?’
‘গরুর ঘাস কাটবে? নাকি মুরগির হাগু পরিষ্কার করবে?’
‘আমি লিখব, আর তুমি এখানে কোথাও মাস্টারি করবে।’
‘কী শেখাবো?’
‘কী আর, উড়তে শেখাবে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা আকাশে উড়বে আর ঢিল না ছুড়েই পাকা আম খাবে। ওই দেখো গাছে আম।’
‘এই ভরদুপুরে অচেনা গ্রামে একটা মেয়ে উড়ে উড়ে আম পাড়বে?’
সত্যি বলতে কি এতটাই খিদে আর তৃষ্ণা পেয়েছিল যে আমি সেটাই চাচ্ছি। কিন্তু কৃ আমার চাওয়াটাকে পাত্তা না দিয়ে বাড়ির উঠোনের দিকে হনহন করে হাঁটা দিল।
‘কেউ আছেন?’
সেকেন্ডের ব্যবধানে বাড়ির তিন দিক থেকে দৌড়ে তিনটা মেয়ে ছুটে এলো। একজন বয়স্ক, বাকি দুজন সম্ভবত ওই বয়স্ক নারীর মেয়ে কিংবা ছেলের বউ।
‘কিডা, শুক্কুরের মাইয়া মিতু?’
‘জ্বি না, আমি মিতু না।’
অন্যদের মধ্যে ফুসুর ফাসুর শুরু হয়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়েও মন্তব্য করলো। কিছুই কানে এলো না।
‘আসো মা আসো। কার বাড়ির আত্মীয় তুমরা।’
এবার আমি এগিয়ে গেলাম। কিন্তু কথা বলার সুযোগ পেলাম না। তার আগেই কৃ তার সামনের শাড়ি পরা একটা মেয়েকে বলল, ‘আমার জামাটা একদম নোংরা হয়ে গেছে। তোমার কাছে একটা শাড়ি হবে?’
মেয়েটা এক দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। আমি বয়স্ক নারীটার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, ‘খালাম্মা। ঝড়ে পড়েছিলাম। এখন পথ ভুলে গেছি। এটা কোন গ্রাম?’
খালাম্মা জবাব দিলেন না। তিনিও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কৃকে নিয়ে।
‘তোমার নাম কীগো মা?’
‘জ্বি আমার নাম কৃ।’
‘এইটা কেমন নাম। তোমার ভালো নাম নাই?’
‘আমার ভালো নাম কৃ। খারাপ নাম আছে একটা। লুনা।’
কুটকুট করে হেসে উঠল বাচ্চাদের একটা দল। এই বাড়িরই সদস্য সবাই। আমি পড়লাম বেকায়দায়। কারো সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে না। এদিকে কৃ চলে গেছে ভেতরে। আমি অসহায়ের মতো উঠোনে দাঁড়িয়ে।
খানিক পর এক কিশোরী কুটিল হাসি দিয়ে আমাকে ইশারায় কলতলা দেখিয়ে দিল। তার হাতে আবার চকচকে লুঙ্গি। কোনো পুরুষকে দেখা গেল না। তারা হয়তো কাজেকর্মে ব্যস্ত, না হয় শহরের দিকে দোকানপাট চালায়। যাই হোক, লুঙ্গির দরকার হবে বলে মনে হচ্ছে না। পানি দিয়ে জিন্সটাকে ভালো করে ধুয়ে নিলাম। আমার নিজেকে মনে হলো আমি এ বাড়িরই আত্মীয়। এমনটা মনে হওয়ার কারণ কৃ। সে এরইমধ্যে গল্প জুড়ে দিয়েছে সবার সঙ্গে। মেয়েটা নির্ঘাৎ তার ক্ষমতা কাজে লাগাচ্ছে। মানে কার মনে কী আছে সব পড়ে ফেলছে। আমি সে আড্ডায় যোগ দিতে পারছি না।
‘দুলাভাই, ভিতরে আসেন। খানা বাড়সি। খাইয়া লন।’
কিশোরী আবার বেণী দুলিয়ে চলে গেল।
পরের এক ঘণ্টা কাটল স্বপ্নের মতো। সময় কাটল তরতরিয়ে। কৃ সবাইকে বলেছে আমরা বিয়ে করে ঢাকা থেকে পালিয়ে এসেছি। কোথায় যাব না বুঝতে না পেরে যশোরের এ গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছি। যা হবার হবে একটা ভাব নিয়ে আমি বসে আছি পুকুর ঘাটে। আমার সঙ্গে কথাই বলছে না কেউ। মাঝে মাঝে বাড়ির বড় ছেলে এসে চা দিয়ে যাচ্ছে আর গল্প করে যাচ্ছে। এক বর্ণও আমার মনে থাকছে না। শুধু এটুকু শুনতে পেলাম যে গ্রামে আমার অনেক পাঠক আছে। তারা আমার বিশাল ভক্ত।
এদিকে রাতে আমার আর কৃর বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হয়েছে। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম লোকগুলোর খরচাপাতি নিয়ে। তবে এ বিষয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না।
মাঝে একবার শুধু কৃর সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ওই একবারই মনে হলো আমি আবার নতুন করে কৃর প্রেমে পড়েছি।
সাধাসিধে একটা কাতান শাড়ি। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, কাজল, পায়ে আলতা, কানে বড় দুল, গলায় একটা ইমিটেশনের হার; আমার ইচ্ছে হলো হা করে অন্তত মিনিট পাঁচেক তাকিয়ে থাকি। কিন্তু কৃও যেন আমাকে চিনতে না পারার ভান করে চলে গেল হুড়মুড় করে। কিশোরী এবার আগের চেয়েও বেশি সাহস দেখিয়ে আমার কাছে এসে কটমট করে বলে গেল, ‘বাসর রাইতের আগে দেখা সাক্ষাৎ হইবো না। গেইটের জন্য টেকাপয়সা রেডি করেন।’
সত্যিই তো। গ্রামে তো গেইট ধরাধরির বিষয় আছে। উঠতে বসতে শ্যালক-শালিকারা গেইট ধরবে। টাকা দিয়ে পার হতে হবে প্রতিটা গেইট। মানিব্যাগে কার্ড আছে কয়েকটা। ক্যাশ নেই বললেই চলে। এই গ্রামে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো বুথ পাওয়া যাবে।
সন্ধ্যা নাগাদ সাজ সাজ পড়ে গেল পুরো বাড়িতে। আশপাশের সব বাড়িতে খবর হয়ে গেছে। উঠানে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। আমাকেও ধাক্কা টাক্কা দিয়ে কয়েকজন চলে গেল গরুর মাংসের ডেকচির কাছে। রান্নার অবস্থা দেখছে। আর চুলায় অহেতুক লাকড়ি দিচ্ছে।
আমাকে কয়েকজন চিনতে পেরেছে। আমার ধারণা ছিল না এ গ্রামে এত মানুষ গল্পের বই পড়ে এবং তারা আমার কাছ থেকে অটোগ্রাফও নেবে। অটোগ্রাফ নিয়ে তারা কী করবে জানি না, তবে আমি যেখানে পেরেছি দিয়েছি। কেউ খাতায় নিল, কেউ টুকরো কাগজ নিয়ে এলো। একপাশে অটোগ্রাফ, অন্যপাশে মুদি বাজারের তালিকা।
রাতের খাবার হলো ব্যাচে ব্যাচে। আমিও এক ব্যাচে খেয়ে নিলাম। জামাই বলে আলাদা কোনো খাতির যত্ন নেই। সবাই সবার মতো হই হুল্লোড় করে খেয়ে বিদায় নিচ্ছে। এক ফাঁকে ভেতরে ঢুকে দেখে নিলাম কৃকে। বউ সেজে বসে আছে একটা খাটে। তাকে খাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার পরনে একটা ধোয়া পাঞ্জাবি আর পাজামা। পাজামার ফিতা টাইট দিতে পারছি না ঠিকমতো। মহা মুশকিল। কৃকে কখন কাছে পাব সেই চিন্তায় অস্থির। আমাদের বাসর ঘরও সাজানো হয়েছে। ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। ওদিকে উঠোনে আবার নাচানাচি শুরু হয়েছে। বাঁজখাই এক পুরুষ আবার চিৎকারও করছে, ‘তোরা এইটা কী নাচস, আমি এর চাইতে ভালা নাচি। দেখবি!’
ওই লোকের নাচ দেখার ইচ্ছে হলো না। ইচ্ছে হলো শুধু কৃকে দেখি। একবারও মনে হলো ঠিক এ সাজে রেশমাকেও দেখেছিলাম। কিন্তু সেটা যেন সুদূর এক অতীত। যে অতীত ক্রমে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমি কি খারাপ মানুুষ হয়ে যাচ্ছি? আমার কি অপরাধবোধ জাগা উচিৎ? উফফ, এত ভালো খারাপের প্রশ্নই বা আসছে কোথা থেকে? এ এক অন্য মুহূর্ত। এমনই থাকুক না।
বাসর ঘরে ঢুকতে পারলাম অবশেষে। হাজারখানেক টাকা ছিল পকেটে। ওটা দিতেই পথ ছাড়ল কিশোরীর দল। টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে মহা ব্যস্ত তারা। কী সুন্দর দৃশ্য!
আচমকা শুরু হলো তুমুল বর্ষণ। বাইরে দৌড়াদৌড়ি আর এটা ওটা পড়ে যাওয়ার শব্দ পেলাম। আম কুড়োনোর জন্য ছুটলো কয়েকজন। আমারও খুব ইচ্ছে হলো। কিন্তু কৃর ভয়ে পারলাম না।
দরজার ছিটকিনি আটকে এগিয়ে গেলাম কৃর দিকে। কী নির্বিকার ও! যেন সত্যিই আজ আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল এবং দারুণ এ বৃষ্টিতে অজানা অচেনা এক গ্রামে অপরিচিত মানুষগুলোর বাড়িতে আমাদের বাসর সাজানো হয়েছে। এটা তো গল্পও নয়। বাস্তব কি এতটাই অদ্ভুতুড়ে হতে পারে?
‘গাধার মতো চিন্তা করবে না বুঝলে?’
‘কী করবো এখন?’
‘এখন আমাদের বাসর হবে। বাসর রাতে কী করে মনে নেই? রেশমার সঙ্গে বাসর হয়নি তোমার?’
‘ভুলে গেছি।’
‘ন্যাকামি আমার একদম পছন্দ না। ন্যাকামি করলে বাইরে তুফানের মধ্যে আধমাইল দূরে ফেলে আসব!’
‘আমি আরো ন্যাকামি করবো। বাইরে ফেলে আসলে বাইরেই থাকবো। তোমার কি ধারণা আবার পথ চিনে চিনে চলে আসবো?’
‘আর তোমার ধারণা তোমাকে উদ্ধার করতে আমি এই শাড়িটাড়িসহ রাত বিরাতে ছুটে যাব? দুই ঘণ্টা লেগেছে এমন করে সাজতে।’
‘দরকার হলে এভাবেই যাবে। সঙ্গে একটা হারিকেন নেবে। আর ওই কিশোরী মেয়েটা সঙ্গে থাকবে। ওর অনেক সাহস।’
‘হুঁহ।’
আমি কৃর মুখের দিকে তাকালাম। চেহারাটা দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না কিছুতেই।
‘খবরদার, নাটক সিনেমার মতো কিছু করবে না। তোমার যেটা মন চায় করো, কিন্তু দেখে দেখে শেখা কিছু করবে তো..।’
কৃর কথা শেষ হবার আগেই আমি চুমু খেলাম। এবার সরাসরি ঠোঁটে। এবার একদম মানুষের ঠোঁট। কোনো অনুভূতির কণা-টনা ঢুকলো না। কৃ হাসল।
‘তোমার ঠোঁটে লিপস্টিক লেগে গেছে। ধরো টিসু। মুছে নাও।’
‘লাগলে লাগুক।’
আবার আমার বেড়াল স্বভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। মাথাটা ওর কোলে রাখতে যাব তার আগেই চুলর মুঠি ধরে সোজা করে দিল কৃ।
‘এইসব সিনেমা চলবে না বাছা।’
কিছুই হয়নি ভাব দেখিয়ে ভদ্রলোকের মতো বসে লম্বা একটা হাই তুললাম।
‘সুন্দর মতো শুয়ে পড়ো। সকালে ভাগতে হবে।’
কৃর আদেশ অমান্য করা যাবে না। কৃ হলো আমার ‘শি’। যাকে মানতেই হবে। মনে মনে দুলাইন কবিতা বানালাম। কবিতা না, শের হবে হয়তো। গালিব ভর করেছে এই ব্যাঙ ডাকা বর্ষণের রাতে। বিড় বিড় করে আওড়ে গেলাম।
‘ওরে ঘোর বরষা, ফোঁটায় ফোঁটায় কত লিখে চলেছো রাতলিপি
প্রেমিকার গোপন হাহাকার লিখতে চাও?
দমকা বাতাস হয়ে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাও জলকণা ভাষা।’
হাহাকারের আশাবরী বেজে উঠলো। তবে প্রেমিকার নয়, নিজের বুকে। কিন্তু রাগের আলাপ বিস্তার বেশিদূর এগুলো না।
কেমন একটা অনুভূতি হলো। কিছু একটা টের পেলাম। ভালো কিছুর নয় এটা নিশ্চিত। অনেক ঘটনা দ্রুত ঘটে যাওয়াতেই বোধকরি এমনটা মনে হচ্ছে। কোনো একটা বড় গড়বড় হতে চলেছে?
‘কী ভাবছো? টেনশন?’
কৃ নিজেও বুঝতে পারছে না।
‘ভালো লাগছে না কৃ।’
‘ভয় নেই। কিছু হবে না। চুপ করে শোও। সকাল হলে চলে যাব। সারা রাত একটুও জ্বালাবো না তোমাকে।’
‘না। তা না। যেভাবে দ্রুত সব হলো তাতে।’
‘মানুষগুলো খুব ভালো বুঝলে। এত ভালো হওয়াটা অবশ্য ঠিক না। অতি ভালোর গলায় দড়ি।’
বৃষ্টি আবার হুট করে থেমে গেল। দূর আকাশে গম গম শব্দ হচ্ছে খানিক পর পর। কিন্তু আর কোনো সাড়া নেই। সবাই ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?
‘কাছে এসো। ভয় পাচ্ছো কেন? তোমার হার্টবিট দেখি বাড়ছে।’ কৃ আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে।
‘আমিও বুঝতে পারছি না।’
আমি কৃর মাথাটা আরো জোরে চেপে ধরলাম। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার ঝামেলা পাকাচ্ছে। হয়ত এমন ঘটনা দেখে অভ্যস্ত নয় বলে।
ততক্ষণে কৃ আমার কপালে একটা চুমুও দিল। আমি শক্ত করে কৃর হাত ধরলাম।
‘কৃ, শোনো। আমার মনে হয় আমাদের এখুনি চলে যাওয়া উচিৎ। শুধু কৃ না, মানুষেরও কিছু ক্ষমতা আছে। আগাম বিপদের গন্ধ পায়। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে..।’
এমন সময় দরজায় মৃদু টোকা। চমকে উঠলাম। কৃ উঠে দাঁড়াতে যাবে। বাধা দিলাম। আমিই এগিয়ে গেলাম। গ্রামের দরজায় কী-হোল নেই। খুলবো কিনা বুঝতে পারছি না। আবারো মৃদু টোকা। কিশোরীর কঠিন গলা, ‘দরজা খোলেন।’
দরজা খুলতেই গালভর্তি দাড়িওয়ালা মোটাসোটা ছ ফুট লম্বা এক লোক। পর্বতের মতো পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা ফ্যাকাসে রকমের সাদা। ক্ষেতে খামারে খেটে খাওয়া মানুষ নয়। খেয়ে খেয়ে মোটাতাজা হওয়া মানুষ।
‘কে আপনি?’
‘সাইডে যান। না হয় বাইরে আসেন।’
আদেশের সুর। আমি দরজাতেই দাঁড়িয়ে। হাত-পা কেমন অবশ লাগছে। লোকটার মুখে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের হাসি। মনে হচ্ছে সে সব জানে এবং জেনেই এসেছে।
‘কই মিয়া, সরেন। আপনে মানুষ ভালা। লেখক মানুষ। ইজ্জত আছে। আপনারে ফালাইসে ঘোরের মইধ্যে। আমি কালিপ্রসন্ন। তিন গ্রামের ওঝা। সাপে কাটার ওঝা না। অন্যরকম ওঝা। আপনে সরেন।’
পেছনে সরে এলাম। সোজা চলে গেলাম কৃর কাছে। কৃ ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার মাথা থেকে ঘোমটাও পড়ে গেছে। কালিপ্রসন্ন লোকটা বিশ্রীরকম হাসি হেসে কৃর দিকে তাকাল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘তোর জারিজুরি এখানেই খতম মায়াবিনী। এবার তোরে বন্দি করনের পালা।
৭
রাত বারোটার পর। হিসেবে দ্বিতীয় দিনের শুরু। কৃর চেহারার পরিবর্তনটা টের পেলাম। এবার আর অভিমান বা কষ্ট নয়, আতংকে অস্থির হয়ে আছে। কালিপ্রসন্ন লোকটাকে এত ভয়ের কী আছে বুঝলাম না।
‘উপস্থিত ভাইসব। এ হইলো আসল ডাইনি। আপনেরা যেমনটা ভাবতেন, ওই রকম না। এই ডাইনি ভোলাভালা মানুষগুলারে প্রেমের জালে ফাঁসাইয়া শেষে একদম শুইসা নেয়।’
আমার ইচ্ছে হলো কৃকে বলি, ‘কই! তুমি তো আমায় এখনো শুসে নিলে না!’ কিন্তু এখন মনে হয় ইয়ার্কির সময় না। আমি ওঝার কাঁধে হাত রাখলাম। চাপ দিলাম মৃদু। ওঝার হাসিটা বিরক্তিতে রূপ নিল। আমি আমার স্বভাবসুলভ শীতল দৃষ্টিতে মোনালিসা টাইপের রহস্যময় হাসি দিলাম। কাছে এসে ফিসফিস করে বললাম, ‘কার সঙ্গে এসব করছেন কোনো আইডিয়া আছে?’
ওঝা ঘাবড়ে গেল বলে মনে হলো না। সে ঝটকা মেরে আমার হাত সরিয়ে দিল। তারপর পেছনে ঘিরে রাখা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাগো বাড়িতে আইসা খাইয়া দাইয়া শেষে আমারে থেরেট করে। আর আপনারা চাইয়া দেখবেন?’
আমি অন্য কারো দিকে তাকালাম না। স্থির দৃষ্টিতে লোকটার দিকেই তাকিয়ে আছি। আমার চেয়ে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা হবে। ওজনটাও বেশি। পেরে উঠবে না। কিন্তু বাকিদের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী তা বুঝতে পারছি না।
‘কাজটা ভালা করতাছেন না। আপনে সাইডে আসেন। বাইর হন। আপনার লগে কোনো কথা হইতেসে না। গেরামের অন্তত চৌদ্দজন মানুষ আসছে যারা আপনাদের আইজকা উইড়া আসতে দেখসে।’
এ তা হলে ঘটনা। কৃও স্বাভাবিক। সে কি এখন তার ক্ষমতা দেখাবে নাকি আগের মতো আমরা পালাবো?
‘কুনু লাভ নাই বুঝলা, আমার হাত এত নরম না। তোমারে আমি…।’
ওঝার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমাদের বাসর ঘরে যেন একটা ছোটখাট টর্নেডো বয়ে গেল। বাতাসের ধাক্কায় চুপসে গেল সবাই। বাচ্চারা ছুটে চলে গেল ভয়ে। বড়রাও সিঁটিয়ে গেল। আমি আমার পাশের টেবিল আঁকড়ে ধরলাম। ভয় পেয়ে গেলাম এটা দেখে যে ওঝা লোকটা একটুও নড়ল না। যেন সে এসবে অনেককাল ধরে অভ্যস্ত।
থামল ঝড়। থামল কৃ। এগিয়ে গেলাম। তাকে ধরলাম। আমার গায়ে এলিয়ে দিল শরীরটা। বিড়বিড় করে কী যেন বলল। বুঝতে পারলাম না। মুখের কাছে কান নিয়ে গেলাম।
‘তুমি চলে যাও। আমি পারছি না। আমি পারব না।’
ওঝার দিকে তাকালাম। হারামজাদাটা দুহাত তুলে বিড়বিড় করে মন্ত্র কপচাচ্ছে। আমি তেড়ে যেতেই বাড়ির এক সুঠাম শরীরের লোক এসে আমাকে শক্ত করে ধরে পাশে নিয়ে গেল। নাহ, এর সঙ্গে পেরে ওঠা অসম্ভব। হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলাম। চোখ নামিয়ে বোঝালাম, আপনিই ঠিক। ডাইনির ফাঁদে পা দেওয়া মোটেও উচিৎ হয়নি।
মানুষটা আমার অভিনয় ধরতে পারল না। ছেড়ে দিল। ছাড়া পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। ওঝার দিকে আড়চোকে একবার তাকালাম শুধু। কৃ ক্রমে দুর্বল হচ্ছে। একটা কিছু ঘটছে। পরিণতি কী জানি না।
কৃর চোখের দিকে তাকাতেই বুকটা হু হু করে উঠছে। ওঝার মন্ত্র পড়েও বোঝা যাচ্ছে না কী করতে চায় ও। কৃ মাঝে একবার শূন্যে ভেসে উঠল, আবার আছড়ে পড়ল। এভাবে চলতে থাকলে কৃ বাঁচবে কিনা…।
এদিক ওদিক তাকালাম। আমার পেছনেই টেবিল। বাসর ঘরের গেট ধরার জন্য কিশোর-কিশোরীরা একটা ফিতা আটকে রেখেছিল। ওটা কাটার জন্য একটা বড় সেলাই করার কাচিও এনে দিয়েছিল ওরা। লোহার তৈরি পুরনো আমলের কাচি। দরজিদের প্রিয় বস্তু। চুপিসারে অন্য দিকে তাকিয়ে হাত নিলাম ওটার কাছে। কাচি বন্ধ থাকা অবস্থায় নিরাপদ। তাই দুই মাথা ফাঁক করে নিলাম। এক প্রান্ত হাত দিয়ে চেপে ধরলাম। দাঁত চেপে সহ্য করলাম ব্যথাটা। ভালোই কেটেছে। উপায় নেই। ধারাল একটা ফলা বের করে রাখতে হলে আরেকটা পাশ চেপে রাখতেই হবে।
আমাকে বাধা দিয়েছিল যে লোকটা সে খানিকটা সরে যেতেই ধীরে ধীরে ওঝার পাশে এসে দাঁড়ালাম। ডান হাতের কাচি কেউ দেখেনি। দেখলেও সমস্যা নেই। আমার সময় লাগবে এক কি দুই সেকেন্ড। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওঝার ঘাড়ে বিঁধিয়ে দিলাম ফলাটা। নিজেও ব্যথায় কুঁকড়ে গেলাম। কারণ অন্য পাশের ধারাল ফলাটা কচ করে তালুতে ঢুকে গেছে।
ওঝার ঘাড়ের ডান পাশে ইঞ্চি তিনেক ঢুকেছে আরেকটা ফলা। এটুকুই আপাতত যথেষ্ট। কাচিটা ছেড়ে ছুটে গেলাম কৃর কাছে। ওকে কোনোমতে দাঁড় করালাম। ওঝা এখন মন্ত্র পড়া ছেড়ে নিজের ঘাড় সামলাতে ব্যস্ত। দরজার সামনে একগাদা লোকজন। কৃ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দম নিল। আমি কী মনে করে লোকলজ্জা উঠোনে ছুড়ে সজোরে চুমু খেলাম ওকে। ইচ্ছে হলো এভাবেই জড়িয়ে ধরে রাখি। সবার সামনে। কিন্তু সময় আবার নিজের গতিতে চলতে শুরু করে দিয়েছে। কৃকে সোজা করে ধরে রাখলাম। কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, ‘কিছু পারো না পারো অভিনয় করতে থাকো। ভয়ানক কিছুর অভিনয়।’
কৃ চোখ মুখ শক্ত করে হরর সিনেমার মতো গটগট করে শূন্য দৃষ্টিতে হেঁটে যেতে শুরু করলো। কাজ হলো। পথ ছেড়ে যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। পেছন থেকে মিনমিনে গলায় ওঝা বলেই চলেছে, ‘হাসপাতাল! আমারে হাসপাতালে নিয়া চল কেউ!’
আমি আড়চোখে কৃকে দেখছি। হাতের ইশারায় অহেতুক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল দূরের একটা চেয়ার। বাইরে ঝড়ো বাতাসে প্যান্ডেল উড়ছে। দুয়েকটা চেয়ারও পড়ে যাচ্ছে। ভয়টা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। সবাই ভাবছে ঝড়টাও কৃ নিয়ে এসেছে।
কৃর ডান হাত আমার কাঁধে ভর দেওয়া। আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসিতে মিষ্টি ভাব আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কৃর শাড়িটা লাল। তাতে আমার রক্তের দাগ আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না। কৃ খেয়াল করলো অনেক পর। ততক্ষণে আমরা দুজন অন্ধকারে গ্রামের পথে কোনো এক দিকে এগিয়ে গিয়েছি অনেক দূর। ঝড় থেমে গেলেও থেমে থেমে বাজ পড়ছে আর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ছাঁট লাগছে গায়ে।
শাড়ির পাড় ছিড়ে ব্যান্ডেজের মতো করে বাঁধল। তারপরও রক্ত বন্ধ হওয়ার নাম নেই। বৃষ্টির পানির সঙ্গে হাতে দুই ফোঁটা চোখের পানিও পড়ল। চোখের পানি আলাদা করে বুঝতে পারলাম কারণ ওটা বৃষ্টির পানির চেয়ে উষ্ণ। এমন সময় বিদ্যুৎ চমকাল। স্পষ্ট দেখতে পেলাম কৃর মুখখানা। ঠিক যেন ক্যামেরার সেন্সরের মতো ওর বিয়ের সাজে মায়াভরা বেদনার্ত মুখটা মগজের অসংখ্য নিউরনে গেঁথে গেল।
৮
কিছুদিন পর। তুলির শেষ আঁচড়ের পরও মনে হলো কৃর চোখের সেই বিদ্যুৎ ঝলকানির রিফ্লেকশনটা ঠিকমতো আসেনি। তবে বেদনাভরা ভালোবাসায় কাতর চোখগুলো স্পষ্ট।
‘কে এই মেয়ে? কখনো দেখেছি বলে তো মনে হয় না। বৃষ্টি বাদলার মধ্যে বিয়ের শাড়ি পরা, তাও আবার গ্রামের রাস্তা। কোনো কিছুই তো মিলছে না।’
‘মিলামিলির দরকার কী। ও হচ্ছে কৃ। ওর সঙ্গে কিছুই মিলবে না।’
‘কী নাম? কিরিমিরি?’
‘যা খুশি বলো।’
‘ওহ। তা হলে প্রেমিকা জুটিয়ে ফেলেছো?’
‘হুম। এ প্রেমিকা উড়তে জানে।’
‘উড়বেই তো, অল্পবয়সী মনে হচ্ছে। পাখা তো গজাবেই।’
নির্লিপ্ততা নিয়ে চলে গেল রেশমা। তার ফিরে আসার গল্প আপাতত তোলা থাক। আমি ডুবে আছি কৃর সঙ্গে কাটানো শেষের দিনগুলো নিয়ে।
গত সাত দিন ধরে দেখা নাই। কোথায় গেছে জানি না। হুট করে আবার গায়েব। তবে আমি নিশ্চিত আবার কোনো না কোনো উদ্ভট জায়গায় তার সঙ্গে আমার দেখা হবে।
তারপর? ওই রাতের পর কী ঘটেছে? আমাকে নিয়ে আর উড়তে পারেনি কৃ। অনেক রক্তক্ষরণের কারণে আমারও চোখে ঘুম জেঁকে আসছিল খুব। ভোর পর্যন্ত দুজন কাকভেজা হয়ে বসেছিলাম একটা টং দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চে। আমার জ্বর এসেছিল এটুকু মনে আছে।
ভুলে যাওয়ার মতো যদিও যথেষ্ট সময় পার হয়নি তবুও আমার স্মৃতিটা ঝাপসা। কৃর কোলে মাথা রেখে একসময় ঘুমিয়েই পড়ি। পরে মাঝে একবার আবিষ্কার করলাম আমি দুলছি। এর মধ্যে সম্ভবত স্বপ্নেই হবে, আমরা উড়ছিলাম। আকাশ-মাঠ পেরিয়ে আমার বাসায় এসে পড়েছিলাম। পরেই আবার দেখলাম একটা অচেনা বাস স্টেশন। কৃ আমার ব্যান্ডেজ বদলে দিলো। কী যেন একটা লাগাল, প্রচণ্ড জ্বালা করেছিল। আমাকে ধরে ধরে একটা টয়লেটেও নিয়ে গেল একবার। তারপর পানি খাওয়ালো অনেক। একটা মিষ্টি ফলও খেলাম। এর মাঝে আবার কাকে যেন বলতে শুনলাম, হাসপাতালে নিয়ে যান আপা।
হাসপাতালেও গিয়েছিলাম সম্ভবত। নাকি ক্লিনিক ছিল ওটা। মোটকথা ওই ঘটনার পর দিন কৃ আমাকে নিয়ে দারুণ ঝামেলায় পড়েছিল। একবার ভাবলাম ওকে বলি, আমার এক বড় খালা আছে শ্যামলীতে। তার বাড়ি নিয়ে চলো। কিন্তু রেশমার জায়গায় কৃকে দেখলে ঝামেলা আরো বাড়তো।
পরদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে। অ্যাডভেঞ্চার হয়েছিল খুব। ওই ওঝা বেঁচে গিয়েছিল। পরদিনই মামলা করতে গিয়েছিল আমার নামে। আমার ছবি ছিল তার কাছে। কারণ ওই রাতের অনুষ্ঠানে কিশোর কিশোরীরা অনেক ছবি তুলেছিল। সাক্ষীর অভাব ছিল না। কিন্তু পুলিশ নিশ্চয়ই বেশ বিভ্রান্তিতে পড়েছিল। একটা অচেনা মানুষের বিয়ের আয়োজন কেনই বা করেছিল ওরা, কেনইবা সেখানে আচমকা একদল মানুষ এসে বলল, তারা আমাদের উড়তে উড়তে নামতে দেখেছে। ওই পেটমোটা ওঝাই বা কী করতে গেল ওই বাড়িতে। এসব হিসেব মেলাতে গিয়ে মামলাটা শেষপর্যন্ত হলো না।
যাই হোক, এ সবে আমি পাত্তা দিলাম না। হোক মামলা। ধরা পড়ার ভয়ে ভয়ে থাকি। অন্তত আরেকটা উত্তেজনা থাকুক এ জীবনে।
খবরটা যখন কৃকে জানালাম, তার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। তার অপরাধবোধের মাত্রা মানুষের তুলনায় একটু বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। আমি হাই তুলতে তুলতে বলেছিলাম, চলো আমরা উড়ে উড়ে নরওয়ে চলে যাই। ভিসা টিসা তো লাগবে না। দেশটা আমাকে খুব টানে। বছরের ছয় মাস সন্ধ্যার বিষণ্নতা। কৃ জবাব দেয়নি। সে কি তার ওড়ার ক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে? সে কি আগের মতো আমার মন পড়তে পারছে না? না পড়তে জানলে মহাবিপদ। আমি যে কী পরিমাণ তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি এটা ওকে জানাতে না পারলে আমার খাবার হজম হবে না।
ওই ঘটনার পরের দিন বা তারও পরের দিন আমরা ট্রেনে করে সিলেট গিয়েছিলাম। সেখানে একটা হোটেলে উঠেছিলাম। রাতে একসঙ্গে ঘুমিয়েছি। কৃর সঙ্গে সাধারণভাবে রাত কাটানো সেবারই প্রথম। কারণ এর আগের মদিরা রেস্তরাঁর আন্ডারগ্রাউন্ড বারের আলো-আঁধারির ঘরটার স্মৃতি আমার মাথায় নেই। কৃর থাকতে পারে। তার ভেতর বাড়তি উত্তেজনা দেখা গেল না ওই রাতে। তবে আমার হাত কাঁপছিল খুব। শারীরিক কোনো টান অনুভব করিনি। বসে বসে হাত ধরে গুটুরগুটুর আলাপ করবো এমনটাও হয়নি। মিলেমিশে একাকার হওয়ার মতো অনুভূতি ছেঁকে ধরেছিল আমাদের। কৃ আমাকে বার বার পেঁচিয়ে ধরেছিল শিকার ধরার মতো। আর আমার মনে হচ্ছিল তার শিকার হতে পারাটাই যেন ওই রাতে আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। রাতটা ঠিক রাত ছিল না। যেন মহাকালের এক বিশাল অপেক্ষা। সেদিনের গ্রহ নক্ষত্রেরা যেন এ রাতেরই অপেক্ষায় ছিল। আমাদের মিলন যে অপেক্ষার অবসান ঘটাল।
পরের সারাদিন কেটেছে রাতারগুলে। ছইওয়ালা নৌকা ভাড়া নিয়েছিলাম। বৃষ্টিতে বসে একদিকে ঘন সবুজ আর নিরিবিলি রাতারগুল, অন্যদিকে লাল শাড়ি পরা কৃ। আগের রাতের পর থেকে আমার সঙ্গে হুঁ হাঁ ছাড়া কথাই বলেনি।
‘তোমার অন্য কৃরা কোথায়?’
‘ওরা খুঁজে পাবে না।’
‘কেন!’
‘আমি মনে হয় মানুষ হয়ে যাচ্ছি। ওরা মানুষদের দেখতে পারে না।’
‘মাই গড! মানুষ হলে তো মহাবিপদ। দুদিন পর আমার কাজেকর্মে বিরক্ত হয়ে যাবে। তিন দিন না যেতে বিয়ে করতে বলবে, এরপর…।’
‘এরপর আমি চলে যাব।’
‘যাবে কোথায় তুমি। তুমি তো এখন কৃ না। তোমার ক্ষমতাও নেই। একা মানুষ মানেই মহা মুশকিল। থাকবে কোথায়!’
‘তুমি আছো কী করতে!’
‘আমি কেন আছি আমি নিজেও জানি না। তুমি আছো বলেই আমি আছি। ব্যাপারটা দিনে দিনে জটিল হয়ে যাচ্ছে। দেখা যাবে পরে আমি থাকলে তুমি নাই, তুমি থাকলে আমি নাই।’
‘হয়ত এর চেয়েও জটিলতা অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।’
কৃর হেঁয়ালী ধরতে পারলাম না। তবে মনে হলো এই হেঁয়ালীটা পদার্থবিজ্ঞানের জটিলতর কোনো তত্ত্বের মতোই মজার।
‘তা হলে আর দেরি কেন। আরো জটিল করা যাক।’
‘কী করে!’
আবার সেই চকচকে চোখ দেখতে পেলাম। মনে হলো অন্য কোনো প্রেমের উপন্যাস হলে এখন কৃ মহাবিরক্ত হয়ে বলতো, যাচ্ছেতাই বকো না, দুপুর হয়েছে, খাবে এখন।
নৌকা ভেড়ানো হলো একটা নির্জন ঘাটে। মাঝি বৃদ্ধ হলেও বেশ সুঠাম। তিনি আমাদের মতো আহ্লাদি দম্পতি দেখে অভ্যন্ত। চুক্তি অনুযায়ী স্থানীয় ছোট মাছের চচ্চড়ি আর ভাত রান্না শুরু করেছেন। বেশ আয়েশ করে খেলো কৃ। তার খাওয়ার দৃশ্য দেখে আমার মনে হলো এখানে একটা বাসাটাসা ভাড়া করে থাকা যায়। কিন্তু কী যেন মিলছিল না। আমার চেনা কৃ তো এমন না। আমার কৃ! আহা, আমার কৃ বলে ফেললাম কী চমৎকার করে।
নৌকাযাত্রা শেষে আবার আমরা ঢাকার পথ ধরলাম। আমার বাসায় ফেরাটা খুব জরুরি? কথাটা কৃকে জানাতেই সে তার খুব চেনা সেই দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, চলো সেন্ট মার্টিন যাই। আজ ঝড় আসতে পারে। ঝড় দেখবো। ভয় পেও না। তোমাকে ভাসিয়ে রাখব।
‘আমি তো ডুবতে চেয়েছিলাম।’
‘ডুবও দেব প্রিয়।’
আহা! মনে মনে ওমর খৈয়ম সাহেবকে বললাম, ধন্যবাদ জনাব। এই মুহূর্তটাই তো আমাদের জীবন। আর এই মুহূর্তে আমাদের চেয়ে সুখি কেউ নাই।
কথাটা শব্দ করে বলেছিলাম নাকি মনে মনে, সেটা জানি না। তবে আমাদের তৃতীয় দিনটা ছিল আরো অন্যরকম।
জেটিতে পা রাখতেই কৃর প্রথম কথা হলো আমরা কোনো হোটেলে উঠবো না। কোনো একটা বাসাবাড়িতে উঠবো।
আমার কাছে দুটোর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। সারারাত সৈকতে পড়ে থাকব টাইপ কথা না বললেই বাঁচি। কৃর ক্ষমতা এখন বলা যায় নেই। ওঝা ব্যাটার দুই পায়ের মাঝ বরাবর কষে লাথি মারার ইচ্ছে হলো। কিন্তু কৃ আমার হাত ধরে যেভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাতে ভয়ানক ইচ্ছেগুলোও কেমন যেন প্রজাপতির মতো ঝলমলিয়ে উড়ে পালিয়ে যেতে লাগল। ওঝার বিষয়টা পরে দেখব ভেবে চলে গেলাম রাস্তা ধরে।
আধাঘণ্টা ঘুরেও কোনো বাড়িঘর মিলল না। ঝড়ের মৌসুম। হোটেল এমনিতেই সস্তা। রিসোর্টের অভাব নেই। শেষে একটা রিসোর্টেই উঠলাম। জানালা দিয়েই সমুদ্র দেখা যায়।
আমার সঙ্গে ল্যাপটপ, ফ্যাবিয়ানো পেপার আর জলরং সবই আছে। লেখালেখি আর আঁকাআঁকি চলবে সমানতালে। সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ চলে যেতেই মোমবাতি জ্বালানো হলো। ঘরের জানালা খোলা। হু হু করে বাতাস আসছে। মোমের আলো তরতরিয়ে কাঁপছে।
গোটা রিসোর্টে আমরা দুজন আর একটা পরিবার। তারা দুয়েকবার আমাদের সঙ্গে ভাব জমাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। কৃর ব্যাপার স্যাপার এখন ভিন্ন। সহজে অন্য মানুষের সঙ্গে মিশছে না। আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখলেই কেমন সিঁটিয়ে আসছে। অস্বীকার করবো, এটাও আমি উপভোগ করছি বেশ।
সারাদিন বের হইনি। সন্ধ্যার দিকে কৃ গোসল সেরে বের হলো। কথা ছিল রাতে আমরা সমুদ্রের তীরে যাব মাছ ভাজা খেতে আর ঘুরতে। কৃকে দেখে মনে হলো তার ইচ্ছে নেই। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। আমি ঝপাং করে লাফ দিয়ে তার কোলে শুয়ে পড়লাম।
‘তোমার মানুষ হবার প্রক্রিয়া কতদূর। পুরোপুরি হয়ে গেলে বোলো। আমি ভাগবো। কারণ মানুষ আমার ভালো লাগে না।’
কৃ কিছু বলল না। গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে তাকে রাগানোর অনেক কৌশল খাটাচ্ছি। সব বিফলে যাচ্ছে। তবে চেষ্টা চালাতে মজাই পাচ্ছি।
‘শোনো কৃ। রেশমার সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়নি এখনো। বিয়ে টিয়ে করতে পারব না। আগেই বলে দিচ্ছি। আমরা এনজয় করবো, কী বল। তারপর দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে যাবে বেঁকে। একদম নব্বই ডিগ্রি।’
‘তুমি এনজয় করতে জানো? কিছু শিখেছো?’
‘অ্যাঁ..! ইয়ে। কী যে বল তুমি। হুহ।’
‘তোমাকে কেউ কিছু শেখায়নি। আমি ছাড়া।’
‘এসব আবার শেখাতে হয় নাকি?’
‘ইজেল আনোনি কেন? আমার ছবি আঁকবে না?’
‘ইজেলে আঁকি না। আমি ভাব ধরা শিল্পী। ফ্লোরে রংটং ছিটিয়ে হাত দিয়ে আঁকি। মন চাইলে তুলি দিয়ে। হাতের কাছে যা পাই তা-ই।’
‘আমি এখন নগ্ন হবো। আর তুমি আমাকে দেখে দেখে ছবি আঁকবে। কিন্তু আমাকে আঁকবে না। আঁকবে অন্য কিছু। আমাকে দেখে তোমার যা মনে আসবে সেটাই আঁকবে। যদি ছবি ভাল না লাগে…।’
‘প্লিজ, তা হলে শাস্তি হিসেবে গভীর সমুদ্রে নিয়ে ফেলে দেবে আমাকে। কথা দাও।’
কৃ কথা দিল না। কাপড় ছাড়তে শুরু করলো। ভেজা চুলগুলো ঝেড়ে ছড়িয়ে দিল পিঠে। ওর শরীরের বর্ণনা দেওয়ার ইচ্ছে হলো না আমার। কেবল মনে হলো একটা প্রাগৈতিহাসিক অথচ চকচকে ব্রোঞ্জ মূর্তি দেখছি। আলো আঁধারিতে কোনো এক দামি জাদুঘরে রাখা হয়েছে যেটাকে।
কিন্তু ও কৃ। শুধু কৃ। ভিন্ন মাত্রার জ্যামিতি। কঠিন এক উপপাদ্য। যার সমাধানের সাধ্য নেই কোনো গণিতবিদের।
শুয়ে পড়ল কৃ। এক হাত ঘাড়ের কাছে দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। মোমের আলোটা তার শরীরের ভাঁজে ঢেউ খেলে পিঠ বেয়ে নিচের দিকে চলে যেতে চাইছে তিরতির করে। আলোটাও যেন কৃকে সমীহ করে ধীরে ধীরে অন্ধকারে ঢেকে ফেলল নিজেকে। কোমরের বাঁকের ওপরে বাইরে থেকে আসা আলোর হাইলাইট। সেটা আবার ব্লেন্ড হয়ে নেমে গেছে নিতম্বের খানিকটা উপরে, মেরুদণ্ডের কাছে। নাহ, কৃ কে আঁকার মতো শিল্পী আমি নই। আঁকতে হবে অন্য কিছু। আমি কৃর বাহুতে হাত রাখলাম। কিছু কিছু বাংলা শব্দই তৈরি হয়েছে এ ধরনের অনভূতির জন্য। এর মধ্যে বেশ আদুরে একটা শব্দ হলো পেলব। যার মানে অত্যন্ত কোমল। আবার ভঙ্গুর। কৃ কি ক্রমে ভেঙে পড়ছে? নাকি আমি?
ওই রাতে আর কাগজের ওপর জলরঙে ছবি আঁকা হলো না। ছবি আঁকা হয়েছে শরীরে শরীরে।
আমার শার্টের বোতামগুলোকে কিভাবে যেন জাদুকরের মতো হাত বুলিয়েই খুলে দিল নিমেষে। তারপর গলা জড়িয়ে ধরে চোখ বুঁজে বলে, ‘কই! কিছু আঁকছো না যে!’
আনাড়ির মতো কৃর কোমর জড়িয়ে ধরলাম। সে চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করলো আমার জন্য। আমি তার গলার উত্থিত হাড়ে চুমু খেলাম, বেশ সময় নিয়ে। আমাকে কেউ কিছু শিখিয়ে দেয়নি। কৃর গলা, চিবুক সব আমাকে যেন নতুন করে পাঠদানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দেয়ালের ঘড়িটা ফের আটকে গেল সময়ের চক্করে। রঙের ছটায় আমরা দুজন ক্রমে হয়ে উঠলাম বিমূর্ত শিল্পকর্ম। ইচ্ছেমতো রং মাখিয়ে দিলাম কৃর গলায়, বুকে, স্তনে। চুমু খেতে গিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতো ঠোঁটের ছাপ বসে গেল কোমরে। এরপর শুরু হলো ঝড়। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট বিন্দু বিন্দু হয়ে জমেছিল তার ঠোঁটে। আর ঠিক তখুনি যেন খুব তৃষ্ণা পেয়েছিল আমার। কানের মাঝে এক অশরীরি অথচ ভীষণ শরীরি এক অনুভূতি।
কৃ ফিসফিস করে আওড়ে গেল তার নিজের ভাষায় কিছু কথা। সেই ভাষায় মেশানো প্রেমের মদিরা। তার নিঃশ্বাসের স্রোতে ভেসে আসছে বিচিত্র শব্দগুলো। মিলনের মন্ত্রপাঠ করছে ও।
আমার নিউরনে নিউরনে স্ফূলিঙ্গের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে দিয়ে গেল সেই মন্ত্র। কৃর এমন সান্নিধ্য উপভোগ করার জন্য মানুষ হিসেবে নিজেকে বেশ তুচ্ছ মনে হলো। আবার মনে হলো আমার চেয়ে সুখি বুঝি কেউ নেই আর। কৃও কি আমার মতোই সুখি? শরীরি জ্যামিতির সমাধানে ব্যস্ত ছিল আমার হাত, আঙুল আর চুম্বনগুলো। কৃর চোখে জমছিল পানি। আর আমার নিজেকে মনে হচ্ছিল দারুণ অসহায়।
৯
অচেনা পাখির শব্দে ঘুম ভাঙল। পাখি আমি কম চিনি। হয়তো সেটা বুলিবুলিই ছিল। পাখিরাও ইদানীং মানুষ হয়ে যাচ্ছে নাকি। পাশ ফিরে শুলাম। ঘুম ছুটে যাওয়া যাকে বলে সেটা ঘটল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। চোখ ডলে নিলাম ভালো করে। মগজটা হুট করে প্রসেস করতে পারছে না। কম্পিউটার হলে এতক্ষণে হ্যাং করে বসে থাকতাম। কিন্তু মানুষের মগজ হ্যাং করে না। অদ্ভুত সব যুক্তি এনে বের করে। আমার মাথাও তেমন একটা যুক্তি খুঁজতে শুরু করলো। কিছু খোঁড়া যুক্তি পেয়েও গেল। আমার পাশে যে শুয়ে আছে সে কৃ নয়, রেশমা!
‘আমার ধারণা আমার মাথা পুরোপুরি গেছে।’
‘মোটেও না। মাথা যায়নি। আপনি যে বুঝতে পেরেছেন আপনার একটা সমস্যা হয়েছে, মনে করেন এতেই অর্ধেক রোগ সারা।’
আমি জানতাম ডাক্তার শরফুদ্দিন এ টাইপ একটা কথাই বলবেন। আমি অপেক্ষায় আছি তার প্রেসক্রিপশনের। ওষুধের নামও বলে দিতে পারবো। তিনি আমাকে আপাতত ক্লোনাজেপাম গ্রুপের কোনো একটা ওষুধ লিখে দেবেন। যেটা আমাকে কয়েকদিন ঘোরের ভেতর রাখবে। রাতে ঘুম হবে চমৎকার। পরে দেখা যাবে ওটা ছাড়া আমার আর ভালোই লাগছে না। ওষুধ না খেলেই ফিরে আসতে শুরু করবে কৃ। শুধু কৃ না, সঙ্গে পরিবারশুদ্ধ নিয়ে আসতে পারে।
গল্পটা বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। গল্প বলার ক্ষেত্রে সতর্ক লেখকরা লিনিয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করেন। মানে সময় ধরে ধরে ঘটনাপ্রবাহ সাজানো। একটা ঘটনার পর আরেকটা। লাইন ধরে ঘটনারা এগিয়ে যাবে। গল্পের ডালপালা যতই ছড়াক, সময়ের মেরুদণ্ড বেয়ে এগিয়ে চলবে ঠিকই। আমার বেলায় সেটা হচ্ছে না। তারপরও যতটা সম্ভব ধারাবাহিকতা রক্ষা করার চেষ্টা চলুক।
সেন্ট মার্টিনে সকালবেলা রেশমাকে দেখে আমি চমকে গেলেও আমার মস্তিষ্ক ধাতস্ত করে নিল নিজেকে। যেন অদৃশ্য কেউ একজন আমার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলল। রেশমার ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। চাদর জড়িয়ে আমার দিকে চোখ কুঁচকে তাকাল। আগের মতো নির্লিপ্ততা নেই সেই চোখে। আছে চিন্তার ছাপ। তারমানে আমি নিশ্চয়ই গত কয়েকদিন ধরে তার সঙ্গে অদ্ভুত আচরণ করছিলাম। সত্যিই কি তাই? নাকি আমার সঙ্গেই অদ্ভুত ঘটনাগুলো ঘটেছিল?
‘এত সকালে উঠলে কেন। এদিকে আসো। কাছে আসো।’
এ কথার মানে আমি জানি। সে এতটা আমুদে গলায় ডাকছে যে কাছে যেতেও ইচ্ছে করছে। আমি কাছে গেলাম। উষ্ণতা নিলাম রেশমার শরীরের। সাত বছরের চেনা গন্ধটাও পেলাম। নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে কৃ আমাকে শেষ পর্যন্ত দখল করতে পারেনি। কারণ আমি সত্যিই রেশমার সান্নিধ্যে কেমন যেন একটা নিরাপদ বোধ করতে লাগলাম।
এদিকে গতরাতের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি নিঃশ্বাসের স্মৃতি যে একদম তরতাজা! হায় কৃ! তোমাকে বোঝা গেল না।
আমি বর্তমান সময়ের রেশমাকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘আজ কত তারিখ?’
‘আজ ১৩ এপ্রিল। তোমার ছুটি। কালও ছুটি। এ জন্য বেড়াতে এসেছি। আর কিছু জানতে চাও?’
‘আমরা এখানে কবে এসেছি?’
‘তোমার কী হয়েছে? খিদে পেয়েছে? নাকি সুগার কমে গেছে?’
‘আমরা কবে এসেছি?’
‘দুদিনও তো হয়নি। কেন? চলে যাবে?’
‘তৈরি হও। ঢাকা যাব। আমার কিছু ভালো লাগছে না। এই সব সমুদ্র টমুদ্র ফালতু জায়গা। এত লোনা পানি দেখার কী আছে। এর চেয়ে তোমাদের গ্রামের বাড়ির পাশে জঙ্গলের ভেতর যে পুকুরটা আছে সেটার পাড়ে গিয়ে বসে থাকি চলো।’
যথারীতি এসবে কাজ হলো না। সেদিন সারাটা দিন রেশমার সঙ্গে আমি সেন্ট মার্টিনে ঘুরে বেড়ালাম এবং একের পর এক ব্যাখ্যা হাতড়ে বেড়ালাম। হতে পারে কৃ আমার কাছ থেকে কৌশলে বিদায় নিয়েছে। রেশমাকে তুলে এনে এখানে হোটেল রুমে রেখে গেছে এবং সম্ভবত তার মগজ ধোলাই করার ক্ষমতাও আছে। অথবা গ্রাম থেকে ঢাকায় ও সিলেটে যাওয়ার সময় কৃর চোখে যে বিষণ্নতা ধরা পড়েছিল, সেটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানে ও আসলে তখনই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে এরপর থেকে আমি রেশমাকেই কৃ ভেবে এসেছি এবং গতরাতে রেশমার সঙ্গেই আমার অলৌকিক এক মিলন হয়েছিল। অন্তত রেশমার ভাবভঙ্গি দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। ও একটু বেশিই চুপচাপ হয়ে গেছে।
পরদিন দুপুরে আমরা টেকনাফ থেকে ঢাকার বাস ধরলাম। পথে বিশেষ কথা হলো না। বেশিরভাগ সময় রেশমা আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। সাধারণত ও যেটা করে না। আমার মন বলছে, ঢাকায় ফিরে ঘুম ভেঙে দেখবো আমার পাশে কৃ বসে আছে এবং তার মুখে ক্রূর একটা হাসি। হাসতে হাসতে বলছে, ‘তুমি জানো না আমি যেকোনো রূপ ধরতে পারি? রেশমার রূপ ধরে দেখলাম, আমার জন্য তোমার টান কতটা।’
আমি কি কৃর পরীক্ষায় পাস করবো?
উদ্ভট এক টেনশন নিয়ে শেষ হলো আমাদের যাত্রা। ঢাকায় ফিরেই দ্রুত পিজির মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের এপয়েন্টমেন্ট নিলাম। ঘটনা যতটা পারা যায় রাখঢাক রেখে তাকে বললাম। তিনি আমাকে কাগজে ছকটক এঁকে অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলেন।
‘…যাকে বলে অবসেসিভ কমপালসিভ সিজোফ্রেনিয়া। এক্ষেত্রে আপনার মগজটা হুট করে অনেকগুলো স্মৃতি তৈরি করে ফেলছে। আপনি ভাবছেন সময় অনেক চলে গেছে, আসলে এক সেকেন্ডও যায়নি। এখন থেকে ডায়রি লিখবেন। দেখবেন সব ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন। আপাতত মনে করে এ ওষুধগুলো খাবেন। আর অবশ্যই পরেরবার আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আসবেন।’
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামতেই লাল গাড়িটায় চোখ আটকে গেল। বেশ দামি গাড়ি। গাড়ির প্রতি আকর্ষণ আমার কখনই ছিল না। তবে এ গাড়িটায় চোখ আটকে গেল। রিয়ার ভিউ মিররে মিষ্টি একটা পরিচিত মেয়ের মুখ। হালকা হলেও বেশ দশাসই মেকআপ নেওয়া। চুলটাও বদলে গেছে। চুলের আগার দিকটা কেমন বাঁকানো। চোখে সানগ্লাস। সব মিলিয়ে বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ধনী ও বিদেশি ডিগ্রি পাওয়া একটা চেহারা।
আমার দিকে তাকাল না মুখটা। আমি কাছে এসে দাঁড়ালাম। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে মেয়েটা আবার ফিরিয়ে নিল মুখ। আমারও কি তাই করা উচিৎ? নাকি প্রথম যেদিন ছাদে হ্যাংলার মতো তাকিয়েছিলাম সেভাবে তাকানো উচিৎ।
‘উঠে পড়ো।’
তালপাকা এই গরমে মনে হলো কানের কাছে বৃষ্টি নেমেছে। দেরি না করে উঠে পড়লাম। আরামদায়ক সিট। ভেতরে এসির বাতাসে মনে হলো মাঘ মাসের শুরু। সিটে বসতেই মন চাইল চাদর মুড়ে ঘুম দেই। রাতে ইদানীং ঘুম একদমই হয় না।
রাস্তায় যানজট নেই। মনে হলো উড়ে উড়ে যাচ্ছি। পেছন থেকে কৃকে দেখাচ্ছে লেটেস্ট স্মার্টফোন ব্যবহার করা পরীর মতো। মাথায় এমন বিচিত্র সব উপমা যখন ভিড় জমাচ্ছিল তখন ব্রেক কষলো কৃ।
নেমে পড়লাম। জায়গাটা ঢাকার কাছেই। উত্তরার আশপাশের একটা জায়গা। কৃ নামল। আমার দিকে এখনো সরাসরি তাকায়নি। সেও কি কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়াচ্ছে?
‘তুমি তো বিজ্ঞান বোঝো। তোমার বিজ্ঞান আর আমার বিজ্ঞান মিলবে না। তবে তোমার ভাষায় বলতে গেলে, তোমার বাস্তবতা আমি কিছুটা বদলে দিয়েছি। তোমার ভালোর জন্যই।’
অবিকল লুনার মতো শোনাচ্ছে কৃর কথাগুলো। আমাকে কঠিন ছ্যাঁকা দেওয়ার পর লুনা একদিন ফোনে আমাকে এ টাইপের কথা বলেছিল। এরপর থেকে কেউ আমার ভালো চাইলেই কেমন যেন আতঙ্কে পড়ে যাই।
‘ওই রাতে আমিই ছিলাম তোমার সঙ্গে। আমাদের রাতটা মিথ্যে ছিল না।’
‘ও। আচ্ছা।’
‘দেখো, এটা মোটেও জটিল কিছু নয়। অন্তত আমার কাছে। তোমরা মানুষরা সময় বুঝতে পারো না দেখে সব জটিল করে ফেল। তুমি ভাবছো কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে সব ব্যাখ্যা করতে পারবে। মোটেও না। একটা বস্তু এক সময়ে একশটা জায়গায় থাকতে পারে, সময়টা আটকে থাকলেই হলো। সহজ ব্যাপার। তুমি এখন এখানে আছো, আবার একটু পর নিজেকে চাইলে… থাক এসব বক বক করে লাভ নেই। খিদে পেয়েছে?’
আমাদের প্রেমের গল্পটা ক্রমে সায়েন্স ফিকশনের দিকে ছুটছে কেন? নিজের ভেতর উত্তর পেলাম না।
‘তোমার সঙ্গে আমার গল্পটা হবে মহাকাব্যিক এক প্রেমের উপন্যাস। কিন্তু এটা ক্রমশ সাইকো-থ্রিলারের দিকে গড়াচ্ছে। ডাক্তার শরফুদ্দিন বলে দিয়েছেন তুমি হচ্ছো আমার অবসেসিভ কমপালসিভ..।’
‘গো টু হেল।’
‘তোমার গেটআপের সঙ্গে সঙ্গে দেখছি পারসোনালিটিও বদলাচ্ছে। ঘটনা কী! এটাও কি কৃদের বৈশিষ্ট্য?’
‘কৃ না ছাই, আমি এখন মানুষ। উড়তে পারি না বুঝলে!’
‘নাহ, তুমি মানুষও না। তুমি হলে ক্ষমতা হারানো সুপারম্যান। তোমার চোখেমুখে নিদারুণ কষ্ট।’
‘আরেকটা কথা বললে তোমার হৃৎপিণ্ড সেদ্ধ করে খাব।’
‘সেদ্ধ করাটা তো অশুদ্ধ আচার। হৃৎপিণ্ড খেতে হয় কাঁচা। চিবিয়ে চিবিয়ে। দুপাশের বড় বড় দুটো সাদা দাঁত বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়বে।’
‘থামবে!’
কৃর পোশাকটা ভালো করে দেখার সুযোগ পেলাম। হালফ্যাশনের একটা কাটাকুটি করা জামা, সঙ্গে জিন্স। জামাটা দেখলে মনে হবে জামা নয়, অন্য কিছু দেখি। চোখ বারবার ইতিউতি চলে যাচ্ছে। পরেই আবার মনে হলো, যাহ, কিছুই দেখা হলো না।
‘এভাবে তাকালে তোমাকে এই ভরদুপুরে রাস্তার মধ্যে ন্যাংটো করে আমি চলে যাব। উড়তে না পারলেও ক্ষমতা কিছু আছে।’
‘নাহ, সে সুযোগ আর পাচ্ছো কই। আমি ঠিক করেছি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব। তুমি আমার সঙ্গে যা শুরু করেছো, তাতে এ সংসার টিকবে না। আই মিন বিয়ে করার আগেই ডিভোর্স। ভালো কথা, একটু পর আবার রেশমা হয়ে যাবে না তো?’
‘কেন? ওকে দরকার? এখন আমাকে ভয় লাগছে? রেশমার বুকের মধ্যে মুখ লুকাবে?’
‘ও বাবা। এ তো দেখি দু মুখো সাপ। ওকে, রেশমার প্রসঙ্গ বাদ। শুধু শেষ একটা প্রশ্ন আছে।’
‘আমি জানি কী বলবে!’
চিবিয়ে চিবিয়ে কথাটা বলল কৃ। আমিও বুঝে ফেললাম যে কৃ জানে এবং কেন এত বিরক্ত।
‘শোনো তোমাদের মানে এই মানুষদের মধ্যে কিছু উজবুক আছে। আগাগোড়া কিছু না বুঝেই নিজেকে বিরাট জ্ঞানী ভেবে ফেলে।’
‘ওঝাকে দেখে আমার জ্ঞানী মনে হয়নি। কিন্তু ঘটানাটা কী ছিল?’
আমার শেষ প্রশ্নটা ছিল ওঝাকে ঘিরে। যার আচরণ কিংবা মন্ত্রপাঠের প্রভাব পড়েছিল কৃর মধ্যে।
‘এখন যদি তুমি একটা উটপাখিকে রকেট কিভাবে কাজ করে সেটা বোঝাতে চাও, তা পারবে?’
‘শেষ পর্যন্ত আমাকে উটপাখির সঙ্গে তুলনা করলে? যাকে তুমি এত ভালবাসো?’
‘কারণ উটপাখি বিপদ দেখলে মাটিতে মুখ গুঁজে রাখে আর ভাবে কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না।’
‘তারপরও চেষ্টা করতে দোষ কোথায়। তা ছাড়া এ জায়গাটা ভাল লাগছে না। কাশফুল উড়ে উড়ে নাকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। তোমার এই ফেরারি গাড়িটা নিয়ে মেরিন ড্রাইভে গেলে মন্দ হতো না। আহা সমুদ্র! এক কাজ করো গাড়িটা বিক্রি করে একটা স্পিডবোট কিনে ফেল।’
‘রিয়েলিটি সম্পর্কে তোমার ধারণা নেই তুষার। যা দেখো সেটাই বাস্তব মেনে নাও। দুচার কলম বিজ্ঞান পড়ে নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবা বন্ধ করো।’
‘আমি লেখক, বিজ্ঞানী নই।’
‘তা তো জানি। প্রেম করা বাদ দিয়ে তোমাকে এখন অনেক কিছু শেখাতে হবে আমার!
আমি বিরাট সাহসের কাজ করে ফেললাম। কৃর রাগী রাগী মুখ উপেক্ষা করে এগিয়ে এসে তার কোমর জড়িয়ে ধরলাম। তারপর খুব কাছ থেকে চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘এবার আমায় কিছু শেখাও মায়বিনী।’
১০
হাত ছাড়িয়ে নিল কৃ। বসে পড়ল একটা খালি জায়গা দেখে। আমি পা ভাঁজ করে বসতে পারি না ভালো করে। ডায়াবেটিক নিওরোপ্যাথিক ব্যথা পেয়ে বসেছে। তারপরও বসলাম।
‘ওর কাছে আমাদের একটা স্ক্রিপ্ট আছে। মানে যেটাকে মন্ত্রটন্ত্র বলো তুমি। আমাকে কাছে না পেলে কিছু করতে পারবে না। কিন্তু, চাইলে ঝামেলা পাকাতে পারে। আমিই প্রথম নই। অনেক কৃর সঙ্গে মানুষের.. যাকে বলে.. মানে যোগাযোগ হয়েছে। প্রেম ট্রেম যে আরো হয়নি তা নয়। এভাবে কৃদের কিছু দুর্বলতার কথা কিছু মানুষ জেনে যায়। তারা সেটাকে নিয়ে একটা কিছু করে… আমাদের ধরাশায়ী করার অস্ত্র বানিয়েছে বলতে পারো।’
‘ওই গ্রামটা খুঁজে বের করতে হবে তা হলে। একেবারে খতম করে দিয়ে আসি ওঝা ব্যাটাকে।’
‘খবরদার এসব বলবে না। ওই দিন যা করেছো, করেছো। দয়া করে ছেলেমানুষী কিছু করতে যেও না। এমনিতে যথেষ্ট চেষ্টা করছি, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। আমি এখন ক্ষমতাহারা পাখি।’
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, ঘুম থেকে উঠে রেশমাকে দেখার রহস্য। আমাকে বাঁচানোর জন্য কৃ আমার গোটা বাস্তবতা বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। বাস্তবতায় প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে।
‘হুম। ঠিক ধরেছো। আই অ্যাম স্যরি। আমার একবার মনে হলো, তুমি যেমন ছিলেন তেমন রেখে আসি তোমাকে। তুমি ভুলে যাবে আমাকে। সেটা আর হলো কই।’
আহা! কৃর চোখে জিতে যাওয়ার আবেশটুকু দারুণ লাগছে। আমি তাকে ভুলিনি, এতে যেন তার বিশ্বজয় হয়েছে।
‘আমি ভুলিনি ভালো কথা। তুমি আবার ভুলে যাবে না তো! এর আগেও কিন্তু চেষ্টা করেছো কৃ। কাজ হয়নি। আমি অবশ্য তোমার ভুলে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত নই।’
‘ওই যে বললাম না, তুমি হলে উটপাখি! চিন্তিত নই বলেই খালাস। সব চিন্তা যেন আমার একার।’
কথাবার্তা ক্রমে দাম্পত্য কলহের দিকে যাচ্ছে। সাবধান হলাম দ্রুত।
‘আচ্ছা, ওই স্ক্রিপ্ট জিনিসটা কী। বুঝলাম না।’
‘ওই ব্যাটা চাইলে কৃদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। অন্যদের ডেকে আনতে পারে। আমাদের যেসব ক্ষমতা সেসব কাজে লাগাতে পারে। আবার চাইলে বাস্তবতা ভ্যানিশ করে দিতে পারে। অনেক কিছু করা সম্ভব। কিন্তু ও সম্ভবত সব জানে না। ও এটা পেলই বা কী করে।’
‘সম্ভবত কামরূপ কামাখ্যায় গিয়ে নিয়ে এসেছে।’
আমার ইয়ার্কিটা ধরতে পারলো না কৃ। তার ভয়ার্ত চেহারাটা দেখতে ইচ্ছে হলো না মোটেও। কৃদের ভাষার কিছু কৌতুক জানলে ভালো হতো। ওর মন ভালো করার একটা চেষ্টা করতাম।
‘তোমার আমার মাঝে যা আছে, সেটাও চাইলে কাটিয়ে দিতে পারে।’
আমি বেশ খানিকটা অবাক হবার ভাণ করে বললাম ‘ও..। আমার আর তোমার মাঝে। আমার আর তোমার মাঝে যে কিছু আছে, মাঝে মাঝে সেটাই তো ভুলে যাই।’
এটা শুনে কৃ যা করলো, তার জন্য লম্বা লম্বা কাশফুলের গাছগুলোকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম না। আমাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে চড়ে বসলো আমার পেটের ওপর। কাশফুলের জন্য আশপাশের মানুষজন আমাদের দেখতে পাচ্ছে না নির্ঘাৎ।
কৃর শরীরে যেন অসুর ভর করেছে। ঘাড়ে হাত রেখে টেনে আমার মুখটাকে নিজের খুব কাছে নিয়ে এলো। ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। এই বুঝি ঠোঁট হারাতে হলো! কিন্তু না। ঠোঁট অক্ষতই রইল। যা হারিয়েছি তা হলো কৃর ভালোবাসার গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন করার সাহস। আমাদের মাঝে সত্যিই অনেক বড় কিছু আছে।
গাড়ি নিয়ে ছুটছি অজানার উদ্দেশ্যে। ভুল বললাম। কৃ জানে কোথায় যাচ্ছি। আমি জানি না।
হঠাৎ কড়া ব্রেক। সিটবেল্ট বাঁধা না থাকলে উড়ে পড়তাম। সামনে পেছনে তাকালাম। সুনসান রাস্তা। কৃর কপালে ভাঁজ। একটা কিছু আঁচ করতে পারছে। আরো ভালো করলে তাকালে মনে হবে একটা কিছু অনুভব করছে ও এবং অবশ্যই তা বাজে কিছু।
কৃর কাঁধে হাত রাখতে গিয়েও রাখলাম না। অভয় দেওয়ার চেষ্টা বৃথা। নিজেকে উটপাখি নয়, বরং বেজি টাইপের প্রাণী মনে হচ্ছে এখন।
‘শোনো তুষার! মন দিয়ে শোনো। তুমি মনে রাখার চেষ্টা করো। সব কিছু। যত কিছু ঘটেছে।’
‘ঠিক কী ঘটতে চলে..।’
কথা শেষ হওয়ার আগে বড় একটা ধাক্কা খেলাম। ধীরলয়ে শূন্যে উঠে ভাসতে ভাসতেই আছড়ে পড়লাম অন্তত বিশ ত্রিশ হাত দূরে। কৃ তার জায়গাতেই আছে। ভীষণ ভয় পেয়েছে মেয়েটা। আমার জেদ চেপে গেল। মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়েই ছুটে যেতে চাইলাম তার কাছে। কৃ হাত বাড়িয়ে আমাকে ইশারা করলো যেন না আসি। আমি থামলাম না। বদলে যেতে লাগল সব। মনে হলো এতক্ষণ ধরে স্বপ্ন দেখছি এবং যেকোনোভাবে স্বপ্নের ভেতরই আমি বুঝতে পারছি যে আমি স্বপ্ন দেখছি।
গাড়ি উধাও। রাস্তাটাও। একটা জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। কৃর পরনের কাপড় বদলে যেতে লাগল ঘন ঘন। দুহাতে কপাল চেপে আছে ও। যেন মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে। নাকি সেও একটা কিছু করার চেষ্টা করছে। কী সেটা?
এমন সময় আবছা একটা ছায়ামূর্তি দেখলাম। কৃর দিকে এগিয়ে আসছে ওটা উড়ে উড়ে। মানুষের অবয়ব নিলেও পুরোপুরি পারেনি। মাথাটা বেঢপ আকারের লম্বাটে হয়ে আছে। এ কি তবে আরেক কৃ?
প্রথমে মনে হলো বাতাসের শব্দ। পরে বুঝতে পারলাম এটা ওদের ভাষা। বোঝার চেষ্টা করা নিরর্থক। মনে হলো লোকটা, মানে অন্য কৃ, যাকে দেখতে অনেকটা আমার এক দুসম্পর্কের ক্রিমিনাল আত্মীয়ের মতো দেখাচ্ছে, সে আমার দিকে একবার কড়া দৃষ্টি হানল। নাহ, ভস্ম হয়ে গেলাম না। কৃ যতক্ষণ আছে চিন্তা নাই। আমার ক্ষতি কেউ করবে বলে মনে হলো না। কৃকে দুর্বলও মনে হচ্ছে না। এভাবে কেটে গেল কিছুটা সময়।
আচমকা আবার হাতে টান পড়ল। কৃ আবার আমাকে নিয়ে ছুটতে শুরু করেছে।
‘আস্তে! ফ্র্যাকচার হয়ে যাবে!’
‘দৌড়াও’
দুদ্দাড় করে ছুটছি। মাঝে মনে হলো উড়েও যাচ্ছি কিছুটা। জঙ্গলের ভেতর। আমরা এখন কোথায়? ঝরনা টরনা আর খাল দেখে মনে হচ্ছে খাগড়াছড়ির মতো কোনো একটা জায়গা হবে। নাকি সীমানা পার হয়ে মিয়ানমারে চলে গেছি! উটকো ঝামেলা পড়লাম দেখি।
‘আমরা অন্য এক বাস্তবতায় আছি তুষার।’
কৃর মুখে আমার নিজের নামটা শুনতেও কেমন যেন লাগল। নাম ধরে ডাকার মাঝেও যে কিঞ্চিৎ প্রেম প্রেম ভাব থাকতে পারে সেটা টের পেলাম। রেশমা কখনো আমাকে নাম ধরে ডাকেনি। ওগো হ্যাঁগো শুনে শুনে কান পচে যাওয়ার দশা। স্ত্রীরা এসব কবে বুঝবে কে জানে! নাকি কখনই বুঝবে না।
আমি থামলাম। এভাবে ছোটা অর্থহীন মনে হলো।
‘কৃ দাঁড়াও।’
আমার কথায় জোরাল এমন কিছু ছিল যে কৃ দাঁড়াতে বাধ্য হলো। তার চোখে উপচে পড়ছে টেনশন। মদিরা বারে যে টিশার্ট আর শর্টস পরে ছিল এখন আবার সেই পোশাক। জঙ্গলে মানাচ্ছে না। কিন্তু কাপড় নিয়ে চিন্তা করার সময় নয় এখন। আমি ভাবলাম। মানুষ হিসেবে কৃর কাছে আমি নিম্নবুদ্ধিসম্পন্ন একটা কিছু হতে পারি। অস্বীকার করবো না যে বিষয়টা কিছুটা আত্মসম্মানেও লেগেছে।
‘শোনো, বিষয়টা বুঝিয়ে বলো। আমার মন বলছে আমি এর একটা বিহিত করতে পারবো।’
‘আমি তোমাকে হারাতে চাই না! আমি জানি না কিভাবে কী করবো! কিন্তু সব ওলট পালট হয়ে যাবে তুষার!’
কৃ আমাকে জড়িয়ে ধরল। কোনো অনুভূতির কণার আদান-প্রদান ঘটল না। মানে এখন সেই প্রেম নয়, কৃকে ছেঁকে ধরেছে একগাদা উদ্বেগ। আমি কৃকে ছাড়িয়ে নিলাম।
‘আসল ঘটনা বল। নকল ঘটনা বলে আমাকে এখন ভোলাতে পারবে না। উটপাখি এখন মাথা তুলে তাকাবে।’
‘রিরিসা এসেছিল। সে তোমাকে কেড়ে নেবে। সে আমাদের বাস্তবতা বদলে দেবে। এটা মানুষ…।’
‘ও এটা ওই হতচ্ছাড়ার নাম? তা তোমার নামটা তো বললে না। তোমার নাম কি নিরিশা?’
‘আমি তোমার কৃ। শুধু কৃ। তুমি বুঝেছো আমি কী বলেছি?’
আমি পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমে আরো ভারী হতে লাগলো। ঘোলাটে ভাবটা কাটছে না। আমার মনে হলো একটু পর আমার ঘুম ভাঙবে। নিজেকে আবিষ্কার করলো পুরনো সেই বেডরুমে। যেখানে এক সময় পা দুলিয়ে আমি আর রেশমা বসে কৃর অর্ডার করা বিরিয়ানি খেয়েছিলাম। সম্ভবত ওটাই আমার আসল বাস্তবতা। হয়তো বা নয়। ভাবতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেলাম। কৃ তো মনের কথা পড়তে পারে, ভুলেই গিয়েছিলাম!
‘ও! তুমি তাই চাও? বলো! মুখেই বলো। বললে এই মুহূর্তে সেটা হয়ে যাবে।’
‘আর তোমার? তুমি কোথায় থাকবে তখন?’
‘আমার চিন্তা তোমার আছে? সত্যি করে বলো, তুমি আমাকে ভালোবাসো?’
এই প্রথম মনে হলো মানুষের মতো একটা প্রশ্ন করেছে কৃ। নিরবতাকে আপাতত সম্মতির লক্ষ্মণ ধরা যাক। কিন্তু আমার কেন যেন নিরব থাকতে ইচ্ছে করছে না। আজ সকালেই ডাক্তারের কথা মতো এক পাতা রিলাক্সেশন ট্যাবলেট কিনেছি এবং অর্ধেকটা সাবাড় করে ফেলেছি এরইমধ্যে। কৃ খেয়াল করেনি অবশ্য। মাথাটা কেমন ফাঁকা মাথা। ফাঁকা মাথা কবিতার কারখানা। আমি নিজেই ইদানীং সায়েরি লেখা শুরু করেছি। এবার সাহস করে শব্দ করেই কৃকে বললাম, ‘এটা গালিবের দুর্ভাগ্য যে সে তোমাকে ভালোবাসি বলতে পারেনি। আর আমি তো ভাগ্যেই বিশ্বাস করি না।’
‘উফফ.. তোমরা মানুষরা এই একটা জিনিস পারো!’ পট করে আরেকটা চুমু খেল কৃ। আমিও বুঝলাম না আমি ঠিক কী আওড়ে গিয়েছি খানিক আগে। তবে যেটাই বলি না কেন, কৃর ক্ষমতাকে ধন্যবাদ দিলাম। সময়ে সময়ে মনের অবস্থা বুঝে নেওয়ার ব্যাপারটা মন্দ না। রেশমা জীবনেও সেটা পারবে না।
‘যাক, এ যাত্রা জিতে গেলাম। এখন এক কাজ করো। একটা বুদ্ধি এসেছে। তুমি আমাকে সেই গ্রামে নিয়ে চলো। ওঝার সঙ্গে বোঝাপড়া বাকি। আর তোমার কাছে আমার একটা বাসর রাতও পাওনা আছে।’
কৃর চোখ আবার আর্দ্র হতে শুরু করলো। আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘একটা কেন, আমাদের হাজার রূপে হাজারটা বাসর হবে। আমি সব ঠিক করে দেব। সব।’
আমি বোকার মতো মাথা নাড়লাম। যেন আসলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
জঙ্গলে অস্বাভাবিক বাতাসটা টের পেয়েছি আগেই। অবচেতন মন সতর্ক হয়ে গেল খানিকটা। এবার আর ছিটকে পড়লাম না। কৃকে শক্ত করে ধরে রেখেছি। বলা যায় সে-ই আমাকে ধরে রেখেছে। সামনে আবার সেই ছায়ামূর্তি।
‘রিরিসা! কৃর কাছে কী চাও তুমি!’
এলিয়েনের মতো দেখতে উড়ন্ত লোকটা আমার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। হয়তো এখনো মানুষের মতো এক্সপ্রেশন দেওয়া শেখেনি।
‘কৃ তুমি এখনো সিদ্ধান্ত নাওনি?’
পরিষ্কার গমগমে মানুষের কণ্ঠে কথাটা বলল লোকটা, নাকি প্রাণীটা বলবো? আশা করেছিলাম চিঁ চিঁ জাতীয় একটা শব্দ শুনবো। লোকটা সম্ভবত আমাকে শোনাতেই কথাটা বাংলায় বলেছে।
কৃর দিকে তাকালাম। ও মাথা নিচু করে আছে।
‘কী চান আপনি?’ তুমি থেকে আপনিতে গেলাম। কাজ হলো না। রিরিসার চোখের দৃষ্টি বদলালো না। হাত-পা ছুড়ে একটা কিছু করতে যাবে, তার আগেই কৃ তাকে থামাল।
‘প্লিজ রিরিসা! আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না। এর জন্য যেটা স্বীকার করতে হয় করবো।’
কী বলছে কৃ? কী স্বীকার করতে হবে তাকে। লোকটাই বা অমন চোখ বুঁজে ধ্যান করছে কেন? উত্তর না পেয়ে আমি কৃকে আরো শক্ত করে ধরে রাখলাম।
মগজে শিরশিরে অনুভূতিটা পেতেই বুঝতে পারলাম কী ঘটতে চলেছে। রিরিসা আমার মাথার ভেতর ঢুকে একটা কিছু ঘটানোর চেষ্টা করছে। হয় আমার স্মৃতি নষ্ট করবে কিংবা নতুন কিছু যোগ করবে। ততক্ষণে আমারও একটা বুদ্ধি এসেছে। একটার পর একটা হিজিবিজি জিনিস ভাবছি। হিজিবিজি ভাবতে আমার জুড়ি নেই। লেখালেখির সময় ব্রেইনস্টর্মিং করতে হয় অনেক। সেটাই করছি। হাজারো উপমা, জীবনানন্দের বিষণ্ন কোনো পেঁচা, বিনয় মজুমদারের স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যাওয়া ফড়িং, গালিবের শূন্য মদের গ্লাস; রিরিসা হার স্বীকার করতে বাধ্য হলো। শুধু হারই স্বীকার করলো না। আমার হিজিবিজি ভাবনা থামাতে তেড়ে এলো আমার দিকে। বাধা হয়ে দাঁড়াল কৃ। তিন হাত দূরে থামল রিরিসা। কৃর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তোমার ভালোবাসায় সম্মান করি কৃ। কিন্তু ও দুর্বল, ও ক্ষণস্থায়ী। ওকে তোমার হারাতেই হবে। তুমি আমার সঙ্গে চলো। তা না হলে তুমি জানো কী ঘটবে।’
‘আমি দুর্বল নারে রিরিসা! তুই দুর্বল! তোর চৌদ্দগুষ্টি দুর্বল। হারামজাদা এখান থেকে ভাগ, না হয় তোকে বটি কাবাব বানাবো!’
কাঁহাতক আর মাথা ঠিক রাখা যায়। আমার গালিগালাজ শুনেও রিরিসার ভাবান্তর হলো না যদিও, তবে অবাক হলো কৃ। এতটা সাহস আশা করেনি? হাসলাম। ডাকাতের কল্লা ফেলে দেওয়া লোক আমি। এ চিন্তটাই সাহস যোগাচ্ছে আপাতত।
‘কৃ তুমি টেনশন করো না। তুমি সাথে থাকলে এই রিরিসাকে সরিষা খাইয়ে দেব।’
রিরিসা চোখ বুঁজে কী যেন বিড়বিড় করছে। মন্ত্রপাঠ চলছে! আফসোস, এত কিছু লিখি, কেন যে দুচারটা জাদুমন্ত্র শিখলাম না।
কৃ আমাকে আরো শক্ত করে ধরেছে। এবার কবজির হাড়টা বুঝি ভাঙবে আমার। রিরিসার দিকে হাত উঁচিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলো কৃ। কিন্তু উল্টো আমাকেসহ পেছনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বুঝতে পারলাম কৃর চেয়ে বেশি শক্তি রাখে ওই রিরিসা। শুধু বুঝতে পারলাম না যে কী ঘটতে চলেছে। কৃর কথা মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম। বাস্তবতা সংক্রান্ত একটা কিছু। পুরোটা মনে পড়ল না।
খানিক পর বদলে যেতে লাগল দৃশ্যপট। আমার চোখে নেমে আসতে লাগল ঘুমের সুনামি। কানে বহুদূর থেকে বাজছে কৃর অস্পষ্ট কিছু কথা। ‘তুষার, আমায় খুঁজে বের করবে। কথা দাও। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, লক্ষীটি আমার, আমাকে খুঁজে বের করবে তুমি।’
কৃর কণ্ঠে প্রবল আকুতি আতঙ্ক আর প্রেম সব মিলেমিশে একাকার। আমার বুকের হাহাকার কি ও শুনতে পাচ্ছে। কোথায় খুঁজবো ওকে। কোনোমতে কৃর হাত ধরতে চাইলাম। পারলাম না। মনে হলো সে অনেক অনেক দূরে। আবার খুব কাছে।
রিরিসাকে দেখালাম উড়াল দিতে। ওঝার মতো ওকেও থামাতে হবে। তবে এখন নয়। সময় হোক। কিন্তু কৃ কোথায় যাচ্ছে যে তাকে আমার খুঁজে বের করতে হবে।
আমিও যেন কোথায় হারিয়ে যেতে শুরু করেছি। মারা যাচ্ছি না। তবে বদলে যাচ্ছি। আমার নিজের নামটাও মনে পড়ছে না। শুধু মনে হচ্ছে কাকে যেন আমি খুব ভালোবাসি। একটি বার তার হাতটা ধরতে না পারলে আমার বেঁচে থাকাটা অর্থহীন।
১১
দেয়াল ঘড়িরটার দিকে তাকিয়ে আছি অনেকক্ষণ। কিন্তু কটা বাজছে বুঝতে পারছি না। ঘোর টোর লাগেনি। ঘড়ির ডিজাইন এমনভাবে করা যে সেকেন্ডের কাঁটা ঘণ্টার কাঁটা আলাদা করা মুশকিল। দুটোরই এক সাইজ। বারোটা দশ বাজে নাকি দুইটা, বুঝতে পারছি না।
পিঠে ধাক্কা লাগতেই উঠে দাঁড়ালাম।
‘বাস ছাড়বে। উঠ।’
আমার বন্ধু মঞ্জু। ফ্রিল্যান্সিং কাজ করে বেড়ায়। সারা বছরই ছুটি কাটানোর আমেজে ঘুরে বেড়ায়। মঞ্জুর সঙ্গে আমিও একটু বোহেমিয়ান হওয়ার চেষ্টায় আছি। বিয়ে টিয়ে করিনি। আয় রোজগারও খারাপ না। এদিক ওদিক হুট করে ঘুরতে যাওয়াটা নেশা হয়ে গেছে আমাদের।
বাস ছাড়বে সোয়া বারোটায়। ব্যাপক আরামদায়ক বাস। শুয়ে ঘুমানো পর্যন্ত যায়। কিন্তু সিট বেল্ট নেই। মনের খুঁতখুঁতে ভাবটার কারণে আমার ঘুম পেল না।
আধ ঘণ্টা না যেতেই মঞ্জু ঘুমে কাদা। আমি জেগে আছি রাতের পাখির মতো। দামি বাসে শব্দ কম। মনে হচ্ছে ভেসে ভেসে এগোচ্ছি। এর মধ্যে জুলাই মাসের ঘোর বরষা। বৃষ্টির ছাঁটে বাইরের কোনো দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না। তবে বার বার যেন কার মুখটা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে খুব। মাকে আমি খুব মিস করি। উঠতে বসতে এমন ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকলেও। মায়ের কবর দেখতে যাই না অনেকদিন। কারণ আমি জানি সেখানে গেলেই একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যাব। সেই ঘোর কাটাতে আমাকে আরো আরো ক্লোনাজেপাম খেতে হবে। ডাক্তারের কড়া নিষেধ।
এখন কোথায় যাচ্ছি জানি না। মঞ্জু আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। ওর ধারণা আমার বিরাট কিছু হয়েছে। আমার মাথা ফ্রেশ করতে নিয়ে যাচ্ছে কোনো গ্রামেগঞ্জে বা সমুদ্রে। ইদানীং আর সমুদ্রটাও ভালো লাগছে না। গ্রামের বাঁশঝাড়ের পাশের কোনো এক পুকুর বা খালের পাড়ে বসে কচুরিপানার ফুল দেখতে পারলে ভালো হলো। আমার মনে পড়ল, ওই হালকা বেগুনী রংটাই আমার প্রিয় রং।
বাস থামলো একটা স্টপেজে। ব্যাগ কাঁধে চড়িয়ে নেমে পড়লাম দুজন। জায়গার নাম জানতে চাইলাম না। মঞ্জু এদিক ওদিক তাকিয়ে দ্রুত একটা ইঞ্জিনওয়ালা ভ্যান ঠিক করে নিল। ওতে আরো প্যাসেঞ্জার আছে। ভ্যানের ঠিক মাঝে একটা ছাগলও আছে। গাদাগাদি করে বসলাম। আমার প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে একটু ঝাঁকুনি খেলেই আমি ভ্যান থেকে পড়ে যাব। পড়লাম না। একটা জায়গায় এসে নামলাম। সামনে নদীর মতো। শাখানদী হবে। বর্ষায় পানির অভাব নেই। নদীর পাশে অনেকগুলো দোকানপাট। সেখানে একটায় বসলাম। মঞ্জু পরোটা আর ডিম ভাজির অর্ডার করলো।
‘পাশেই সরকারি পাবলিক টয়লেট। যা সেরে আয়।’
‘আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো মঞ্জুর আদেশে চলছি। সে এখন আমার অভিভাবক। তার কথার অবাধ্য হওয়া চলবে না।’
নাশতার পর হাঁটতে বের হলাম। মঞ্জু বারবার আমাকে খোঁচা দিচ্ছে। ‘কই, তুই না ছবি আঁকবি। ইজেল বসাবি কোথায়? জিনিসপত্র বাইর কর।’ আমার অস্বস্তি লাগছিল। নদী থেকে বের হওয়া একটা খাল ধরে হাঁটছিলাম। তাতে লাল শাড়ি পরা একটা মেয়ে গোসল শেষে চুলের পানি ঝাড়ছে। দৃশ্যটা কাছ থেকে দেখে দেখে আঁকতে পারলে ভালো হতো। কথাটা বলতেই মঞ্জু গটগট করে এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। মঞ্জুর কথা শুনে মেয়েটাও দৌড়ে পালাল। চলে গেলে যাক। সমস্যা নেই। আমার মাথায় ক্যামেরা সেটা করা আছে। সেখানে ছবিটা তুলে রেখেছি। ইজেল বসিয়ে আঁকতে শুরু করে দিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাকে ঘিরে লোকজন জমে গেল। কাগজের ওপর রঙের ওয়াশ দেওয়ার পর আরেকটু গভীরে রং বসাতেই নদী আর দূরের ধানক্ষেতটা যখন পরিষ্কার হলো তখন অনেকেই ফিসফিস করে বলতে শুরু করলো উনি দেহি আর্টিশ। কিন্তু এই মাইয়াটা আইলো কই থেইকা। আমরা তো কোনো মাইয়ালোক দেখতেসি না। বাই আপনি এই মাইয়াটারে পাইলেন কই।’
‘মেয়েটা গোসল করে চুল শুকাচ্ছে। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না?’ উপস্থিত জনতা হেসে উঠল। তাদের হাসিটা দেখে মনে হলো আমি এ গ্রামেই থেকে যাই। গ্রামে থাকবো আর ছবি আঁকবো। সেই ছবি বিক্রি হবে ঢাকায়, ইউরোপে। গ্রামের লোকজন এসব এমনিতেই দেখে, তাদের আলাদা করে ছবি দেখতে হবে না।
ছবি আঁকা শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা কেউ নড়ল না। ছবি আঁকা শেষ হতেই চলে গেল। শো শেষ। হল ভেঙেছে। এবার খই ভাজতে হবে। এ গ্রামে আসার পর থেকেই মঞ্জু আমাকে খই খাওয়াচ্ছে। আর একটু পর পর একটা করে সিগারেট ধরাচ্ছে।
‘একটা বাড়িতে ওঠা দরকার। এইখানে হোটেল ফোটেল নেই।’ সিগারেট ছুড়ে দিতে দিতে বলল মঞ্জু। আমি কিছু বললাম না। কিছুক্ষণ পর মনে হলো বলি, আমি এ গ্রামেই থাকবো। দেখ, কেউ বাড়িঘর বিক্রি করবে কিনা। ব্যাংকে অনেক টাকা জমেছে। বাড়ি কিনে ফেলি। পরে মনে হলো মঞ্জু এতে কষ্ট পাবে। সে চায় ঘুরে বেড়াতে। আমার একমাত্র বন্ধু। তাকে কষ্ট দেওয়ার কী দরকার।
বিকেলের মধ্যে থাকার ব্যবস্থা করে ফেলল মঞ্জু। কে জানে কী বলেছে। সে আবার অপরিচিত লোককেও আমার পরিচয় করিয়ে দিতে চায় নানাভাবে। ‘জানেন না তো ভাই, ঢাকার বিরাট সাংবাদিক। নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে ওঠাবসা। এই দেখেন ফেইসবুকে ছবি। তারউপর বিরাট শিল্পী। তার আঁকা ছবি ইউরোপ আমেরিকায় বিক্রি হয়। বাঙালির কাছে শিল্পী হইল পোকায় খাওয়া দাঁতের মতো। সময় থাকতে মর্ম বোঝে না।’
মঞ্জুর পরিচয় দেওয়ার সময় আমি বিপদে পড়ে যাই। সে কখন কী করে বলা মুশকিল। আমি তাই সংক্ষেপে বলি, আমার বন্ধু মঞ্জু। সে তাতেই বর্তে যায়।
মঞ্জু নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে সত্য মিথ্যা মিলিয়ে গল্প ফেঁদেছিল আড়তদার ফকির মুন্সির বাড়িতে। তা না হলে একটা বিয়েবাড়িতে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করাটা বিরাট ব্যাপার। ফকির মুনসির দুই মেয়ে। জানতে পারলাম, বিয়ে হবে ছোট মেয়ের। বড় মেয়ের নাকি কী জানি ‘দোষ’ আছে। মানসিক প্রতিবন্ধী হতে পারে। গ্রামের লোকজন এসব সহজে নিতে শেখেনি এখনো। আমাদের সঙ্গে তার দেখা হয়নি অবশ্য।
ছোট মেয়েটাকে দেখলাম খুব তোলপাড় চালাচ্ছে। আমাকে এসে একবার বলে গেল, তার সঙ্গে যেন তার স্বামীর একটা ছবি এঁকে দেই।
ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটতে শুরু করলো। আমার বারবার মনে হতে লাগল এমন ঘটনা আগেও কোথায় যেন ঘটেছে। তবে আগে বিয়ে হয়েছিল আমার, এবার হচ্ছে অন্য আরেকজনের। আমার বিয়ের কথা মনে হতেই লুনার কথা মনে পড়ে গেল। পনের বছর হলো তার সঙ্গে দেখা হয় না। স্বামী আর তিন কন্যা সন্তান নিয়ে দারুণ সংসার তার। আমার কথা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। আবার হয়ত ঠিক স্বাভাবিক না। সবই মনে রেখেছে। বরং বলা উচিৎ যে আমার কথা তার ভুলে যাওয়ার ভান করাটা স্বাভাবিক।
আমি আবার ভান করতে পারি না। আমার সবই মনে আছে। নিয়মানুযায়ী প্রথম প্রেম হিসেবে লুনা আমার মনে ঠিক আগের অবস্থাতেই আছে। একটুও বদলায়নি।
‘বড় বইনটার নাকি মাথা খারাপ। কিন্তু মহা সুন্দরী। মনে কর, আমাদের সাবিনাও ফেইল।’
‘সাবিনাটা কে?’
‘আরে ভার্সিটির সেই সাবিনা। যে তোর প্রেমে হাবুডুবু খাইল। তারপর তো বেচারি আরো বেশি হাবুডুবু খাওয়ার জন্য এক ডুবুরিকে বিয়ে করে ফেলল।’
‘ওহ, ডুবুরি না, ছেলেটা নেভিতে আছে।’
‘ওই আর কি, আমাকেও তো পাত্তা দিল না। আমিও তো অফার দিয়েছিলাম।’
‘মাথা খারাপ মেয়েটাকে তাহলে অফার দে। মাথা যেহেতু খারাপ, তোর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেতে পারে।’ মঞ্জু আড়ালে গিয়ে সিগারেট ধরাল। আমার ইয়ার্কিতে কান দেওয়ার সময় নেই তার। সে ব্যস্ত রান্নাবান্নার আয়োজন নিয়ে। বাবুর্চি, রান্নার বড় ডেকচি এসব দেখে আমার কেবলি মনে হচ্ছিল আমার দেজা ভ্যু হচ্ছে। ফরাসি শব্দটার মানে হলো ‘আগেও যেন এমনটা ঘটেছে’ টাইপ অনুভূতি। কিন্তু এমনটা হবার প্রশ্নই আসে না। এ গ্রামে আগে তো আসিনি।
‘আপনেরে আমার বইনে ডাকে।’
আমি হা করে কনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আজ তার গায়ে হলুদ। হলুদ লাগানো ছাড়াই মেয়েটার গা থেকে হলদে আভা বের হচ্ছে।
‘ঠিকাছে বিথি। নিয়ে চলো।’
‘আমি ভিতরে যাইতে পারুম না। রেনুপা আপনার লগে একা কথা কইতে চায়।’
আমার খানিকটা ভয় ধরল।
‘ডরাইয়েন না, আপা কামড় টামড় দেয় না। আর শুকনা মাইয়া মানুষ। আপনার লগে পারবো না। ঝামেলা দেখলে চিক্কুর দিবেন। আমি কাছে গেলে সব ঠিক। আমারে আপা খুব ভালোবাসে।’
‘বিথি তোমাকে সুন্দর লাগছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি এ বিয়েতে রাজি না। তুমি ভান করছো তুমি খুব আনন্দে আছো। তুমি আসলে গভীর রাতে কারো সঙ্গে পালানোর প্ল্যান করেছো। এ জন্য তুমি একটু বেশিই খুশি। তবে চিন্তার কারণ নাই, আমি তোমাদের ছবি এঁকে দেব।’
বিথি চুপসে গেল।
‘ভয় নেই। আমি কাউকে বলবো না। আমি ভাবছি, তোমরা যদি পালিয়ে ঢাকায় যাও, তা হলে আমার বাসায় উঠতে পারবে। আমার ফ্ল্যাট ফাঁকা। দুজন আরামে লুকিয়ে থাকতে পারবে। শুধু বাবাকে জানিয়ে দিও যে ভালো আছো।’
‘আপনে আসেন, দেরি করলে আবার রেনুপা চিল্লাচিল্লি শুরু করবো।’
আমার কথায় বিথি আশ্বস্ত হলো না। তার পালিয়ে যাওয়ার আনন্দ মাটি করে দেওয়ার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল।
রেনুপা মানে মেয়েটার নাম রেনু। অবস্থা সত্যিই খারাপ। বাইরে থেকে তালা মেরে রাখা হয়েছে। তালা খুলে আমাকে ভেতরে যেতে ইশারা করলো বিথি। ভেতরে ঢুকতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। একবার মনে হলো সুচিত্রা সেন, আরেকবার মনে হলো তরুণী শ্রীদেবী বসে আছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। গ্রামের রূপবতীরা এত কড়া সাজগোজ করে না সচরাচর। ভয়ে ভয়ে থাকে। যে যত সুন্দরী, তার বিয়ে তত তাড়াতাড়ি। স্বভাবতই সেই রূপবতীদের বরগুলো সুবিধার হয় না। এলাকার হোমড়াচোমড়া টাইপের হয়।
‘বসো।’
রেনু এমনভাবে বলল যেন আমি তার বহুদিনের প্রেমিক।
‘বিথি তুই যা। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কথা শুনলে তোর প্ল্যানও আমি ফাঁস করে দেব।’
‘হে হে। আমি তো আরো ওকে অভয় দিলাম। পালিয়ে যেন আমার বাসায় যায়।’
‘তা হলে তো ঝামেলা হয়ে গেল। এক সঙ্গে এক বাসায় দুই বোনের বাসর হওয়াটা কি ঠিক?’
আমি ‘মানে কী!’ বলতে গিয়েও ঢোক গিলে ফেললাম। রেনুর মাথা খারাপ। কী বলতে কী…।
‘আমার মাথা মোটেও খারাপ না। আমার কিছু ক্ষমতা আছে। বাবা সেটার কথা জানে। আমার মা নেই। মা থাকলে কেউ আমাকে তালা আটকে রাখতে পারত না। আর এসব তালাটালা আমাকে আটকে রাখতেও পারবে না। বাবাকে নিশ্চিন্তে রাখতে চাই বলে নিজেই আটকে থাকি।’
‘কী ক্ষমতা..।’
‘আমি মনের কথা পড়তে পারি। উড়তেও জানি। আমার সঙ্গে এ গ্রামের যত পালোয়ান আছে, সবাই একজোট হলেও মারামারিতে পারবে না।’
‘ওহ।’
‘বিশ্বাস হচ্ছে না? এই যে দেখো।’
বলেই চেয়ার ছেড়ে শূন্যে ভেসে রইল রেনু। ঝাড়া পাঁচ সেকেন্ড হবে। এরপর আবার চেয়ারে বসে চোখে মাশকারা বা কাজল একটা কিছু লাগাতে ব্যস্ত হলো। যদিও বড় বড় গভীর চোখ দুটোয় ওগুলো ভীষণ অপ্রয়োজনীয়।
‘ভয় পেয়েছো?’
‘আপনি আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন যে।’
‘তুমি করে বলছি, কারণ আমরা একটু পর পালাবো। একটু পর না। আগে রান্না বান্না হবে। গায়ে হলুদের তেহারি রান্না হচ্ছে। ওটা খেয়ে তারপর পালাবো। আমার আবার খিদে সহ্য হয় না। এরপর পালিয়ে একসঙ্গে থাকব। চাইলে বিয়েও করতে পারো। তুমি এক কাজ করো, আমার জন্য একটা কোক বা স্প্রাইট নিয়ে আসো। মোড়ের দোকানেই পাবে। তেহারির সঙ্গে লাগবে।’
‘ঠাণ্ডা না নরমাল?’
‘একটা হলেই হবে।’
রেনুর আমার দিকে একবার কি দুবার তাকাল। তাতেই আমার দেজা ভ্যু কাটছে না। এখন মনে পড়লো, তার চেহারা সুচিত্রা বা আলিয়া ভাটের মতো না। সে দেখতে অবিকল লুনার মতো। আমিও তাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো কোক আনতে চলে গেলাম মোড়ের দোকানে। মঞ্জুকে সাথে করে নেওয়ারও দরকার মনে করলাম না। মাথায় কেবল শূন্যে ভেসে থাকা রেনুর ছবি ঘুরছে। কেন যেন কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করলাম না।
রাত এগারোটায় রেনুর কথা মতো আমি আর মঞ্জু বাড়ির পেছনের জংলার মতো জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। পাশেই একটা পুকুর। বৃষ্টি নেই। উল্টো চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে পুকুরের পানি। মঞ্জুর একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছে। আমাকে সাধলেও খাচ্ছি না। মাথা পরিষ্কার রাখতে হবে। সিগারেট খেলে মাথা ঝিমঝিম করবে।
এদিকে বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। কেউ একজন ধরা পড়েছে। সম্ভবত বিথির প্রেমিক। আমি এগিয়ে যাব, এমন সময় হাত চেপে ধরলো রেনু। বুঝতে পারলাম, ধরা খাওয়ানোটা তারই প্ল্যান।
‘কেন!’
‘বিথি জাহান্নামে যাক। আজ এতটা বছর আমি আটকে আছি এ ঘরে। শুধু তোমার জন্য। এসব বিথি টিথি সব বানানো গল্প।’
মাথা খারাপ হলেও রেনুর কথাগুলো ফেলতে পারছি না কেন যেন। খুব সুন্দর আর গুছিয়ে বলা কবিতার মতো। রেনু কি জীবনানন্দ পড়া পাবলিক? নাকি রিটার্ন অব শি’র সেই আয়েশা?
‘আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। কেন ছিলাম জানি না। চাইলে ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারতাম। কিন্তু তোমাকেই আমার কাছে আসতে হতো।’
রেনু বিড়বিড় করে বলেই যাচ্ছে। যেন মন্ত্র পড়ছে। মন্ত্র শব্দটা মনে হতেই আমার কী যেন মনে পড়তে গিয়েও পড়ল না। রেনুকে হুট করে খুব চেনা মনে হলো। লুনার চেয়েও বেশি চেনা। রেশমা নাকি? কিন্তু রেশমাটা আবার কে? এ নামেও তো আমি কাউকে চিনি না।
হঠাৎ খেয়াল হলো মঞ্জু নেই। তার কথা শোনা যাচ্ছে। গণ্ডগোল যেখানে হচ্ছে সেখানে। আমি রেনুর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলাম। সে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে পুকুরে ভাসা জোছনা দেখছে। জোছনার প্রতিফলন পড়ছে তার মুখে।
আমার মাথা থেকে মঞ্জু, বিথি ও তার ধরা খাওয়া প্রেমিক চলে গেল। আমি তাকিয়ে আছি রেনুর মুখের দিকে। আমি যে প্রেমে পড়ে গেছি সেটা স্পষ্ট টের পেলাম। হোক মাথা খারাপ মেয়ে। এমন রূপবতী মেয়ের মাথা কিঞ্চিৎ খারাপ না হলে মানায় না। এটা কি কারো লেখা লাইন? নাকি আমারই বানানো? মাঝে মাঝে তো মনে হয় কবিতা কেউ একজন লেখে না। সবাই একসঙ্গে লেখে একটি সত্ত্বার জন্যই। যে এই মুহূর্তে আমার সামনে দাঁড়িয়ে।
আপাতত আমার মনে ভিড় জমানো কবিতাগুলো রেনুকে ঘিরেই। ধুম করে মাথা ঘুরিয়ে রেনু বলল, ‘যাও বন্ধুর সঙ্গ দাও। ঝামেলা মিটিয়ে আসো। তুমি তো ঝামেলা মেটাতে ওস্তাদ।’
রেনুর রাগ করার হেতু খুঁজে পেলাম না। ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম যাব আর আসব।
ছেলেটাকে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। পাশে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে বিথি। কিছুটা মারধর করা হয়েছে। তবে সিরিয়াস না। মঞ্জু একটা কিছু বলার জন্য গলা খাঁকারি দিল। বিথির বাবা খুব তোলপাড় করছিলেন। তিনিও থামলেন।
‘ভাইসব। প্রিয় গ্রামবাসী। আমি আর আমার সাংবাদিক বন্ধু এখানে আপনাদের অতিথি। আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। আমাদের কাজ হলো ঘুরে বেড়ানো আর মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা জাতিকে জানানো। তো এখানেও এক দুঃখ দুর্দশার অবস্থা তৈরি হয়েছে। তাই দুচারটা কথা বলতে চাই। বিয়ের মতো পবিত্র একটা বিষয়ে এই সুরুজ বেটা (যাকে বেঁধে রাখা হয়েছে) এসে ঝামেলা পাকিয়েছে। সে আমাদের কনে বিথিকে তুলে নিয়ে যেতে চায়। বিথি বলেছে সেও নাকি তাকে ভালোবাসে। কিন্তু সে তার বাবার সম্মানের কথা ভাবল না। সে ভেবেছে পালিয়ে গেলেই বেঁচে যাবে। তার বয়স কম। সে ভুল করেছে। কিন্তু সুরুজ মিয়ার বয়স কী কম? আপনারা বলেন।’
আমি এগিয়ে মঞ্জুকে থামাতে চাইলাম। মঞ্জু উল্টো আমাকে ঝাড়ি মেরে বলল, আমার এই বন্ধুর দিল নরম। সে আমাকে মানা করেছিল আমি যেন বাড়তি ঝামেলা না করি। কিন্তু ভাইসব, ঝামেলা ছাড়া দুনিয়াতে কোনো কিছুর সমাধান হয় না। এ কারণে আমি আমার বড় মামাকে ফোন করেছি। উনি ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছেন।’ এটা বলে মঞ্জু তার চিরায়ত বিরতিটা নিল। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মঞ্জু বিশেষ পরিস্থিতে তার এক কাল্পনিক বড় মামাকে টেনে আনে। যে কিনা পুলিশের বিশাল বড় কর্মকর্তা।
‘আমার বড় মামার পরিচয় আপনারা জানেন না। জানার দরকারও নাই। উনি ফোন করে দিয়েছেন, একটু পর ওসি, চেয়ারম্যান সবাই সুড়সুড় করে চলে আসবেন। একটা বিচার হবে। তারপর দড়ি বেঁধে সুরুজকে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। আদালতে আপনাদের যেতে হবে। সাক্ষী দিতে হবে। রাজসাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মেয়ের বাবা। আপনাদের চিন্তার কারণ নাই, শুধু যা যা দেখেছেন সেটাই বলবেন। আর সাক্ষী দিতে না পারলে আবার ঝামেলা বড় হবে। আপনারা উল্টা বিপদে পড়বেন।’
যথারীতি উপস্থিত গ্রামবাসীর মধ্যে একটা পালাই পালাই আচরণ দেখা গেল এবং দুই মিনিটের মধ্যে বাবুর্চির লোকজন ছাড়া আর কেউ রইল না। মঞ্জু এসে সুরুজের বাঁধন খুলে দিল। তার চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে।
‘ভাইজান সত্যিই পুলিশ আসতেসে?’
‘হ আসতেসে। আপনার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন আর অপহরণের মামলা হবে।’ বিথির বাবার দিকে তাকিয়ে মঞ্জু বলল, ‘আপনাকে কিন্তু রেগুলার কোর্টে সাক্ষী দিতে হবে। যা যা দেখেছেন একটা কাগজে লিখে রাখেন। পরে উল্টাপাল্টা বললে ফেঁসে যাবেন। আর মামলার বাদিও কিন্তু আপনি হবেন।’
বিথির বাবা কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি একবার বিথির দিকে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমি কি তাকে এই ফাঁকে বলবো যে তার মাথা খারাপ হওয়া বড় মেয়েটা আমাকে নিয়ে পালাতে যাচ্ছে।
দশ মিনিটের মধ্যে ঘটনা বদলে গেল। মঞ্জু কয়েকবার ফোন করার ভান করলো। তারপর বিথির বাবাকে অভয় দিয়ে বলল, পুলিশ আপাতত আসছে না। আপনি আজ রাতেই বিয়ের ব্যবস্থা করেন। যার সঙ্গে বিয়ের কথা হচ্ছিল সেই বাড়িতে লোক পাঠান। তাদের আপাতত ঘুমাইতে বলেন। বিথির বিয়ে সুরুজের সঙ্গে হবে, আজ রাতেই হবে।
‘তুমি যা বলবা বাবা, সেটাই হবে। আমার ছেলে নাই। তুমি আমার বড় ছেলে।’
আমার দিকে তাকালেন এবার। আমি হেসে বললাম, ‘চিন্তার কারণ নাই। আমি আপনার ছোট ছেলে। আর আপনার বড় মেয়েকে আমার মনে ধরেছে। তাকে আমি বিবাহ করতে চাই।’
মহা ধুমধাম করে দুটো বিয়ে হয়ে গেল এক রাতে। গ্রামের যারা দাওয়াত পায়নি তারাও ছুটে এসেছে সবাই। রেনুকে বলা মাত্র সেও বউ সেজে ফেলল খুশি খুশি চেহারায়। বিয়ের সময় যখন সে সেজেগুজে বসল, মুহূর্তের জন্য যেন স্তব্ধ হয়ে গেল মহাকাল, এবং গ্রামবাসী। ‘মাথা খারাপ’ মেয়েটা যে সত্যিই মাথা খারাপ করার মতো রূপবতী হবে সেটা কেউ কল্পনাও করেনি। ফিসফাস শুরু হয়ে গেলেও সেটা ঢাকা পড়ে গেল বাদ্য বাজনার শব্দে। মঞ্জু যথারীতি তার সদ্য শেখা রোবট ড্যান্স দিয়ে মাতিয়ে রাখল সবাইকে।
বাসর সাজানো হলো। আমার আবারো মনে হলো একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। একটু পর একটা বড় ধরনের ঝামেলা বাঁধবে আর সব তছনছ হয়ে যাবে। কিন্তু কে ঝামেলা বাঁধাবে কেন বাঁধাবে সেটা মাথায় ঢুকছিল না।
রাত বারোটা বাজতেই গ্রামের লোকজন যার যার বাড়ি চলে গেল। এক ঘরে আমার আরেক ঘরে বিথি ও সুরুজের বাসর সাজানো হয়েছে। গ্রামের কয়েক বাড়ির মেয়েরা থেকে গেছে। তাদের সঙ্গে গুটুর গাটুর করছে মঞ্জু। হাইও তুলছে ঘন ঘন।
ঝামেলার যে আশঙ্কাটা মনে উঁকি দিচ্ছিল, সেটা ঘটেই গেল। বিথির সঙ্গে যার বিয়ের কথা ঠিক হয়েছিল, তারা এত সহজে মেনে নিল না বিষয়টা। লাঠিয়াল বাহিনি নিয়ে হাজির হলো বাড়িতে। সিঁটিয়ে গেল মঞ্জু। কয়েক জায়গায় ফোন করে গ্রামটা কোন থানার আন্ডারে আর ওসির নাম্বার আছে কিনা সেটা বের করার চেষ্টা চালাল। একমাত্র আমিই বোধহয় নিশ্চিন্তে আছি। বাসর ঘরে ঢুকে মাত্র সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী রেনুর পাশে বসলাম তখনই হই চই। উঠতে যাব, তার আগে রেনু হাত ধরে চাপ দিল।
‘হোক গণ্ডগোল। লাঠি দিয়ে সব ভেঙেচুরে দিক। আমি আর তুমি এখানেই থাকি।’
‘আমি তো সিনেমার নায়ক। চুপ করে বসে থাকতে তো ইচ্ছে করছে না। এ ঘরে লাঠি বা বাঁশ জাতীয় কিছু আছে? একটু মারামারি করি।’ বলতে বলতেই রেনুকে বেকায়দায় জড়িয়ে ধরলাম। মাথাটা গুঁজে দিলাম ওর বুকে। গন্ধটাও পরিচিত। রেনু আমার কপালে চুমু বসিয়ে দিল একটা। গাঢ় চুম্বন যাকে বলে। তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘চলো পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে থাকি।’
‘এই হট্টগোল থামাও গিয়ে। এত শব্দের মধ্যে জোছনা টের পাওয়া যাবে না।’
রেনু বেশ সময় নিয়ে উঠল। আমিও উঠতে গেলাম। চোখ বড় বড় করে বারণ করলো, ‘এখন বের হলেই একগাদা মশা ঢোকাবে। যেভাবে আছো শুয়ে থাকো।
রেনু বের হতেই হট্টগোল থেমে গেল। আমি লোভ সামলাতে না পেরে বিছানা ছাড়ি ও জানালার ফাঁক দিয়ে ঘটনা দেখতে থাকি। লাঠিয়াল বাহিনির একজন এগিয়ে আসতে যাবে, তার আগেই অদৃশ্য একটা শক্তি তাকে গলফ বলের মতো ছুড়ে দিল দূরের একটা ডোবায়। বাকিদের কিছু বলতে হলো না। যে যেদিকে পেরেছে ছুটে পালিয়েছে। স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছে মঞ্জু। সে সিগারেটটা আস্তে করে ফেলে বলল, ‘ভাবি কেমন আছেন।’
আমি এক দৌড়ে বিছানায় উঠতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেলাম।
‘তোমাকে না বলেছি…!’
‘দৃশ্যটা না দেখলে মিস করতাম। হে হে।’
রেনু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। মট করে একটা শব্দ হলো। ভয় পেয়ে গেলাম, পাঁজরের হাড় ভাঙলো কিনা আবার। পরে মনে হলো ওটা বিছানার শব্দ। তারপর যা ঘটার ঘটল। মানে আমি মনে মনে যেমনটা ভাবছিলাম। আমাকে নিয়ে শূন্যে ভেসে রেনু বেড়ার দেয়াল ভেদ করে চলে গেল বাড়ির পেছন দিকটায়। ভাসতে ভাসতে আমরা উঠে গেলাম বাঁশঝাড়ের একেবারে ডগায়। গ্রামে সাধারণত উঁচু ভবন থাকে না। তাই উপর থেকে গ্রাম দেখতে কেমন সেটা কেউ বুঝতে পারবে না। আমি বুঝতে পারলাম। উপর থেকে গ্রামটাকে দেখে মনে হলো একটা আস্ত একটা প্রাণী। চুপটি করে বসে থাকে। এখন সে জোছনা দিয়ে গোসল সারছে নিরিবিলি।
বিয়ের শাড়ির কারণে রেনুকে দেখাচ্ছে অশরীরি প্রেমিকার মতো। হাসি, আনন্দ আর প্রেম মেশানো টলোমলো চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে একদৃষ্টে। পলক ফেলছে না।
বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। চোখ নামিয়ে তার গলা দেখতে লাগলাম। আমি জানি এরপর কী ঘটবে। পুরো স্ক্রিপ্ট যেন আমার আগেই পড়া। মুখটা এগিয়ে আনল রেনু। গাঢ় চুম্বনে আটকে নিল আমাকে। আমার হাত-পা ভীষণরকম অসাড় হয়ে গেল। জোছনা যেন আমার শরীরে গলে গলে পড়ছে। রেনুর ওপর ছেড়ে দিলাম সমস্ত ভর। এরপর পলকা তুলোর মতো আরো উঁচুতে উঠে গেলাম। রেনুর ঠোঁট আর শরীর থেকে বিদ্যুৎ স্ফূলিঙ্গের মতো অনুভূতির স্রোত এসে ঢুকতে লাগল আমার শরীরে। আমিও যেন উড়তে শিখে গেলাম। এরপর উড়ে উড়ে সে রাতে আমরা সত্যিই পালিয়ে গেলাম।
১২
চোখের পলকে ছয় মাস কেটে গেল। ছিমছাম ধুলাউড়ি গ্রামটা আমার বেশ পছন্দ। মানুষগুলো জলের মতো। কেউ স্বচ্ছ, কেউ ঘোলাটে। তবে জলের মতোইএ যার সঙ্গে কথা বলবে, তার সঙ্গে মিশে যায়।
আমি আর রেনু সত্যিকার অর্থে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলাম বিন্তিদের বাড়িতে। বিন্তিদের বাড়িতে বিন্তি আর তার মা। বিন্তি পড়ে ক্লাস এইটে। অভাবের সংসার। রেনু এসেই বিন্তির মাকে একটা সোনার গয়না দিয়ে বলল, মা এটা বিক্রি করে যা টাকা হয় সব আপনার। বিনিময়ে আমরা যে কয়দিন পারি থাকব। আপনি সবাইকে বলবেন, আমি আপনার বড় বোনের মেয়ে। বিদেশ থেকে এসেছি।
বিন্তির মা কথা বলেন কম। তার চোখ আর মুখে হাসি উপচে পড়ে বেশি। আমি অবশ্য সোনার গয়নার ভরসায় থাকলাম না। ফ্রিল্যান্সিং কাজ আর ছবি এঁকে ভালোই আয় হচ্ছিল আমার। নিয়মিত বাজার করা, এটা ওটা কেনা এসবের কারণে খাতিরযত্নের কোনো অভাব হচ্ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা বিন্তিকে আমি এক মাসের মাথায় ছবি আঁকা শিখিয়ে দিয়েছি। কোন রঙের সঙ্গে কোন রঙ মেশাতে হবে, কী করে সহজে ঘন জঙ্গল এঁকে তাতে সূর্যের আলোর ছটা বসিয়ে দিতে হবে, কী করে জাবর কাটতে থাকা গরু আঁকতে হবে সব। সে এখন চাইলে ছবি আঁকার স্কুলও চালু করতে পারে। আমি তাকে পড়াশোনাও করালাম। তারপরও রেনুপা বলতে অজ্ঞান সে।
সময় কম যায়নি। এর মধ্যে ঘটনার মতো অঘটনও আছে। আবার সেই অঘটনের কারণে তৈরি হয়েছে আরেক প্রেমোপাখ্যান। রেনুর সঙ্গে মোটেও সাধাসিধে সংসার চলছিল না আমার। প্রায় প্রতি দিনই, বিশেষ করে রাতের সময়টা আমাদের নিত্য নতুন অ্যাডভেঞ্চার চলমান ছিল। রেনুর প্রতিটি পাগলামিতে আমার সায় ছিল। বলতে গেলে শেষের দিকে পাগলামিটা আমার ওপরই ভর করেছিল যেন। আমি যা-ই বলেছি রেনু তাতে না করেনি।
প্রথম দিকে রেনু হঠাৎ রাতে বলত, চলো আজ নদীর তীরে যাই। এক উড়ালে যাব আর আসব। মাঝে কী হবে সেটা আর আমাকে বলে দিতে হলো না। আমরা রাত দুইটা তিনটার দিকে নদীর তীরে গেলাম। ঠিক কোন জায়গায় যাব সেটাও আগে ঠিক করা থাকতো।
তারপর কোনো এক গভীর নিশুতিতে আমরা চলে যেতাম কোনো এক বাড়ির উঠোনে। আগে থেকে জানতাম ওই বাড়িতে ওই রাতে লোকজন থাকবে না। কিংবা চুরি করে মধ্যরাতে কারো বাসর ঘরে উঁকি দেওয়া। তারপর চোর সন্দেহে যখন চেঁচামেচি শুরু হতো তখন দিতাম উড়াল। একবার তো আমাকে নিচে রেখেই উড়াল দিল রেনু। ইচ্ছে করে। মেজাজ গেল চড়ে। মন চাইল ধরা পড়ি। পরে আবার বুঝলাম এটা হলো তার একটা খেলা, আমাকে বিপদে ফেলে দেখতে চায় আমার বুদ্ধি কতখানি। এর আগে এমন কোনো এক খেলায় সম্ভবত আমি কাউকে খুন করেছিলাম। আমার ঠিক মনে পড়ে না। আমি হোগলার জঙ্গল আর সবজির বাগান মাড়িয়ে দুদ্দাড় ছুটে চলে আসি বিন্তিদের বাড়ি।
একটা এক শ বছরের পুরনো বটের ওপর গোল একটা কাণ্ড আবিষ্কার করেছিলাম আমরা। ওই কাণ্ডটার ভেতর চাইলে আরামসে একজন মানুষ শুয়ে থাকতে পারে। বুঝতেই পারছেন, সেখানে একজন নয়, কোনো এক আধো জোছনার রাতে সেখানে দুটি দেহ শুয়েছিল, পাখিদের নিস্তব্ধতা ভেঙে।
সপ্তাহখানেক আগের কথা। এক সন্ধ্যায় বিন্তিদের বাড়ির উঠোনে আসে এক লোক। পরনে খদ্দরের পাঞ্জাবি। গলায় একগাদা মালা জড়ানো। সাধু সন্ন্যাসীদের বেশ ধরার চেষ্টা করছে। তবে বেশটা ঠিকঠাক হচ্ছে না তার। আমাকে দেখে একগাল হাসল, ‘ভাইসাব লেখক আর শিল্পী মানুষ। মহা গুণী ব্যক্তি। ভালো ভালো। আপনার সর্বশেষ ছবিখানা জার্মানিতে বিক্রি হয়েছে। খুউব ভালো।’
‘কী চাই আপনার? খবরটা পেলেন কী করে? মুখ দেখে সব বলে দিতে পারেন?’
‘আমি কী চাই? আপনি কী চান বলেন তো? কে কী চায়? কে কারে চায়? এইটাই তো দুনিয়ার একটা বড় প্রশ্ন।’
‘এসব আধ্যাত্মিক কথা শোনার মুড নাই। আপনি আসুন।’
‘তা বেগম সাহেবারে একটু বলবেন একটু পানি দিতে। পানি খেয়ে চলে যাব।’
‘পানি খেতে হবে না। আপনি ভাগেন।’
কথাবার্তা শুনে রেনু এলো। আসতেই কেমন যেন একটা বিশ্রীরকম হাসি খেলে গেল লোকটার মুখে।
‘অধমের নাম প্রামাণিক। অধম এসেছিলাম একটু পানি খেতে। আর যদি বাসায় একটা চিরুনি থাকে তো দেন। বহুত দিন চুল আঁচড়াই না।’
আমি আর কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলাম না। ভদ্রতার সংজ্ঞাও আমার জানা নেই। সোজা এগিয়ে এসে লোকটার পাঞ্জাবি খামচে ধরে ছুড়ে মারতে চাইলাম। পড়লো না। তবে রাগের চোটে গটগট করে চলে গেল।
ভয় পেয়ে গেল বিন্তির মা।
‘কী দরকার ছিল! সাধু সন্ন্যাসী মানুষ।’
‘আমি তারচেয়েও বড় সাধু খালাম্মা। নিশ্চিন্তে থাকেন। ওই ব্যাটা আর জ্বালাবে না আপনাদের। বেশি জ্বালালে সোজা কল্লা ফেলে দেব।’
এর তিন দিন পরের ঘটনা। নদীর তীরের কোনো এক বালিয়াড়িতে একরাত আমাদের উদ্দাম মিলন চলছিল। সারা গা কাদা বালিতে মাখামাখি। রেনু তার স্বভাবসুলভ আনন্দঘন শব্দগুলো আওড়াচ্ছিল। কৃদের ভাষা শেখাটা জরুরি হয়ে গেছে মনে হলো।
হঠাৎ টর্চের আলো। চটজলদি সামলে নিলাম। উঠে দাঁড়ালাম। ঝটপট নিজেকে ঢেকে নিল রেনু। বেকায়দায় শুয়ে আছে। আমি কঠিন দৃষ্টি হানার চেষ্টা করলাম টর্চধারীর দিকে। কিন্তু টর্চের শক্তিশালী আলোর কাছে পারলাম না। একটা মোটাসোটা মানুষ। চেহারা আবছা দেখা যাচ্ছে। তাতেই মনে হলো পরিচিত। এ লোকটাই এসেছিল বিন্তিদের বাড়ি। কিছুতেই নাম মনে পড়ছে না।
‘তুমরা তাইলে এখানে প্রেমলীলা চালাইতেসো? হা হা হা। পাইসি আইজ তোরে ডাকিনি। আমার হাত থেইকে আজ তোক বাঁচাবিনে কেউ।’
রেনুকে কেউ বাঁচাতে পারবে না এমনটা ভাবার কারণ লোকটার হাতে লম্বা একটা আঁকাবাঁকা ছুরি। এটাকেই সম্ভবত খঞ্জর বলে। খপ করে আমার কলার ধরে ফেলল। এরপর বিড়বিড় করে কী যে আওড়ে গেল। আমি হয়ে গেলাম পাখির পালকের মতো ওজনহীন। এক পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল আমায়। মাথায় গাছের গুড়ির সঙ্গে বাড়ি খেলাম। জ্ঞান না হারালেও শরীর নাড়াতে পারছি না একটুও।
রেনু শাড়ি পরে ততক্ষণে উঠেই রক্তচোখে তাকাল লোকটার দিকে।
‘তোকে সাবধান করে দিচ্ছি প্রামাণিক! মানুষদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই আমাদের। আমি ওকে ভালোবাসি! আর আমরা মানুষ হত্যা করি না।’
‘হে হে, এটাই তো আমার সুযোগ। তুই না করলে কী হবি, আমি তোরে খুন করমু। বলতে বলতে লোকটা বিড়বিড় করেই চলেছে। আমি বিড়বিড় করা শব্দগুলো বোঝার চেষ্টা করছি। অন্য কোনো ভাষা নয়, কিছু শব্দ। কিছু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে শব্দ। নিশ্চয়ই অনেক সাধনা করে এভাবে মন্ত্র আওড়ানো শিখেছে লোকটা। কিন্তু রেনুর সঙ্গে কীসের লেনদেন তার? সে কি বিন্তিদের বাড়িতে এসেছিল রেনুকে দেখতে? কী চায়? ভাবতে ভাবতে আমার চোখ প্রায় বুঁজে এলো।
আধবোজা চোখেই দেখলাম রেনুর সঙ্গে প্রামাণিক নামের লোকটার আধিভৌতিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। রেনু বার বার উড়তে গিয়ে আবার পড়ে যাচ্ছে। কয়েকবার চেষ্টার পর মনে হলো ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে ও। উপুড় হয়ে গেল। এমন সময় রেনুর ওপর ঝাঁপ দিল প্রামাণিক নামের লোকটা। মাংসের ভেতর ছুরির ফলা ঢোকার শব্দটা কানে আসতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। রেনুর পিঠে বিঁধেছে ছোরাটা। লোকটা আর দাঁড়াল না। দৌড়ে পালাচ্ছে। লোকটা সরে যেতেই আচমকা আমার শক্তি ফিরে এলো। ছুটে গেলাম রেনুর কাছে।
সাদা বালিতে রক্তের চিকন স্রোতটা দেখে মাথা খারাপ হওয়ার দশা। রেনুকে পাশ ফেরাতেই দেখি ছুরির চার-পাঁচ ইঞ্চি পিঠ চিরে ঢুকে গেছে। ভাগ্য ভালো মেরুদণ্ডে লাগেনি।
স্থির হতে বললাম রেনুকে। যন্ত্রণায় গোঁঙ্গাচ্ছে। তবে নড়ছে না। সাবধানে ছাড়ালাম ছোরাটা। গেঞ্জি ছিঁড়ে বাঁধার চেষ্টা করলাম। দুর্বল বাঁধন। রক্ত চুইয়ে পড়ছে। ওর শাড়িটার খানিকটা ছিঁড়েও পেঁচিয়ে দিলাম। বললাম, ‘উড়তে পারবে? হাসপাতাল ঘুরে গেলে চার-পাঁচ কিলো হবে। নদীটা পার হতে পারলেই মেইন রোড। তারপর…।’
‘নাহ! উহ.. পারবো না।’
আমার শরীরে যাকে বলে শীতল ঢেউ খেলে গেল। বিপদের সময় এমনিতে হাত-পা অবশ অবশ লাগে। শরীরে শক্তিও থাকে না। ওই অবস্থায় রেনুকে কোলে নিয়ে নদীর বালিয়াড়ি থেকে রাস্তায় উঠলাম। মাথায় খেলতে লাগল বুদ্ধি। আগে দরকার একটা ভ্যান। মনে পড়ল রইসু মিয়ার কথা। জলদি করে ওর বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলাম।
‘এই দিকে কই যাও! এদিকে তো বাজার না।’
‘তুমি চুপ করে কাটা জায়গায় প্রেশার দিয়ে রাখো। রক্ত যেন বেশি বের না হয়। তুমি লোকটাকে চিনতে?’
‘দুই বাড়ি পরেই তো থাকত। ভাবতাম পাগল টাগল। সে কোনোভাবে আমার কথা জেনে গেছে।’
রইসুর উঠোনে ভ্যানদুটো দেখেই মনে হলো এবার আমরা উড়তে পারবো। বেশি ডাকাডাকি করতে হলো না। রেনুকে ভ্যানে শোয়ালাম। আমার খালি গা আর পরনের জিন্সের প্যান্ট। রেনুর শরীরে কোনোরকম শাড়ি পেঁচানো। রইসু চোখ ডলতে ডলতে হিসাব মেলাতে পারছিল না নিশ্চয়ই। তবে ভ্যান ছাড়তে দেরি করেনি। একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে গেল। ভাড়া পরে নেবে বলে জলদি আমাকে তাগাদা দিল রইসু। এক বালতি পানি জোগাড় করে সে ভ্যানের রক্ত পরিষ্কার করছিল। রেনুর রক্ত। বুক ভাঙা হাহাকার নিয়ে দৃশ্যটা দেখছিলাম।
হাসপাতালে রাতেই সেলাই করে বলল, ঢাকায় নিয়ে যেতে। কী একটা নাকি জটিলতা দেখা দিয়েছে। বড় ক্ষতি হতে পারে। নিজেকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। কে বলেছিল এসব ছেলেমানুষী অ্যাডভেঞ্চার করতে।
ঢাকায় যাওয়ার পথে আবার সেই পরিচিত অ্যাম্বুলেন্সের শব্দটা শুনতে পেলাম। মানে গাড়ির ভেতর থেকে শোনা। এর আগে মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথে শুনেছিলাম। রেনু ঘুমুচ্ছে নাকি জ্ঞান হারিয়েছে বোঝার উপায় নেই। ওর রক্তের গ্রুপ কী! জানি না আমি। উফফ আমার রক্তগুলোকে মনে হলো মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। আমি বারবার রেনুর মাথায় হাত বুলোচ্ছি আর একটু পর পর পানি খাবে কিনা জিজ্ঞেস করছি। রেনুর ঘুমের মধ্যে বকবক করলো বেশ খানিকক্ষণ। যতক্ষণ বকেছে, ততক্ষণ যেন আমি বেঁচেছিলাম। ‘ওহ তুষার.. তুমি জানো না.. কিচ্ছু জানো না.. তোমাকে ভালোবাসি…।’
রেনুর ওপর রাগ করতে গিয়েও পারলাম না তখন। আগে তুষার নামে তার সঙ্গে কারো সম্পর্ক ছিল এটা বললেই পারতো। কিছুটা রাগও হলো, অন্তত একবার সে ‘ওহ.. ফয়সাল..বলতে পারতো।’ আমার নামটা একবারও মুখে আনলো না। কিন্তু তাই বলে বিশ্বাস করুন, ওর জন্য আমার মন খারাপ এক ফোঁটা কমেনি।
ঢাকায় আসার পাঁচ ঘণ্টা মনে হলো দ্রুতই কেটেছে। অনন্ত মহাকাল টাইপ কিছু মনে হয়নি। মনে হলো স্বপ্নের মতো সব ঘটেছে। গ্রিন লাইফ হাসপাতাল। এখানেই নিয়ে এসেছিলাম মাকে। এবার রেনুকে। চোখের পলকে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। কেবিনও পেলাম।
বেডে শোয়ানোর পরপরই নিয়ে যাওয়া হলো এক্সরেসহ কী কী সব পরীক্ষায়। ফোন করে আনা হলো ডাক্তার। এরপর সার্জারি। এরপর পোস্ট অপারেটিভ রুমের বাইরে একা একটি রাত।
কেবিনে নেওয়ার পর দিন রেনুকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো। মঞ্জু এলো এর মাঝে দেখতে। আগে সে গ্রামে গিয়ে ঝামেলা বাঁধাতো। ওর ধারণা আমি শিল্পী মানুষ, মাথাভর্তি পাগলামি আর ঘোর। ঘোর খুব দ্রুত কেটে যাবে এরপর আমি মহাবিপদে পড়ব। রেনু আমার নামে নারী নির্যাতনের কেস করবে। হেনতেন।
যখন দেখল এ ঘোর ছয় মাসেও কাটলো না। হাল ছেড়ে দিল মঞ্জু। এখন তার মতো বন্ধু আর হয় না। আবার রেনুও তার মতে শ্রেষ্ঠ ভাবী। হাসপাতালে এসেই খুব হম্বি তম্বি করে বলল, রক্ত লাগবে কিনা বল, সব গ্রুপের একজন করে স্ট্যান্ডবাই রেখে দিয়েছি। বললেই চলে আসবে।
‘ডাক্তাররা এখন পর্যন্ত আমাকে রক্তের গ্রুপটাও জানায়নি। সম্ভবত লাগবে না।’
‘বলিস কি, রেয়ার গ্রুপ নাকি। তা হলে তো বিপদের সোয়া সের। আর ভালো কথা, কে ছোরা মেরেছে আমি খুঁজে বার করবো। স্পট থেকে শুধু একবার ছুরিটা খুঁজে পাই। তারপর হারামজাদার গুষ্টি উদ্ধার করা হবে।’
মঞ্জুকে কিছু বলিনি। পুরো ঘটনা তো বলার মতো না।
মঞ্জু একসময় চলে গেল। হাসপাতালে আমি আর রেনু একা।
আমার কোনো আত্মীয় নেই। রেনুরও নেই। তার বাবা-বোনকে এ বিপদের মধ্যে টেনে আনার কোনো মানে হয় না। ও তো আর মরে যাচ্ছে না। বড়জোর দিন দশেক থাকতে হবে হাসপাতালে।
নিচে গেলাম খাবার কিনতে। চারপাশের ঝলমলে আলোটা বেশ পরিচিত মনে হলো। কেবলি মনে হচ্ছিল বামের রাস্তা ধরে এগোতে থাকলে একটা রেস্তরাঁও পাব। নামটা মনে আসি আসি করেও আসছিল না। মদিরা রেস্তরাঁটা দেখেই দেজা ভ্যু হলো। ব্যাপারটা এত ঘন ঘন হচ্ছে যে আমি আর এটাকে বিশেষ পাত্তা দিলাম না। সাধাসিধে রেস্তরাঁ। পরোটা আর ডিম ভাজা হচ্ছে। আমি ভেতরে বসে পরোটার অর্ডার করলাম। ম্যানেজার লোকটা বিশালদেহী। কিন্তু চোখজোড়া মনে হয় কোটরে একটু বেশিই বসানো। আমার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। তারও কি দেজা ভ্যু হচ্ছে? আমাকে দেখে চেনা চেনা মনে হচ্ছে?
‘আপনে ফয়সাল না?’
আমি আঁতকে উঠে আবার স্বাভাবিক হলাম। মৃদু মাথা ঝাঁকালাম।
‘আমি আপনার লেখা পড়ি। আপনার গল্প খুব ভালো লাগে। ব্যাপক রোমান্টিক।’
‘ওহ.. আচ্ছা।’
‘তা রোগী কে?’
‘জ্বি, আপনার ভাবি।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। তা পোলা না মাইয়া।’
‘না, একসিডেন্ট করেছে।’
‘ওমা! বলেনকি! অবশ্যি চিন্তার কারণ নাই। ভালো হাসপাতাল। আমার চাচাত ভাইয়ের শ্বশুররে আনসিলাম ওইদিন। তার আবার…।’
আমি গভীর মনযোগ দিয়ে ম্যানেজারের গল্প শোনার ভান করলাম। এরপর বিল দেওয়ার সময় জানতে চাইলাম, ‘আচ্ছা, আপনার রেস্তরাঁর নিচে কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড আছে? মদটদ পাওয়া যায়?’
লোকটা যতটা সমীহ করছিল, ততটা বিরক্ত হল। আমিও বুঝে গেলাম সব দেজা ভ্যু সত্য নয়। রেনুর জন্য স্যুপ খুঁজতে দেরি হয়ে গেল। এসে দেখি ও আবার ঘুম। ডেকে তুললাম। মহাবিরক্ত হলো। খাইয়ে দিতে গেলাম, তাতেও বিরক্ত।
‘আমার হাত-পা সব ঠিকাছে। খাইয়ে দিতে হবে না। স্যুপও ঠাণ্ডা। ফ্রিজে রাখা ছিল নাকি! চামচ কেটে খাওয়ার মানে হয় না। এদিকে দাও।’
হাত থেকে বাটিটা নিয়ে একটানে সুরুৎ করে খেয়ে ফেলল। আমি খানিকটা মন খারাপ ভাব করে বসে রইলাম। যদিও আমার মন আগের মতোই।
‘তুমি বাসায় যাও। গ্রিনরোডে না তোমার বাসা? কাছেই তো। আমি একা থাকতে পারব। যাও ভাগো।’
বিরক্তির রহস্য ফাঁস হয়ে গেল। রেনু চায় যেন আমি বাসায় গিয়ে আরাম করে ঘুমাই।
‘ঠিকাছে যাচ্ছি। অ্যান্টিবায়োটিক..।’
‘ওটা দিয়ে গেছে। রাতে আর ওষুধ স্যালাইন নেই। তুমি যাও তো।’
‘ওকে, যাচ্ছি।’
আমি কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এলাম। রেনুর অনেক ক্ষমতা থাকলেও সুপারম্যানের মতো দেয়াল ভেদ করে দেখার ক্ষমতা নেই।
কেবিনের বাইরে একটা লোহার শক্ত চেয়ার রাখা। পরপর তিনটি চেয়ার একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া। মাঝে হাতল দেওয়া। তা না হলে শুয়ে পড়া যেত। গ্রাউন্ড ফ্লোরে অনেকে শুয়ে তাকে। চাইলে তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া যায়। মন চাইল না। রেনুর কাছাকাছি থাকা দরকার। কেন দরকার সেটা জানি না। সঙ্গে পাস কার্ড আছে। যখন খুশি ঢুকতে বের হতে পারব। স্টিলের চেয়ারে বসতেই মেজাজ বিগড়ে গেল। মোটেও আরামদায়ক নয়। কিছুক্ষণ বসে থাকা যায় বড়জোর। বের হয়ে একটু ঘুরঘুর করা যেতে পারে। রাত দুটোর দিকে আবার আসবো। তার আগে মিনিট গা এলিয়ে নেওয়া যাক।
হাসপাতালের গেট পার হয়ে আবার সেই মদিরা রেস্তরাঁ। ম্যানেজার আমাকে দেখে এবার ভয় পেয়েছে। ভাবছে আমি আবার গোয়েন্দা পুলিশ কিনা। খারাপ কিছু না করলে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। তারপরও ম্যানেজার ভয়ে অস্থির।
একজনের বিল হয়েছে দুই শ টাকা। সে পাঁচ শ টাকা দিয়ে তিন শ টাকার জন্য বসে আছে। ম্যানেজার বুঝতে পারছে না কত ফেরত দিতে হবে। দুই শ না তিন শ। বারবার আড়চোখে আমাকে দেখছে। আমিও পাথরের মতো চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছি। মানুষকে ভয় দেখানোর মধ্যে একটা রস আছে। ছয়টা রসের মধ্যে কোনো এক রসে নিশ্চয়ই সেটা পড়ে। আমি কোন রসে আছি সেটা জানি না। তবে বিষয়টা ভালো লাগলো না। ভালো লাগানোর মতো আরো কাজ আছে আমার হাতে।
ছয়টা পরোটার অর্ডার দিলাম। মিনিটের মধ্যে গরম গরম হাজির। রেস্তরাঁয়ার ছাউনির পাশে দাঁড়িয়ে খালি গায়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ছিল ছ-সাত বছরের এক কিশোরী। সঙ্গে তার বড় ভাইও আছে। ছেলেটাও ছোট। বোনকে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। ইশারায় ডাক দিলাম। এলো না। সাহসী ছেলে। ওয়েটারকে ডাক দিয়ে চারটা পরোটা আর ডিম ভাজি দিয়ে বললাম, ওদের দিয়ে আসো। ম্যানেজার তড়াক করে উঠে শিশু দুটিকে ধরে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিল।
‘স্যার বলসে, বসতে। বস! বইসা খাবি। দাঁড়াইয়া খাবি ক্যান।’
কিশোরটা ফোঁস ফোঁস করতে বলল, ‘খামু না! খিদা নাই’।
কিন্তু একেবারে ছোটরা আবার রাগটাগের ধার ধারে না। পিচ্চি বোনটা চিৎকার করে বলল, ‘আমি খামু! আমার খিদা লাগসে!’
চেঁচামেচির মধ্যে উঠে ওয়েটারকে বিল বুঝিয়ে চলে আসলাম। ম্যানেজারের ভিতু চেহারা দেখতে ভালো লাগছিল না।
মনের মধ্যে মিশ্র অনুভূতি। খারাপ ও ভালো লাগা দুটো মিশে নতুন কিছু তৈরি হয়নি। দুটোই আলাদা আলাদা চেম্বারে বসে আছে। এর মধ্যে রেনুর কাছে যাওয়ার তাগাদাটা বড় করে দেখা দিল।
হাসপাতালে ঢুকলাম। নার্স স্টাফরা আমাকে কেন যেন চিনে ফেলেছে। আমাকে দেখলেই তরুণী নার্সরা ফিকফিক করে হাসছে। হাসি অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। আমিও জবাবে হাসলাম। তারপর ওরা একজনের গায়ে রীতিমতো আরেকজন ঢলে পড়ে হাসছে। সো মোশনে দুলছে। বাহ আজকাল এমনও ঘটছে তা হলে!
লিফটে চড়ে উঠে গেলাম বারো তলায়। কেবিন নম্বরটা মনে নেই। হাসপাতালটাও মনে হচ্ছে নড়েচড়ে গেছে। এমনটা হওয়ার কথা নয়। আমি টের পেলাম একটা প্রচণ্ড এবং চেনা আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করছে। আমার মন চট করে ধরে ফেলল এখানে কোনো কেবিনে রেনু নেই। বের হওয়ার সময় আলো-আঁধারি দেখলাম, এখন সবখানে আলো ঝলমল করছে। নার্স-ডাক্তারও অনেক। কিন্তু অপরিচিত মুখই বেশি। ভুল হাসপাতালে ঢোকার প্রশ্নই আসে না। এই এলাকায় আর হাসপাতালই নেই!
‘আপনি ফয়সাল না? আপনাকে রেনু আপা ডাকে। আপনি ডাক্তারদের লিফট দিয়ে উঠেছেন তো এ জন্য চিনতে পারছেন না। ওপাশে যান।’
আটকে রাখা আতঙ্কটা পানির মতো গলে গেল। অন্ধের মতো এগিয়ে গেলাম ডিউটি নার্সের দেখানো পথে। ছাদের মতো খোলা গ্রিল দেওয়া বারান্দামতো একটা জায়গা আছে।
বারো তলায় বাতাসের অভাব নেই। একটু পর ঝড়ও আসবে মনে হচ্ছে। রেনু কোন ফাঁকে শাড়িও বদলেছে। অশরীরি মানবীর মতো তার চুল আর সাদা শাড়ির আঁচল উড়ছে। আমি সাহস করে এগিয়ে গেলাম। আশপাশে কেউ নেই। রেনুর পাশে দাঁড়ানোর সাহস হলো না। দুই হাত গ্যাপ রেখে দাঁড়ালাম।
‘কাছে আসবে না খবরদার!’
‘জ্বি আসব না। সাইড থেকে দেখব। উঁকি ঝুঁকিও দেব না।’
‘তাও তো দিচ্ছো! তোমার চোখ কোথায় ভেবেছো দেখিনি!’
আমি ইচ্ছে করে আরো বেশি করে দেখার ভান করলাম। শাড়িটা আরো উড়ে গেল। শাড়িটা বুঝলো কী করে! অবাক কাণ্ড! ওটাও উড়ছে স্লো মোশনে। সময় আবার দুষ্টুমি শুরু করেনি তো? মাঝে মাঝেই তো আটকে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে। রেনুর মুখে এই হাসি, এই কষ্ট। কখনো ব্যথার ছাপ। কখনো দারুণ প্রেম।
কোন ফাঁকে যে তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছি টের পাইনি। আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে ও। এই অবস্থায় আবার আকাশে ঝাঁপ দেবে না তো! ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম। ভয়ের মাঝেই মাথায় খেলে গেল একটা লাইন, ‘সব পাওয়ার আনন্দ যোগ দিয়ে দেখোই না, তোমার পাশে বসার এক মুহূর্তের নামতা যেন।’
রেনু তার পিঠে হাত রেখে হঠাৎ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে আমাকে ধরলো। আমি সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করছি, ছাড়ো আমাকে, ওড়াওড়ি জাহান্নামে যাক। উড়তে মন চাইলে হাজার হাজার ফ্লাইট আছে। জেট বিমান আছে। তুমি আপাতত রেস্ট নাও।
মুখ দিয়ে কিছু বের হলো না। সব ঘোলাটে হয়ে আসছে। চোখ খোলা, তারপরও মনে হলো সব অন্ধকার। এত আলো এত নার্স-ডাক্তার কেউ নেই। ঝপ করে গোটা ফ্লোরে যেন অন্ধকার চেপে আছে। এর মধ্যে আমি ভেসে যাচ্ছি। ভেসে ভেসে হাসপাতালের ভেতরের দিকে যাচ্ছি।
ভাগ্যিস উড়াল দেয়নি রেনু। একবার হালকা একটা আলো দেখলাম শুধু। কড়া হলেও ভীষণ ঘোলাটে সেই আলো।
কানে একবার বকাবকির মতো কথা ভেসে এলো। ঠিক বুঝলাম না। এরপর দরজা লক করার শব্দ। তারপর একটা পরিচিত গন্ধ। শিউলি না বকুল না কাঁঠালচাঁপা বোঝা গেল না। এর সঙ্গে আবার হাসপাতালের হালকা ফিনাইলের গন্ধও মিশে আছে। বেশ একটা ওম টের পেলাম। প্রবল একটা মায়ার চাদর আমাকে ক্রমে ঢেকে দিতে লাগল। আমি হারিয়ে যেতে লাগলাম অন্য এক রাজ্যে।
নাহ, অন্য কোনো রাজ্য টাজ্য না। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ওই বেঞ্চেই। হোটেলের পরোটা, ম্যানেজার, কিশোর-কিশোরী, নার্সদের হাসাহাসি সবই ছিল স্বপ্ন। জানালা দিয়ে সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙল। পাশে রেনু বসে বসে নাস্তা করছে। হাসপাতালের দেওয়া পাউরুটি, সেদ্ধ ডিম, সঙ্গে আরো কী যেন।
‘কাল রাতে বেঞ্চ থেকে কোলে করে কেবিন পর্যন্ত এনেছি। শাস্তি হিসেবে আজ তোমার খাওয়া দাওয়া বন্ধ।’
আমি তাকিয়ে আছি রেনুর শাড়িটার দিকে। সাদা শাড়ি। স্বপ্নে ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম তেমন।
১৩
এরপর কেটে গেল আরো তিন মাস। প্রথম দুমাস হন্যে হয়ে প্রামাণিক ব্যাটাকে খুঁজেছি। বিন্তিদের কয়েক বাড়ি পরেই নাকি ওর বাড়ি। কিন্তু ব্যাটা তালা মেরে নিরুদ্দেশ। পরিবারে এক মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই নাকি।
গ্রামে আমার কোনো চাকরি নেই যে দিন তারিখের হিসাব রাখতে হবে। মঞ্জু মাসে এক দুবার দেখা করতে আসে। আমার ছবি নিয়ে যায় বিক্রি করতে। আমার হয়ে প্রকাশকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, টাকা পয়সার হিসাব সামলায়। রেনুর সঙ্গে তার ভাবের শেষ নেই। ভাবি ভাবি বলে মুখে ফেনা তোলে। শেষের এক মাসে মনে হলো সে চারবার এসেছে। ঘটনা পরিষ্কার হলো শেষ দিন।
‘এখানে থেকে যাব ঠিক করেছি। একটা পুকুরের ব্যাপারে কথা হয়েছে। মারাত্মক সস্তা। এরকম দশটা লিজ নিয়ে নেব ভাবছি। মাছ চাষ করবো। এত লাভ আর কিছুতে নাই।’
‘ভালো বুদ্ধি। তোর পুকুরে আমি বড়শি ফেলে বসে থাকব, আর হরর গল্প লিখবো। আসল ঘটনা বল এবার।’
‘তুই তোর জীবনকাহিনি লেখ। দেখ ভালো চলবে।’
‘বুদ্ধি খারাপ না। সমস্যা হলো আত্মজীবনী আকারে লেখা যাবে না। কেউ এক বর্ণ বিশ্বাস করবে না।’
‘ভাবি সত্যিই উড়তে পারে?’
‘অবশ্যই পারে। উড়তে না পারলে এতদূর আসি কী করে। কিন্তু এখন আর ওড়ে না। মাঝে মাঝে পূর্ণিমা হলে আমাকে নিয়ে গভীর রাতে নদীর ওপর দিয়ে উড়ে বেড়ায়। কিন্তু তুই সে আশা বাদ দে।’
‘আরে দূর। তোদের ওড়ার ভিডিও করে ইউটিউবে দিতে পারলে হতো। কোটি কোটি ভিউ পেতাম। দুই দিনে লাখপতি।’
‘কেউ দেখবে না। সবাই বলবে এটা এডিট করা। হলিউডের সিনেমায় সুপারম্যান সুপারগার্লদের আরো সুন্দর করে উড়তে দেখা যায়। ওরা মানুষদের বাঁচায় উপকার করে। তোর ভাবির ওসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। চোখের সামনে ঝামেলা দেখলে সেটা না দেখার ভান করে।’
‘শোন তোকে আসল ঘটনা বলি। তোদের পাশেই ঝর্নাদের বাড়ি। মেয়ে হিন্দু। তাতে সমস্যা নেই। দুজনে বিয়ে করবো ঠিক করেছি। তবে ঘটনা একটু ঝামেলার দিকে মোড় নিয়েছে। মেয়ে হিন্দু আমি মুসলমান। তাতে সমস্যা নেই মেয়ের বাবার। কিন্তু ওই ব্যাটা এক বিচিত্র শর্ত দিয়েছে।’
‘কী?’
‘লোকটা পাগল টাইপের। আশপাশের লোকজন তাই বলল। মানুষের দান খয়রাতে চলে। অবশ্য কালিপ্রসন্ন নামটা শুনলেই কেমন ভণ্ড ভণ্ড মনে হয়।’
আমি চুপ করে গেলাম। মনে একসঙ্গে দুটো চিন্তা। নামটা কোথায় যেন শুনেছি। আর লোকটাকে কেন যেন সুবিধের মনে হলো না। কেবলি মনে হচ্ছে কালিপ্রসন্ন মানে একটা ভয়াবহ বিপদ। মঞ্জুকে সাবধান করে দিতে হবে। কিন্তু কী বলে সাবধান করবো। এখনো লোকটাকে দেখিনি।
মঞ্জু তখনো আমাকে বলল না বিশেষ সেই শর্তের কথা। রাতের খাবার খেয়ে সিগারেট নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ইশারা পেয়ে আমিও বের হলাম। বের হওয়ার সময় রেনুর সঙ্গে কড়া দৃষ্টি বিনিময় হলো। অভয় দেওয়া হাসি দিলাম। মানে আমি সিগারেট ধরেও দেখবো না।
মঞ্জু আমাকে টেনে নিয়ে গেল নদীর পাড়ে। যমুনার শাখানদী। পানি সামান্য হলো ঠাণ্ডা বাতাসের অভাব নেই। এদিকে শীত পড়তে শুরু করেছে জাঁকিয়ে।
মঞ্জু শীতে কাঁপছে। পরনে একটা ফুলহাতা শার্ট। আমি চাদরমুড়ি দেওয়া।
‘ঘটনা কী?’
‘ঘটনা হলো কালিপ্রসন্ন রাজি। তবে কঠিন শর্ত দিয়েছে। এত কঠিন যে আমি তার মুখের ওপর থুথু ফেলে এসেছি। জাহান্নামে যাক ঝর্না।’
‘ঝর্নার দোষ কী! তার বাবার না হয় মাথা খারাপ।’
‘হারামজাদা আমাকে বলে রেনু ভাবির একটা পুরনো শাড়ি আর এক গাছি চুল দিতে হবে। তা হলে ঝর্নাকে সে নিজ হাতে আমার হাতে তুলে দেবে। কোনো রা করবে না।’
আমার বিস্ময় খানিক পর হাসিতে রূপ নিল। ‘মানলাম তার ইচ্ছেটা অদ্ভুত। কিন্তু এসব দিয়ে কী করবে জানতে চাইলি না?’
মঞ্জু আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমি একটা প্রথম স্তরের বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন উল্লুক। মানুষ হতে যার বহু দেরি।
‘ব্যাটারা এসব কেন নেয় জানিস না? আর সে আমাকে গোপনে ডেকে নিয়ে তার এই ডিমান্ডের কথা বলেছে। কেউ জানে না।’
‘কিন্তু কারণ…।’
‘কারণ সে রেনুভাবির লোভে পড়েছে। ভাবিকে সে কালোজাদু করে কাছে পেতে চায়। বুঝলি? ব্যাটার কোষে কোষে শয়তানি।’
মঞ্জুর হাত থেকে সিগারেট নিয়ে কষে টান দিলাম। বাসায় যাওয়ার সময় লেবু পাতা হাতে ডলে নিতে হবে। চিবুতেও হবে। অবশ্য তাতেও লাভ হবে না। হাতে লেবু পাতার গন্ধ পেলেও রেনু বুঝে যাবে আমি সিগারেট খেয়েছি। তার শাস্তির ধরনগুলোও অদ্ভুত। এই শীতের রাতে সারারাত বাইরে বসিয়ে রাখতে পারে।
‘একটা বুদ্ধি আছে। ব্যাটাকে গাধা বানানো যায়।’
‘আমি সত্যিই হারামজাদার মুখে থুথু মেরে এসেছি। সে জামার হাতা দিয়ে সেটা মুছেছেও। থুথু মারার পরও হারামির মুখে হাসি। বলে আমি কিনা ঠিকই ফিরে আসবো।’
‘হুম। সে জানে ঝর্নাকে তুই অনেক ভালোবাসিস এবং তুই এসব জাদুটোনায় বিশ্বাস করিস না। এ কারণে সে কনফিডেন্ট যে তুই ফিরে যাবি। আমার বুদ্ধিটা শোন।’
‘কোনো বুদ্ধি টুদ্ধির ধার ধারি না। ঝর্না চ্যাপ্টার ক্লোজড।’
‘যে এমন আবদার করে, তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিলেও তো অন্যায়।’
‘ওকে, বল কি বলবি।’
‘তুই ওকে বিন্তির মায়ের চুল আর শাড়ি দিয়ে আয় তাকে। শেষ বয়সে বুড়ির একজন সঙ্গী হলে মন্দ হয় না। হা হা হা।’
‘কিন্তু কিছু হলে… না মানে। যদি ওই বিন্তির মায়ের.. উফ! তুইও আমার মাথা খাবি নাকি!’
আমার আবার খটকা লাগল। এত ঘন ঘন খটকা লাগার মানে হলে স্মৃতিশক্তি নষ্ট হওয়ার পথে।
‘ওই কালিপ্রসন্ন ব্যাটার পুরো নাম জানিস?’
‘কী যেন প্রামাণিক।’
‘হুমমম..’
মঞ্জুকে ঘটনা জানানোর সময় এসেছে। লজ্জার মাথা খেয়ে সব খুলেই বলতে হলো। শোনার পর ঝিম মেরে বসে থেকে আরেকটা সিগারেট ধরাল। তারপর লম্বা করে দম নিল। বড় লেকচার দেওয়ার প্রস্তুতি।
‘প্লায়ার্স দিয়ে একটা একটা করে দাঁত তুললে কেমন হয়? এটা নাকি সবচেয়ে যন্ত্রণার শাস্তি। আমার মাথায় অবশ্য আরো ভয়াবহ সব আইডিয়া আছে। রিমান্ডের চেয়েও ভয়াবহ। যেমন ধর একটা একটা করে আঙুলে কেরোসিন তেল ব্রাশ করতে হবে। বার বি কিউতে যেভাবে তেল লাগায়। তারপর…।’
‘আপাতত তোকে কিছু করতে হবে না। প্রতিশোধ তো নেবই। তার আগে রহস্যটা জানা দরকার। ওর কাছে একটা কিছু আছে। বই বা নোটবুক টাইপ কিছু। ওতে কিছু সঙ্কেত.. মানে ধর ইয়ে মন্ত্র লেখা আছে। ওটা বাগাতে হবে। ওর জন্য আগের প্ল্যানটাই ভালো। আমাকে সে চেনে। তাই তুই যাবি। শাড়ি আর চুল নিয়ে। আসার সময় চুরি করে ওই নোটবইটা নিয়ে আসবি। আমি লাল রঙের বইটা ওর হাতে দেখেছি।’
‘মনে কর কাজ হয়ে গেছে।’
কাজ হলো না। মঞ্জু ভদ্রলোকের মতো শাড়ি আর চুল দিয়ে এসেছে। নোটবইয়ের ধারেকাছেও যেতে পারেনি। বিন্তির মায়ের শাড়িটা আমিই চুরি করে তাকে দিয়েছি আর চুল নিয়েছি একটা চিরুনি থেকে। করুক তন্ত্রমন্ত্র। এসবে বিশ্বাস করি না। আসলেই করি না? এত কিছু ঘটার পরও?
মনে হয় এখন করি। তবে যাই হোক, ব্যাটা কিছু করার আগেই খতম হয়ে যাবে। ওকে মেরে ফেলার একটা নিখুঁত প্ল্যান আমার করা হয়ে গেছে। অবশ্য অত নিখুঁত হওয়ার কিছু নেই। খুন করে লাশ কোথাও ফেলে রাখলেও সমস্যা নেই। প্রামাণিককে নিয়ে গ্রামের কেউ মাথা ঘামায় বলে মনে হলো না। পুলিশে খবরই দেবে না কেউ।
মঞ্জুর কথা হলো, প্রামাণিককে তার প্রথমে ধরে আছাড় মারতে ইচ্ছে করেছিল। পরে কেন যেন সে ভয় পেয়ে যায়। অদ্ভুত ক্ষমতা আছে লোকটার। পান খায় না। তারপরও মনে হয় মুখে পান নিয়ে সারাক্ষণ চিবুচ্ছে আর বড় বড় চোখ করে বাচ্চাদের মতো হাসছে। তার চোখের দিকে তাকানো যায় না। জিনিসগুলো বাড়িয়ে দিতেই চওড়া করে হাসি দেয়। এরপর ঝর্নাকে ডেকে এনে বলল, ‘যা মা, তুই এর লগে যা। তোর মঙ্গল হইবো। যা, এক্ষণ যা। ওর লগে ঢাহা শহর চইলা যা। আমার একজনের লগে বোঝাপড়া বাকি।’
আমি জানি সে রেনুর কথা বলছে। মঞ্জু ভেবেছে আমার কথা বলেছে। সে আমাকে ছেড়ে যাবেই না। আমি এটা ওটা বুঝিয়ে তাকে ঢাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। ও থাকলে বরং আমার পরিকল্পনায় ঝামেলা বড় হবে।
পরিকল্পনা ফাইনাল হওয়ার পর থেকে আমি রেনুকে কিছুটা এড়িয়ে চলতে শুরু করি। ক্ষত সেরে উঠলেও মাঝে মাঝে পিঠে ব্যথা ওঠে। আমাকে তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হয়। এমনভাবে বললাম যেন কাজটা করতে আমি বাধ্য। আসলে কিন্তু..। সে যাক, বলছিলাম প্রামাণিকের সেই ডায়রি আর তাকে খুন করার কথা।
ক্যালেন্ডারে চোখ রাখলাম। তিন জানুয়ারি বিকেল। গ্রাম পেরিয়ে শহরের একমাত্র সিনেমা হল থেকে তিন ও চার তারিখের একটা বাংলা সিনেমার দুটি টিকিট কাটলাম। রেনুকে বলে এসেছি বাজার করতে যাচ্ছি।
এসব আমার সাজানো প্ল্যান। যদিও এসবের দরকার ছিল না, তবু বিষয়টায় মজা পাচ্ছি। সিরিয়াল কিলাররা যে মজাটা রোজ রোজ পায়।
তিন তারিখ রাত হলো। খুন করবো চার তারিখ ভোরের দিকে। সকাল আটটা নয়টা হলে ভালো হয়। ওই সময় কেউ কাউকে পরিকল্পনামাফিক খুন করবে এটা কল্পনাও করবে না। এরপর যদি পুলিশি ঝামেলায় পড়ি তা হলে চার তারিখের সিনেমার টিকিট দেখাব। মোবাইল ট্র্যাক করেও কিছু পাবে না। ওটা পুরোপুরি বন্ধ থাকবে। হুট করে বাংলা সিনেমা কেন দেখতে গেলাম, সেটার ব্যাখ্যাও তৈরি। বলবো বাংলা সিনেমা যেসব কারণে দুর্দশা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না সেটার ওপর একটা লেখা লিখছি। আমি পত্রিকায় লিখি। আর বইটই লিখি। তারপরের ঝামেলা তারপর দেখা যাবে।
এর মাঝে রেনু আমার মনের কথা পড়েনি। পড়লে দারুণ হইচই শুরু করতো। আমি খুন টুন করি এটা সে চায় না। আবার মনের কথা জেনে ফেলাটাও তার পছন্দ না। যাক, বাঁচা গেল।
আমি আমার মোবাইল ফোনটা আছাড় দিলাম। গ্লাস ভাঙল ভালো মতোই। এরপর রেনুকে বললাম, তুমি কি শহরের দিকে যাবে? ফোনের গ্লাস বদলাতে হবে। আমার আবার একটা লেখা লিখতে হবে আর্জেন্ট।
‘ঠিকাছে যাচ্ছি। আমি পারলে একটু বিথিকেও দেখে আসবো।’
‘ওহ, ঠিকাছে। তাড়াতাড়ি আসো।’
‘তুমি আবার প্রামাণিকের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করো না। ও যে ফিরেছে সেটা আমি জানি। সময় মতো ওকে আমিই দেখবো। সময়টা হোক।’
রেনু সব জেনে গেল নাকি? মনে হলো না। জেনে গেলে যাক। আমি আমার প্ল্যানে অটল। বিনা রণে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনি।
খুন করার অস্ত্রের অভাব নেই। রেনুর চুলের কাঁটা থেকে শুরু করে আমার শেভ করার রেজর। বিন্তিদের রান্নাঘরে চিকন বটিও আছে দুটো। ধার আছে বেশ।
চোরের মতো নয়, প্রামাণিকের আধপাকা বাড়িটার কাছে এগিয়ে গেলাম প্রেমিকের মতো। নির্বিকার চিত্তে। আমার মাথাও আশ্চর্যরকমের ঠাণ্ডা। বারবার একটা কথা উঁকি দিচ্ছে, রেনু আছে, তো কোনো ভয় নেই। সুযোগ পেলে জন্তুটা রেনুর ওপর আবারো হামলা করবে। তার আগে পৃথিবীর প্রাণীজগৎ থেকে তার নামটা কেটে দেওয়া দরকার।
দরজায় টোকা দিলাম। দরজা খুলে দিল শুকনা গোছের এক লোক। কাজ টাজ করে বোধহয়। হতাশ হলাম। প্ল্যানে ফাটল। চেহারা দেখে ফেলল আরেকজন।
‘গুরুজি বাড়ি আছেন?’
‘জ্বি। উনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। আপনাকে ভেতরে যেতে বলেছেন।’
‘আমি এসেছি উনি জানলেন কী করে?’
‘উনি আগেই সব বুঝতে পারেন।’
‘ও, তা হলে তো উনার জানার কথা যে উনার সময় শেষ।’
কঠিন অথচ তরল একটা হাসি হাসলাম। লোকটা আমার হাসির তোয়াক্কা না করে সরে গেল। আমি ভেতরে ঢুকলাম। অস্ত্র হিসেবে আমার হাতে যেটা আছে সেটা অতি সাধারণ বস্তু। দেখে কেউ সন্দেহ করবে না। পকেটে রাখা।
একটা কক্ষের দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। পেটমোটা প্রামাণিক শুয়ে আছে। হাঁপাচ্ছে দরদর করে। আমাকে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মুখের পরিচিত হাসিটা উধাও।
‘পারলাম না। পারলাম না তরে বাঁচাইতে ওই ডাকিনির হাত থেইকা।’
‘কী করে বাঁচাবে শুনি। ডাকিনিকে আমি ভালোবাসি। ডাকিনিও আমাকে ভালোবাসে। আমার জন্য জীবন দিতে তৈরি।’
‘সব মিথ্যা! সব! ও তোকে মিথ্যা দেখাইতাসেরে!’
‘আর তুই আমাকে সত্য দেখাবি?’
ভারটা নেমে গেল। খুনির চরিত্রে ফিরে এলাম। ধীরেসুস্থে কাজটা সারব ঠিক করেছি। ছুরির ঘাই, কিংবা বটি দিয়ে মাথা ফেলে দেওয়াটা শাস্তি হিসেবে নগণ্য।
‘তোর নোটবইটা কোথায়।’
‘ওইটা পুড়ায়া ফালাইসি। কেউ পাইব না আমার ক্ষমতা। আমার ক্ষমতা আমার লগে যাইব, অঙ্গার হইব।’
‘হায় হায়। এখন তোর কোনো ক্ষমতা নাই তা হলে? মারামারি করতে হবে না তোর সঙ্গে?’
‘আমার বিদ্যা মানুষের ওপর খাটে না। নইলে তোরে এখনি হিয়াল বানাইয়া দিতাম।’
‘ও শুধু রেনুর মতো ডাকিনির ওপর খাটে?’
‘রেনু কিডা? ও হইলো কৃ।’
‘কী?’
কালিপ্রসন্ন প্রামাণিকের পেটে কিছু একটা হয়েছে। সে পেট ধরে আছে আর যন্ত্রণায় কোঁ কোঁ করছে।
‘আমারে ডাক্তারের কাছে নিয়া চলরে। ও হারু! হারু! শোন, তুষার, তোরে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করবার পারি আমি।’
‘পেটে কী হয়েছে? গ্যাস? নাকি এপেনডিসাইটিস। কোনো সমস্যা নেই। একটু পর যাবতীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবি।’
‘আরে আমার কিসুই হইব না। আমি চক্রে আটকা পড়ছি। কৃর চক্র খুব খারাপ। খুব খারাপ।’
‘আমি চক্রে আটকা থাকতে চাই। দুনিয়া একটা চক্রে আটকা পড়ে আছে। এটাকে বলে সিমেট্রি। আরো কঠিন নাম আছে, পয়েনকেয়ার গ্র“প। সহজ করে বলি। হাতে অনেক সময়। তোকে আস্তে ধীরে মারবে। ধর পৃথিবীর সব ঘড়ি থামিয়ে দেওয়া হলো। সব ঘোরাঘুরিও বন্ধ। চাঁদ সূর্য সব স্থির। ঠিক এ অবস্থায় অনন্তকাল থাকলেও, পরে আবার যখন সব চালু হবে, তখন মনে হবে সময় একটুও আগায়নি। বুঝতে পারলি কিছু? ঘিলুতে ঢুকেছে?
‘কৃ তোরে খাইবো। ওরা খুব খারাপ।’
‘মানুষের চেয়ে বেশি খারাপ বলে তো মনে হয় না। আর নামটা কী? কিরি? নাকি ক্রিকেটের ক্রি?’
‘তুই যা! ভাগ! ভাগ! নইলে তোরে মাইরালামু! ভাগ! আমার মন্ত্রে হাত দিবি না! খবরদার। তোরে বাণ মাইরা..।’ কথাটা শেষ করার আগেই আমি গ্লাভস পরা হাতে প্রামাণিকের দুই উরুর ফাঁকে স্পর্শকাতর জায়গায় চেপে ধরলাম। কুঁই কুঁই করে উঠল কালিপ্রসন্ন প্রামাণিক। মুখে কথা বের হচ্ছে না। দুহাত জোড় করে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করছে। আমি উদাস হয়ে জানালার দিকে তাকালাম। একটা নীল কাঠঠোকরা সুপারি গাছ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেছে। ঠোকর দেবে আবার দেবে না এমন করছে। কালিপ্রসন্ন একটা কিছু বলার চেষ্টা করলো। চাপটা বাড়ালাম। কথা ফুটলো না ওর মুখে। আমি হাই তুললাম। কালিপ্রসন্নের চোখ ফেটে বেরিয়ে আসবে যেন। তারপর দ্রুত পাগলের মতো হাতের ইশারায় দেখালো একটা সেলফ। ওতেই আছে তা হলে।
ছাড়া পেতেই বড় করে দম নিয়ে আটকে রাখল লোকটা। আপাতত পেট ব্যথার চেয়েও বড় ব্যথা নিয়ে ব্যস্ত সে।
সেলফটা ভালো করে ঘাঁটতেই গোপন চেম্বারটা পেলাম। একপাশে পড়ে আছে বিন্তির মায়ের শাড়ি আর চুল। ওগুলো ব্যবহারের সুযোগ পায়নি ব্যাটা। তার আগেই অসুখে কাত। চেম্বারের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো লাল রঙের মন্ত্র লেখা নোটবই। পরিষ্কার হাতের লেখা। বাংলা উচ্চারণসহ আছে।
নোটবই পরে পড়া যাবে। প্রামাণিকের খাটের কাছে এগিয়ে গেলাম। একটা প্রেসক্রিপশনের মতো কাগজ পড়ে আছে। তাতে পাকস্থলীতে ইনফেকশনসহ আরো কী কী যেন লেখা। লিভার কিডনিতেও সমস্যা। টেবিলে অনেকগুলো ওষুধ। এর মধ্যে দুটো অ্যান্টিবায়োটিকও আছে। অ্যান্টিবায়োটিকগুলো সব পাতা থেকে খুলে মগে রাখা পানিতে গুলিয়ে নিলাম। তারপর পানিটা কালিপ্রসন্নের পেটের ওপর ঢাললাম। চোখ বড় বড় করে দেখলো। কিছু বলল না। ওকে খুন করার জন্য নিয়ে এসেছিলাম সাইকেলের ব্রেকের তার। পেছন থেকে গলায় পেঁচিয়ে হ্যাঁচকা টান দেওয়ার প্ল্যান ছিল। ওটার আর দরকার হবে না। তারচেয়ে কঠিন মৃত্যু অপেক্ষা করছে তার জন্য। ধুঁকে ধুঁকে মরুক হারামজাদা।
চলে যাওয়ার সময় শুকনো মতোন লোকটাকে ডাকলাম। শীতল গলায় বললাম, তুমি হারু? থানা থেকে লোক আসবে একটু পর। গুরুজি যেন পালাতে না পারে খেয়াল রাখবে। গ্রাম কোথায় তোমার?
‘জ্বি আজ্ঞে, আ আ আমি একটা ওষুধের জন্য এসেছিলাম। স্যার আমাকে মাফ করা যায় না। আমি আবার কী বিপদে..।’
‘ভাগো তা হলে।’
লোকটা এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। ছুট লাগাল একদিকে।
এতক্ষণ ফুরফুরে মেজাজে ছিলাম। বাসায় পা রাখতেই আতঙ্কে জমে গেলাম। ফুরফুরে মেজাজ ফুরুৎ করে উড়ে গেল। উঠানে অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেনু। চোখ দিয়ে যেন ঠিকরে আগুন বের হচ্ছে। এই সেরেছে, প্রামাণিকের কথাই তো ঠিক! সত্যি সত্যি ডাকিনির মতো লাগছে রেনুকে।
‘ইয়ে মানে..’ ঝিম ঝিম করে উঠল মাথাটা। সব পড়ে ফেলল রেনু।
এরপর যা ঘটল তার জন্য মনে মনে আমি তৈরি ছিলাম হয়তো। কিন্তু বিন্তি বা তার মা ছিল না। রেনু এগিয়ে এসে ধড়াম করে চড় বসিয়ে দিল আমার বাম গালে। চড় জিনিসটা একটু কোমল ঘরানার শাস্তি মনে হলেও আমার কাছে মোটেও কোমল মনে হলো না। থুথু ফেলে দেখলাম রক্ত বের হচ্ছে কিনা। রেনু বোধহয় দ্বিতীয় আরেকটা মারার চিন্তা করছিল। তার আগেই অজুহাত হিসেবে লাল নোটবইটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরলাম। ভ্রƒ বেঁকে গেল রেনুর। চোখের আগুন কমলো না অবশ্য।
‘এটা আনতেই গিয়েছিলাম।’
‘মিথ্যে বললে এরপর এক লাথিতে নদীতে ফেলবো। গ্রামের সবাই হাজার বছর এই দৃশ্য মনে রাখবে। মারবো লাথি?’
‘আচ্ছ বাবা! খুন তো করিনি। আমার এত সাহস নেই। সঙ্গে ছুরি কাঁচি কিছু আছে! চেক করে দেখো, কিছু নাই! বড়জোর একটু মারতাম ওই বেটাকে। হাত-পা একটা কিছু ভেঙে আসতাম। এখন দেখি সে এমনিতেই মরে মরে অবস্থা।’
‘কী বলো!’
রেনুকে মনে হলো দারুণ দুঃসংবাদ শুনেছে। এক হাতে নোটবই, অন্যহাতে আমাকে আঁকড়ে রীতিমতো উড়ে উড়ে দৌড়াতে শুরু করলো। কিছু চিন্তা করারও সুযোগ পেলাম না। তার আগেই আবার প্রামাণিকের বাসা।
লোকটার হাঁপানি আরো বেড়েছে।
‘আইছস তাইলে! হে হে। আমারে ছাড়া তোর গতি নাই বুঝলি! তখন তরে মুক্তি দিতে চাইলাম। তুমি মুক্তি হইলি না। মানুষের লগে প্রেমের শখ তোর। মানুষটারে ছাড়লি না। আমিও ছাড়ূম না তরে। আমার নাম.. খুক খুকক।’
কাশতে কাশতে আর নামই বলতে পারল না। আমি আলতো করে রেনুর হাত থেকে নোটবইটা নিলাম। চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালাম। এরপর আমাকে ইশারায় বাইরে আসতে বলল রেনু। প্রামাণিকের বাড়ির উঠোনে দাঁড়ালাম। রেনু কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলতে শুরু করল।
‘শোনো, তোমাকে অনেক কিছু জানানো হয়নি। কারণ তুমি বুঝবে না সব। আমি জানি একটা বড় গোলমাল হয়েছে আমাদের। কী হয়েছে তা জানি না। তবে আমার ভাসা ভাসা অনেক স্মৃতি আছে। মানে..।’
খেই হারিয়ে ফেলছিল রেনু। খেই ধরিয়ে দিলাম।
‘মানে, সেই স্মৃতিতে আমার নাম তুষার?’
অবাক হলো রেনু। হাসলাম। বললাম তার বিড়বিড় করে বলার ঘটনাটা।
‘তোমার আর আমার বাস্তবতা এটা নয়। হয়তো অন্য জগতে তুমি অন্যকিছু। আমি অন্যকিছু।’
‘তুমি কৃ?’
‘তুমি জানলে..।’
ইশারা করলাম কালিপ্রসন্নর দিকে। খুব করে মনে করার চেষ্টা করছে রেনু। আমি একটু রবীন্দ্রনাথ কপচে দিতে চাইলাম মওকা বুঝে, ন্যায় অন্যায় জানিনে, জানিনে..’ তৃতীয়বার জানিনে বলার আগেই নোটবুকের একটা পৃষ্ঠায় চোখ আটকে গেল।
‘আচ্ছা, তোমার মতো আরো অনেকেই আছে মনে হচ্ছে।’
‘তুমি দেখি মহাপণ্ডিত! এত কিছু জানো কী করে!’
‘লেখকদের ছোটখাট শার্লক হোমস হতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ লেখকই সেটা জানে না। তারচেয়েও বড় কথা, শার্লক হোমস চরিত্রটা একজন লেখকের লেখা।’
‘ঘটনা বলো।’
‘কৃ ডাকিবার মন্ত্র…।’ এই বলে থামলাম। তারপর যে শব্দগুলো সেগুলোর উচ্চারণের জন্য কিছুক্ষণের প্র্যাকটিস লাগবে। আমি নোটবইটা ঝপ করে বন্ধ করে বললাম, ‘আচ্ছা, এত চিন্তার কী আছে। যেভাবে চলছে চলুক সব। ওই ব্যাটা কদিন পর এমনিতেই শেষ। তারপর তো..।’
‘কিন্তু আমি জেনেশুনে একটা মিথ্যার মধ্যে তোমাকে আটকে রাখতে পারি না।’
‘কিন্তু অ্যালিস যদি তার ওয়ান্ডারল্যান্ডেই থাকতে চায় আজীবন?’
‘কে?’
‘ওহ… অ্যালিস ইন ওয়াল্ডারল্যান্ড পড়োনি! নোটবই নিয়ে গবেষণা পরে হবে। আগে বাসায় চলো। ওর সঙ্গে কাজ নেই। ব্যাটা উল্টোপাল্টা বকবে এখন।’
রেনু নাছোড়বান্দা। কালিপ্রসন্ন প্রামাণিকের চুলের মুঠি চেপে ঝাঁকাঝাঁকি করল কিছুক্ষণ। একটুও প্রতিবাদ করলো না লোকটা। মায়া লাগার কথা। কিন্তু লাগছে না। কারণ কালিপ্রসন্ন প্রামাণিকের বিদঘুটে হাসি। রেনু যেন একটা পুতুল। তার সামনে হম্বিতম্বি করছে কেবল। তারপর খুব ধীরে ধীরে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, ‘তোরে তো ফাঁসাইয়া দিয়া গেলাম এইখানে। তুই কখনো তোর জাতির কাছে ফিরা যাইতে পারবি না। ছেলেটা তো আগেই তোর প্রেমে মইজা গেসে। কিন্তু আমি আমার জগতে ফিরা যাইতাসি। আমার জগতে আমিই রাজা। হা হা হা।’
একেবারে সিনেমার ভিলেনদের মতো করে হেসে উঠল লোকটা। মন চাইল মঞ্জুকে ডেকে এনে প্লায়ার্স দিয়ে একটা একটা করে দাঁত তোলাই।
রেনুকে অনেকটা জোর করে নিয়ে আসলাম। অবশ্য আমরা যখন চৌকাঠ পার হবো তখন কালিপ্রসন্ন যা বলল তাতে আমি আবার নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম।
‘যাহ যাহ! আমি মইরা গেলে পোলাটারে তার দুনিয়াতে নিয়া যাওনের রাস্তা একটাই। তোরে মরতে হইব।’
‘দূর ছাই! এসব হাবিজাবি শোনার টাইম নাই। চলো, ঢাকায় ঘুরতে যাই। অনেকদিন ঢাকা দেখি না।’
‘নোটবইটা আমাকে দাও।’
আদেশের সুরে বলল রেনু। সুতরাং মানতেই হবে। গ্রামে আমাদের আদিখ্যেতা আহ্লাদের কথা সবাই জানে। আমরা তোয়াক্কা করি না। গ্রামের লোকেরাও করে না। আমি রেনুর কোমার জড়িয়ে ধরি হাঁটি মাঝে মাঝে। আজ আর সাহস হলো না। পাশপাশি হাঁটছি, অথচ হাত ধরছি না, এটা নবম আশ্চর্য বটে। অষ্টমটা হলো রেনু আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। একমনে উল্টে যাচ্ছে নোটবইটার পাতা।
১৪
সপ্তাহখানেক পরের কথা। ওই প্রামাণিক মরে গেছে দিন তিনেক আগে। গ্রামের লোকজন কোনোমতে সৎকার করে বাঁচল। আমি আর রেনুও ছিলাম। সবার কাছে সে ছিল মাথা খারাপ হওয়া লোক। আমার আর রেনুর কাছে মনে হলো হারামজাদা পেটের ভেতর একগাদা রহস্য নিয়ে চলে গেল।
আমি যখন কিনা রহস্যের একটা কিছু আঁচ করতে শুরু করেছি, এর মাঝে একদিন হুট করে রাত বারোটায় চোখের সামনে এক অন্য রেনু এসে হাজির। অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে। তাকে এমন পোশাকে দেখেছি বলে মনে হলো না। আবার মনে হলো দেখেছিও।
‘এমন শহুরে মেম সাজলে হঠাৎ।’
‘তুমি জানো না। গ্রামে আজকাল এ সব পাওয়া যায়।’
‘কিন্তু এই স্টাইল করা ফতুয়া আর জিন্স পরা অবস্থায় তোমাকে নিয়ে যাব কোথায়? গোটা গ্রামের ঘুম ছুটে যাবে।’
‘গেলে যাক। গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরবো। বাইরে যাবো।’
‘আজ জোৎস্না? কদিন আগে না চাঁদ ছিল। চাঁদের টাইম কি চেঞ্জ হয়ে গেল নাকি। কিন্তু ঘটনা হলো তোমাকে এমন খুশি খুশি দেখাচ্ছে কেন?’
‘এমনি। নোটবইটা আজ ফেলে দেব ঠিক করেছি। ওটার আর দরকার নাই। আমরা তো এই বেশ আছি।’
এবার ভালো করে তাকালাম রেনুর দিকে। চাপা কষ্টটা আর লুকানো গেল না। রেনু যদি সত্যিই কৃ নামের জিনিসটা হয়ে থাকে তবে তারা অভিনয়ে মানুষের চেয়ে অনেক কাঁচা বলা যায়।
আমাদের রুমে সাধারণত বিন্তি বা কেউ আসে না। তারপরও দরজা লাগিয়ে দিলাম। রেনুর হাত ধরে বসালাম। আমার মুখে চিন্তার ছাপ নেই। কারণ আমি কৃ না। খাঁটি মানুষ। এরপর মুখে একটা সিরিয়াস ভাব ফুটিয়ে যে রহস্যের সামান্য কিনারা করতে পেরেছি সেটা রেনুকে বলতে শুরু করলাম।
‘আমাদের জগতে কিছুটা না, বড় ধরনের গোলমাল আছে। প্রামাণিক ঠিক বলেছে। তুমি খেয়াল করে দেখো, বিন্তিদের বাড়িতে কোনো মেহমান আসে না। কারো কোনো রোগ শোক নেই। সবকিছু একেবারে স্বপ্নের মতো চলছে। মঞ্জু নিয়ম করে গ্রামে আসে যায়। আমাদের টাকা নিয়েও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তোমার কি মনে হচ্ছে না আমরা একটা পারফেক্ট রুটিনে চলে এসেছি। মানে আমাদের ঘিরে গোটা জগৎটা…?’
রেনু মাথা নিচু করল। তারমানে বিষয়টা সে জানে। এ জন্যই প্রামাণিকের অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিল।
‘এর জন্য প্রামাণিক ব্যাটা তোমাকে দায়ী করে গেছে। তাই বলে নিজেকে অপরাধী ভাবার কিছু নেই। আমার তো মনে হয় ওই নোটবইতে একটা কিছু আছে যেটার পাঠোদ্ধার করা অসম্ভব না।’
‘আমি হাজারবার চেষ্টা করেছি। সব কিছু পড়ে দেখেছি। ছাইপাশ সব মন্ত্র, কিছুতে কিছু হয় না।’
‘হুমম।’
এবার আমার সত্যিকার অর্থে চিন্তা করার পালা। নোটবইটা হলো একটা ধাঁধা। যেটার সমাধান সহজে মিলবে না। কঠিনে মিলবে। অর্থাৎ চোখে যা দেখবো তাতে কিছু হবে না। অন্য কিছু লাগবে। সেই অন্য কিছুটা খুঁজে বের করতে হবে।
চোখ বুঁজে সেই রাতের কথা ভাবতে বসলাম। যে রাতে প্রামাণিক রেনুকে ছুরির ঘাই দিয়েছিল। রেনু আলগোছে আমার কোলে তার মাথা ছেড়ে দিল। এতে অবশ্য ভাবনার ব্যাঘাত ঘটল না। রেনু কাছে থাকলে কেন যেন মাথাটা হালকা হয়ে যায়। গুন গুন করে গাইতে ইচ্ছে করে একটা কিছু। গুন গুন! একটা সুর! না না! সুর না ঠিক! একটা বিশেষ ধরন, প্রামাণিক যখন মন্ত্রগুলো পড়ছিল তখন সে একটা স্টাইলে পড়ছিল। কেমন যেন একই শোনাচ্ছিল তার কথাগুলো। গান নিয়ে আমার কিঞ্চিৎ জানাশোনা আছে। প্রামাণিকের গলার কম্পনটা আবার কল্পনায় শোনার চেষ্টা করলাম। একটাই কম্পন, একটাই মাত্রা, একইটাই স্কেল! পেয়েছি!
‘পেয়েছি!’
মাথা তুলল রেনু।
‘নোটবইটা দাও। আর উড়ে গিয়ে কোথাও থেকে একটা হারমোনিয়াম নিয়ে আসো। পারবে?’
‘রাতদুপুরে ওড়াওড়ি করলে সমস্যা নেই, কিন্তু খবরদার গান গাইতে শুরু করবে না!’
‘আরে গান গেয়ে সবার ঘুম হারাম করে দেব। খবর হয়ে যাক। সবাই ভয়ে হার্টফেল করুক। এ জগৎ আমাদের না। এখানে যা খুশি হোক। আমি রাস্তা পেয়ে গেছি।’
নোটবইটা ওলটাতে লাগলাম পাগলের মতো। জগৎ পরিবর্তন জনিত কোনো মন্ত্র পেলাম না। তবে কৃকে আহ্বান করার মন্ত্রটা পেলাম। প্র্যাকটিস করে নিলাম বিচিত্র শব্দগুলো। মিনিটখানেক পর নতুন একটা হারমোনিয়াম হাতে হাজির কৃ। কোনো দোকান থেকে তুলে এনেছে সম্ভবত। একদম নতুন।
স্কুলে থাকতে কিছুদিন গান শিখেছিলাম। রাগ খাম্বাজ আর আশাবরী এখনো মনে আছে টুকটাক। মুদারা সপ্তকে সারেগামার স্কেল ঠিকাছে কিনা পরীক্ষা করে নিলাম। প্রামাণিকের গলার পিচ ছিল উদারা সপ্তকে। মানে আরো গম্ভীর গলা। আমি মুদারায় সা বাজালাম। তারপর প্র্যাকটিস করে নেওয়া মন্ত্রটা ঠিক ওই সা’তেই বসালাম। মানে বলতে শুরু করলাম শব্দগুলো। একই তরঙ্গদৈর্ঘ্য।ে রেনু চোখ কুঁচকে আমার কারবার দেখছে। কিছু বলছে না। কিছু ঘটলোও না।
‘তুমি কি একটু বাইরে যাবে?’ রেনুর সামনে এমনিতে অস্বস্তি না লাগলেও এখন লাগছিল। কারণ ওর সামনে আমি কখনও গুন গুন করেও গাইনি। ও চলে গেল দ্রুত।
আবার শুরু হলো আমার মধ্যরাতের সারগাম মন্ত্র। সা থেকে শুরু। কোমল গান্ধারে আসতেই মনে হলো একটা কিছু ঘটছে। মগজে আবার সেই ঝলকানি টের পেলাম। বাইরে বাতাসের তোলপাড়ও। রেনু ছুটে এলো আমার কাছে। আমি থামার পাত্র নই। মন্ত্রটা বিড়বিড় করে আওড়ে গেলেও স্কেল থেকে টলছি না। হারমোনিয়াম থাকাতেই রক্ষে। খালি গলায় এমন স্কেল ধরে রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব। বাতাসের শব্দ বাড়তে বাড়তে হুট করে থেমে গেল। যেন দরজার কাছে এসে দাঁড়াল কেউ।
‘আসতে পারি?’
‘জ্বি আসুন।’
আমি যতটা সম্ভব খোশমেজাজ দেখালাম। রেনু বিস্ময়ে কথাই বলছে না। নিজেকে ওর সামনে নায়ক নায়ক লাগছিল।
ঘরে ঢুকলো নম্র ভদ্র চেহারার একজন লোক। প্রথমে মনে হলো আমার বাবার মতো চেহারা, মুহূর্তেই আবার সেটা হয়ে গেল রেনু আর বিথির বাবার মতো। একটু পর আবার মঞ্জুর মতো মনে হলো। বুঝলাম এই লোকটা আমার মগজ থেকে চেহারা চুরি করে সেটা রি-ক্রিয়েট করার চেষ্টা করছে।
‘এককাজ করেন। আপনি রেনুর বাবার চেহারায় আসেন।’
তাই করলো লোকটা। রেনুকে আগের চেয়ে স্বাভাবিক মনে হলো যেন।
‘কেমন আছো…।’
কথাটা রেনুকে বলল। রেনু উত্তর দিল না। সে লোকটাকে চেনার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। লোকটা আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। অথচ কষ্ট করে মন্ত্রটন্ত্র পড়লাম আমি।
‘তোমরা যে একটা..।’
‘জ্বি সেটা জানি। বুঝতে পেরেছি বলেই আপনাকে ডেকেছি। আমরা আমাদের আসল জগতে যেতে চাই। যেখান থেকে এসেছি। যেখানে আমার নাম তুষার, আর ওর নাম কৃ।’
‘ওর নাম..।’ লোকটা বলতে গিয়ে থমকে গেল। তারপর ধীর লয়ে বলল ‘কৃ.. হুম। কিন্তু আমি তো সেটা পারবো না।’
আমার সঙ্গে আর বিশেষ আলাপ হলো না। রেনু ইশারা করতেই আমি বাইরে উঠানে এলাম। মাথার ওপর গোলগাপ্পা চাঁদ। সত্যিই বিচিত্র এ জগৎ। প্রতিরাতেই দেখি পূর্ণিমা।
লোকটার মুখ থেকে বের হওয়া বিশেষ কিছু শব্দ শুনতে পেলাম। রেডিওর নব ঘোরানোর সময় যেমন শব্দ হয়, অনেকটা ওই রকম। এটাও মনে হয় অন্য জগতের কোনো স্বরলিপি। যে গানটা বুঝতে হলে আগে ওই সারগাম শিখতে হবে। আপাতত সে চেষ্টা নিরর্থক। জানালার ফাঁক দিয়ে রেনুর চেহারা দেখলাম এক ঝলক। দেখে মনে হলো সে ওই কৃর সব কথাই বুঝতে পারছে। কথাবার্তা শেষে লোকটা যেভাবে এসেছিল সেভাবে চলে গেল। আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। তার কাছে মানুষ যেন একটা নিচুস্তরের প্রাণী। ‘হুহ’ জাতীয় শব্দ করে আমিও নিজেকে বড় কিছু প্রমাণ করে ঢুকে পড়লাম ঘরে।
খাটের ওপর চুপচাপ বসে আছে রেনু। ভাবছে আমাকে কীভাবে কী ব্যাখ্যা করবে।
‘শোনো এখন ঘুমাও। অনেক রাত হয়েছে। আর কিছু খেলে বলো। উড়ে গিয়ে নিয়ে আসি।’ হড়বড় করে বলল রেনু।
‘এত রাতে আর উড়ে কাজ নেই। তুমি শুয়ে পড়ো। আজ আমরা জোৎস্না দেখবো আর ওটা করবো। হে হে।’
‘বাজেভাবে হাসবে না। বাজে হাসি দিয়ে বলল কিছুই হবে না। রোমান্টিকভাবে বলতে হবে।’
বুঝতে পারছি পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করছে রেনু। কারণ লোকটা তাকে ভালো কিছু বলে যায়নি মনে হয়।
‘খাবারের কথা বলতেই তোমার চেহারা ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। দাঁড়াও, বিস্কিট আর কলা নিয়ে আসি। বাসাতেই আছে। উড়তে হবে না।’
রেনু খাবার নিয়ে এলো না। এলো বিন্তি আর তার মাকে নিয়ে। বাকি দুজন রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে। কৃকে আসতে দেখেছিল নিশ্চয়ই। বিন্তির মা বলল, ‘বাবারা, তোমরা কী আমি জানি না। তবে বিন্তি আমার আদরের মেয়ে। ওর কোনো ক্ষতি যেন না হয়। তোমরা চইলা যাও। পারলে আইজকা রাইতেই যাও। আমার বাসায় উল্টাসিধা কাজ কারবার হইতেসে। তোমরা..।’
‘আচ্ছা, আমাদের ঘণ্টাখানেক সময় দিন। গুছিয়ে নিই। আর ঘরে কলা বিস্কিট থাকলে দিন। খিদে পেয়েছে। খেয়ে বিদেয় হই। রেনু তুমি বসো। বিন্তি যাও, কলা বিস্কিটা নিয়া আসো।’
১৫
রাতেই ঢাকায় চলে এলাম। আমার ফ্ল্যাটে। মঞ্জু নেই। ফ্ল্যাটের অবস্থা দেখে মনেও হয় না কেউ থাকে এখানে। তালাচাবির বালাই নেই যদিও, তবু আমার কাছে এক্সট্রা চাবি ছিল একটা।
ঢাকায় আসতে বেশিক্ষণ লাগেনি। রেনুর শরীর এখন সুস্থ। তবে বেশিক্ষণ উড়লে একটা কাণ্ড ঘটে। কাণ্ডটা আমি চুপ করে উপভোগ করি। উড়তে হয় রেনুকে জাপটে ধরে। এতে তার শরীর একটা ঘ্রাণ আমার শরীরে চলে আসে। সহজে যায় না। আমি বসে বসে সেই ঘ্রাণটা নিতে থাকি।
‘এবার বলো তোমাকে ওই কৃ মশাই কী বলেছে?’ আয়েশ করে খাটে পা তুলে বসলাম।
‘তুমি বুঝবে না।’
‘আরে বোঝাও না। তবে ঘটনা যদি কোয়ান্টাম তত্ত্বের মতো জটিল কিছু হয় তবে বাদ দাও।’
‘তারচেয়েও জটিল।’
‘তা হলে বলো। চট করে বুঝে ফেলব।’
রেনু ঠোঁট বাঁকা করে বিছানায় পা দোলালো। আমার মনে হলো আগেও এ দৃশ্য দেখেছি। তবে বিছানা এটা ছিল না। দেজা ভ্যুগুলো সত্যিকারের স্মৃতি হতে পারে। বাস্তবতা বদলে গেলেও ব্রেইনের কিছু কিছু নিউরন কিছু স্মৃতিকে প্রবল প্রতাপের সঙ্গে আটকে রেখেছে।
‘সত্যিটা বললে তুমি আমার গলা টিপে ধরবে।’
বাসায় এসেই সবার আগে কাপড় বদলেছিল। আমার আলমিরায় একটা লাল শাড়ি ছিল। সম্ভবত বিথির ওটা। রেনুকে দেখাচ্ছে ডানাবিহীন লাল পরীর মতো। এই পরীর গলা টিপে ধরা কোনো সাইকোপ্যাথের পক্ষেও সম্ভব কিনা…।
‘আমারই দোষ।’
‘কোনটা?’
‘সব।’
‘এখন কী করবে তা হলে? আমার বাস্তবতা বদলে দেবে?’
‘সেটাই করতে হবে। তুমি হচ্ছো আমার সেই নীল ফুল, যাকে ধরতে গিয়েও…।’
‘দাঁড়াও দাঁড়াও, এসব উপমা কবিতা শের সায়েরি লেখা আমার কাজ, তুমি লিখতে যেও না। তা হলে আর আমার বই এক কপিও চলবে না।’
‘তোমাদের বোঝা মুশকিল।’
‘আমাকে দেখছো তো, এজন্য এটা বললে। মঞ্জুকে বোঝা দুই মিনিটের কাজ। আর আমার মা তো আরো সহজ সরল ছিলেন।’
‘উঁহু। তারপরও।’
‘আর তোমাদের বোঝা খুব সহজ? আচ্ছা ভালো কথা, তোমাকে এখন কী নামে ডাকবো? রেনু নাকি মিকরি?’
‘কৃ। শুধু কৃ বলে ডাকতে পারবে না?’
‘আগে কেমন শোনাতো জানি না। তবে এখন এর চেয়ে প্রেমময় ডাক আর কী আছে, বলো কৃ।’
‘ফাজলামো করবে না। অসহ্য!’
‘কী করবো তা হলে? সারাক্ষণ পুতুপুতু করে প্রেমের কথা বলবো? নাকি ওটা..। মানে যেটা আমাদের বিন্তিদের বাড়িতে..।’
উড়ে এসে আমার কোলে জুড়ে বসল রেনু। আমার কাছে এবারও বেখাপ্পা লাগল। ছেলেরা অনেক কিছু অতিকল্পনা করতে ভালোবাসে। বিশেষ করে প্রেমিকাকে নিয়ে। আমার বেলায় অতিকল্পনাগুলোই অতি স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। আবারো বুকে ছ্যাঁৎ করে উঠল, স্বপ্ন টপ্ন দেখছি না তো? ঘুম ভেঙে দেখবো রেনু টেনু কেউ নেই। দশটা বেজে গেছে। উঠে তাড়াতাড়ি খেয়ে না খেয়ে অফিস। উফফ। নাহ.. স্বপ্নটাই থাকুক।
‘দেখো, আমাদের যে ক্লাইম্যাক্সওয়ালা জীবন এটার জন্য মানুষ হা-পিত্যেশ করে। মানে সারাক্ষণ হায় হায় করে। এ জন্য একটু টাকাপয়সা হলে মানুষ আর কিছু না হোক প্যারাসুট বেঁধে আকাশ থেকেও লাফ দেয়।’
‘আমরাও লাফ দেব। তোমার ক্লাইম্যাক্স দরকার? এক মাইল উপর থেকে ছেড়ে দেই?’
‘তোমাকে ভয় পাই না।’
‘যদি আর না ধরি? পড়ে তো ভর্তা হয়ে যাবে।’
‘ও….।’
‘কী? কী বুঝতে পেরে গেলে এর মধ্যে আবার।’
রেনুর চোখে প্রশ্নের পাশাপাশি দুশ্চিন্তাও। আমি যা ধরেছি, সেটাই সে ভাবছে কিনা।
‘তুমি আমাকে এ জগতে মেরে ফেলার প্ল্যান করছো না তো? মানে এখানে মরে গেলাম, পরে অন্যজগতে ঘুম থেকে উঠলাম। এরকম একটা সিনেমা দেখেছিলাম একবার। ক্রিস্টোফার নোলানের। সিনেমার নাম ইনসেপশন। স্বপ্নের ভেতর মারা যাওয়া মানে আরেক জগতে ঘুম ভাঙা।’
‘আমাকে রিরিসা সব বলেছে। মানে ওই যে এসেছিল। সমস্যা হলো আমার কিছুই মনে পড়ছে না। কিন্তু…।’
‘আগে বলো আমাকে মেরে ফেলবে কিনা। তা হলে মানসিক প্রস্তুতি নিই।’
‘আমার হাতে মরতে তোমার মানসিক প্রস্তুতি লাগবে?’
‘কী করি বলো প্রিয়, মরি তো প্রতিদিনই, কিন্তু মরলে যে আবার তোমায় দেখবো না।’
‘এত ঘনঘন সায়েরি কপচাবে না। সস্তা হয়ে যাচ্ছো দিন দিন।’
‘ঠিকাছে। এই আমি উঠলাম। আর পাবে না। পালিয়ে যাচ্ছি। দেখি খুঁজে পাও কিনা। ওহ.. ভালো কথা। নীল ফুলের বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করো। কথাটা শেষ করোনি।’
‘থাক, শুনতে হবে না।’
‘মেলোড্রামা ভালো লাগে না। জলদি বলো।’
‘আমার লাগে। তখন শোনোনি কেন!’
গুটি গুটি পায়ে আবার বিছানার দিকে এগোলাম। রেনু ভান করছে সে খুব ভয় পেয়েছে। পিছু হটছে ধীরে ধীরে। তার শাড়ির এক কোনার দখল নিয়ে নিলাম চটজলদি। এক টানে প্যাঁচ ছাড়াতেই পুরোপুরি নগ্ন কৃ। যথারীতি নিয়মমাফিক চুম্বনের ধার ধারলাম না। ঘাড়ের কাছে কামড়ে দিলাম, হালকা রাগ দেখিয়ে। ‘উহ’ শব্দ করে গলা জড়িয়ে ধরল কৃ।
এরপর বিড় বিড় করে বলল, ‘ওরে আমার নীল ফুল।’
আমার মুখে শব্দ নেই। মুখ অন্য কিছু খুঁজছে। কৃ সেটা সহজে পেতে দিতে নারাজ।
‘তুমি ছিলে অনেক উঁচু থেকে দেখা একটা ছোট্ট নীল ফুল।’
‘কত উঁচু থেকে?’
‘তা ধরো বিশ ত্রিশ তলা বিল্ডিং তো হবেই। আমি নিচে তাকালাম, আর দেখলাম তোমাকে। নীল ফুলের মতো। তারপর আমার কী হলো, সব নিয়ম ভুলে গেলাম। সব তুচ্ছ মনে হলো। তোমার স্বাভাবিক জীবনটাও থামাতে পারেনি আমাকে।’
আমার কান দিয়ে কথাগুলো ঢুকে ঢুকে মাথার ওপর দিয়ে নীল রঙের বাষ্পের মতো উবে যাচ্ছে। কারণ আমি তখন আমার দুধে আলতা রঙা ফুলের পাপড়ি নিয়ে ব্যস্ত। দুহাতে বারবার মেপে যাচ্ছি রেনুর দেহের সোনালী অনুপাত।
‘তারপর একদিন ঠিক করলাম, ঝাঁপ দেব। নীল ফুল আমার চাই।’
‘এত উঁচু থেকে ঝাঁপ দিলে তো..।’
‘ঠিক ধরেছো, মরে যাব। কিন্তু মরার ক্ষণিক আগে তো আমি ফুলের খুব কাছে আসতে পারবো, তাই না?’
রেনুর শেষ কথাটায় অন্য কিছু ছিল। আমি থেমে গেলাম। দুজন পাশাপাশি নগ্ন। আমার হাত আলতো করে রাখা রেনুর কোমরে। চোখ রাখলাম রেনুর চোখে। মানুষকে সে যতটা আন্ডার এস্টিমেট করে আসছে, মানুষ আসলে তারচেয়ে বেশি চালাক।
‘আচ্ছা। তা হলে এখন তোমার সেই ঝাঁপ দেওয়ার মুহূর্তটা চলছে?’
‘হুম। এবার তো জেনে গেলে সব। ভালোবাসবে আমাকে?’
‘আমার তো মনে হচ্ছে তুমিও বাস্তবতা বদলাতে পারো।’
রেনু চুপ। স্বীকারোক্তির ইঙ্গিত?
‘মনে হয় পারি। আমি নিশ্চিত নই।’
‘তো আমরা যেমন ছিলাম তেমনটা আবার..।’
‘ওই যে বললাম, নীল ফুলটাকে খুব কাছ থেকে একটুখানি এক মুহূর্ত ছুঁয়ে মরতে চাই। বাস্তবতা বলে আবার কিছু আছে নাকি! আমার বাস্তবতা তো তুমি!’
আমি উঠে ঢকঢক করে গ্লাস ভরে পানি খেলাম। মাথার ভেতর ফিজিক্স কিলবিল করতে শুরু করলো। রেনুও ঢুকে পড়েছে এর মধ্যে, আমার মাথায়।
‘শোনো, প্লিজ। ঘাবড়ে যেও না। এখনো অনেক সময় বাকি। আর যে এসেছিল সে মিথ্যে বলেনি। আমি তো জানোই মাথার ভেতর ঢুকে পড়তে পারি। আমি রিরিসার সব কথা যাচাই করে দেখেছি।’
‘মানে কী!’ চেঁচিয়েই বললাম কথাটা। আমার নিউরনে নিউরনে যুক্তির ঝড়। রেনুর উপমাটাকে যদি অংকের মতো সাজাই, তবে আমি হলাম রাস্তায় পড়ে থাকা একটা নীল ফুল। সেটা নেওয়ার জন্য ঝাঁপ দিয়েছে রেনু। সে এখন ফুলের খুব কাছে। ফুলটা ছুঁলেই তার কাজ শেষ। এরপর সে মরে যাবে।
‘তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাব। এটাই আমার মৃত্যু। আমাদের সম্পর্কের মৃত্যু।’
‘হেঁয়ালি যথেষ্ট হয়েছে রেনু। এবার সত্যিটা বলো।’
‘নদীর তীরে যাবে?’
‘নদীর তীর সবসময়ই আমার প্রিয় ছিল। এ কারণে সেখানে নিয়ে যেতে। এখন বুঝতে পারছি। আমার মন যা চায় সব তুমি দেবে, তাই না?’
‘তুমি তা চাও না।’
‘সম্ভবত না!’
হাসার চেষ্টা করলো কৃ। আমার রাগের কাছে সহজে হার মানার পাত্রী নয়।
‘আর নদীর তীর না। সদরঘাটে নিয়ে চলো। বুড়িগঙ্গার ময়লা পানির পাশে বসে আমি তোমার কথা শুনতে চাই।’
নগ্ন অবস্থাতেই রেনু আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার মন চাইল একবার কাপড় টাপড় পরে নেওয়া দরকার। পরে আবার ভাবলাম, এ জগৎই তো আমার না, আমাদের না। চুলোয় যাক পোশাক।
দুজনে উড়ে গিয়ে পৌঁছলাম একটা জলাভূমির মতো জায়গায়। ভোর হতে এখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। দুজন গা ঘেঁষে বসে আছি চুপচাপ।
‘তুমি আমার সেই ফুল, যাকে আমি কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারিনি।’
‘তুমি দেখছি আমাকে কপি করতে শুরু করেছো। কবিতা লেখা জীবনানন্দ আর আমার কাজ। তুমি লিখলে সেটা ভয়াবহ একটা বস্তু হবে। কারণ তুমি মন পড়তে জানো। সব পাঠককে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেবে। পরে আমার বই চলবে না।’
‘কেন গালিব কী দোষ করলো?’
‘ওই ব্যাটা ধার করে মদ খাওয়ার জন্য যা খুশি বলতো আর লোকে তাতেই বাহ বাহ করতো।’ ‘কোলে মাথা রেখে শোবে? আজ আর বাধা দেব না।’
‘জাদু টাদু করে আগে জামা-কাপড় পরাও। তা না হলে পরে আবার আরেক ঝামেলা।’
‘এদিকে কেউ আসে না। আমি আগে আসতাম। যখন তুমি ছিলে না।’
‘বলো কী! তোমার বয়স কত! আমি ছিলাম না মানে! এখানে বসে বসে ডায়নোসর দেখতে?’
হাসল রেনু। পরিচ্ছন্ন নির্মল হলেও মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার মতো হাসি। ভয়টা হলো তাকে হারানোর। আমার প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বুঝি সময় শেষ। এখুনি সিনেমা শেষ হবে, লোকজন বের হয়ে যাবে। রেনু চলে যাবে তার না ফেরার দেশে। আমি আমার বাস্তবতায়। কী ভয়ানক! মনের ভেতর উঁকি মেরে আবার শুনে ফেলল কথাটা।
‘মোটেও ভয়ানক নয়। তুমি তোমার বাস্তবতায় কী করতে শুনি? বিয়ে করতে, সংসার করতে, একসময় স্ত্রী হয়ে যাবে শুধু সঙ্গী। এরপর দুই বুড়ো-বুড়ি, এরপর তো মরেই যাবে। তো আমি কী দোষ করেছি? আমার সঙ্গেও একই জীবন চলুক না?’
‘তুমি সুইসাইড করেছো। নিজেকে জেনেশুনে মেরে ফেললে তুমি।’
‘সব কিছুই তো শেষের দিকে এগিয়ে যায়। আমিও যাচ্ছি না হয়। আর তোমরা মানুষরা যখন কেউ কাউকে খুব করে ভালোবাসো, তখন তো এটা ভাবো না যে একদিন তোমাদের কেউ একজন মরে যাবে।’
‘এটা মানুষের একটা মনুষ্য বৈশিষ্ট্য বুঝলে! এটাই আমাদের জীবন।’
‘কিন্তু সত্য তো এটাই। আমার সত্যের সঙ্গে এ সত্যের কোনো পার্থক্য আছে?’
‘অবশ্যই আছে। আমি স্বাভাবিক হতে পারছি না। তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে হবে, এটা আমি ভাবতাম না, এখন মাথায় সারাক্ষণ এটাই ঘুরছে।’
‘চিন্তা করো না, বেশি সময় ঘুরবে না। যাবার আগে তোমায় একটা উপহার দিয়ে যাব।’
‘আমি তোমার আর একটা কথাও শুনবো না। দয়া করে পারলে সব ভুলিয়ে দাও। অন্য এক বাস্তবতায় নিয়ে চলো। যেখানে আমি জেমস বন্ড আর তুমি বন্ড গার্ল।’
‘ওটা আবার কী বস্তু! অন্য কোনো দেশে যাবে? আরেকটু বেশি সময় যদি জড়িয়ে ধরতে পারো সোজা অস্ট্রেলিয়া না হয় নিউজিল্যান্ডে…।’
‘আমি নীলগিরি যাব। তারপর সেখান থেকে ঝাঁপ দিব। ঝাঁপ দিয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসবো। আমার ইচ্ছা!’
এরপর রেনুর চুম্বনটা প্রত্যাশিত ছিল না। ছিল ঘাবড়ে যাওয়ার মতো। আমার ঠোঁট কেটে একাকার। রেনুর পরনে কিছু নেই যে সেটা দিয়ে চেপে ধরবে। হাত দিয়েই নিজের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করছে। ঠোঁট কাটলে রক্ত একটু বেশিই বের হয়। খুব ভালো হয়েছে। এতক্ষণ আমাকে মানসিক অত্যাচার দেওয়ার কঠিন প্রতিশোধ।
‘হয়েছে। ব্যথা লাগছে না বেশি। এবার কান্নাকাটি থামাও।’
কান্নাকাটি থামাতে বলা ঠিক হয়নি। ফিক ফিক কান্নাটা ভেউ ভেউতে পরিণত হলো। এক সময় সেই কান্না হয়ে গেল অন্যরকম। মানে জাগতিক কোনো প্রাণীর কান্নার মতো মনে হলো না। রেনুর এ দৃশ্য দেখে আমার হাহাকারটা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেল। রেনু কি সেটা বুঝতে পারছে? আমি বুঝতে পারছি, রেনুর হাতে বেশি সময় নেই। আবার হয়তো আছে। সময় জিনিসটাই গোলমেলে। রেনুর হাতে একশ বছর থাকলেও এখন মনে হচ্ছে সেটা না থাকার সমান। কারণ আমাদের এক শ বছর একসঙ্গে কেটে গেলেও একসময় আমি আমার আরেক বাস্তবতায় চলে যাব। বিষয়টা এত দ্রুত কী করে বুঝে যাচ্ছি সেটাও এক রহস্য বটে। হয়তো রেনুই আমাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছে।
১৬
সে রাতে আর বিশেষ কিছু হলো না। ঘটনা বলতে, রেনু আমাকে উড়িয়ে নিয়ে কাকডাকা ভোরে বাসায় নিয়ে এলো। এরপর নিজে কোনোমতে শাড়ি পেঁচিয়ে ছুট লাগাল ব্যান্ডেজ নিয়ে আসতে। সঙ্গে আবার পেইনকিলারও। আমি লক্ষী ছেলের মতো ব্যান্ডেজ লাগনোর চেষ্টা করলাম। ঠোঁটে ওসব ব্যান্ডেজ লাগানোর জো নেই। তুলো চেপে বসে রইলাম।
এরপর কদিন পেরিয়েছে জানি না। ঘড়ি পরাই বাদ দিয়েছি। ক্যালেন্ডার দেখার তো প্রশ্নই আসে না। মজার বিষয় হলো খাওয়া দাওয়া বা টাকা নিয়েও চিন্তা করতে হচ্ছে না। ব্যাংক ভর্তি টাকা। কার্ড ঢোকালেই সরসর করে বেরিয়ে আসে নোট।
রেনু আবার কোথায় যেন গেল। ড্রয়িং রুমের টেবিলে পড়ে থাকা নোটবইটায় চোখ পড়ল। নোটবইটা নিতে গিয়েই ধপ করে মনে পড়ল টেবিলটা থাকার কথা আমার বেডরুমে। আর সেই টেবিলে আমার এক গ্লাস পানি কিংবা একটা জগ থাকার কথা। যদিও বেডরুমের অবস্থান বদলে গেছে এবং আমার আর কিছুই মনে পড়ল না। কাজ না পেয়ে নোটবইটাই উল্টেপাল্টে দেখলাম।
হরেক মন্ত্র লেখা। বেশিরভাগই বশীকরণ টাইপ। মনের মানুষকে নিয়ে নানা কিসিমের মন্ত্র। বাণ মেরে মানুষসহ অশরীরি প্রেতাত্মা মেরে ফেলার মন্ত্রও আছে। শেষের দিকে হাতের লেখা বোঝা মুশকিল। এটা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট পরে হবে। এখন হারমোনিয়াম দিয়ে মন্ত্রসঙ্গীত গাওয়ার ইচ্ছে আমার এখন মোটেও নেই।
ভেবেছিলাম এসবের ব্যাখ্যায় ট্যাখ্যায় যাব না। নিজেকে বোঝানোর জন্য ভাবলাম, একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যাক। মন্ত্র পড়তে হবে একই তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বজায় রেখে। এতে শব্দের যে ওঠানামা হয় সেটার কারণে হয়তো স্পেস-টাইম কিংবা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বা ধরা যাক প্রাণীর মস্তিষ্ক থেকে নির্গত দুর্বল তরঙ্গটাও প্রভাবিত হয়। এতে কেউ মারা গেলেও যেতে পারে আবার উল্টোপাল্টা দৃশ্যও দেখতে পারে।
নাহ, যুৎসই হচ্ছে না। ভাবনা বাদ দিলাম। লোকে আমার এসব তত্ত্বকথা শুনলে ইগনোবেল নামের একটা বিদঘুটে পুরস্কার পেয়ে যেতে পারি। পিঠের যদি বাম পাশে চুলকায়, আর আপনি যদি একটা আয়নায় তাকিয়ে ডান পাশে চুলকাতে থাকেন, তবে চুলকানিটা চলে যেতে পারে। এ বুদ্ধি আবিষ্কারের জন্যে কাকে যেন একবার ইগনোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। আমার মনে হলো এই মন্ত্রফন্ত্রের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে আমিও ইগনোবেল পেয়ে যেতে পারি।
ইউরোপ আমেরিকায় অবশ্য মন্ত্র অচল। সেখানে চলে ভুডু চর্চা। পুতুল টুতুলের গায়ে খোঁচাখুঁচি করতে হয়। রীতিমতো অসুস্থ মানুষের কাজ কারবার।
নোটবই উল্টেপাল্টে আরেকটা মন্ত্রে চোখ আটকে গেল। নিউজের মতো মন্ত্রেরও হেডলাইন দেওয়া আছেÑ হরেক দুনিয়া, হরেক সময়। বিড়বিড় করে পড়তে লাগলাম ওটা। কেমন যেন একটা ছন্দ আর তারল্য আছে কথাগুলোয়। একটা শব্দ পড়লে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরেকটা শব্দ চলে আসছে মুখে। যেমন কদম শব্দটার সঙ্গে বর্ষা কিংবা ফুল, আবার কিংবা ধরুন কোনো এক পানশালার এক কোণে বিষণ্ন বসে থাকা মির্জা গালিব। কীসের সঙ্গে কী।
এমন সময় নোটবইয়ের পাতায় একটা অবয়ব। চমকে উঠলাম। ছায়াটা অচেনা! ঘুরে তাকাতেই এক রাশ অন্ধকার। চারদিকে ঘুটঘুটে নিকশ কালো অন্ধকার। আমি যেন অন্ধ হয়ে গেছি। নিজের হাত চোখের সামনে এনেও দেখতে পেলাম না। তবে অনুভব করতে পারছি সব।
কতক্ষণ কাটল টের পেলাম না। সময় জিনিসটা প্রথম থেকেই আমার সঙ্গে ফাজলামো শুরু করেছে। আলো ফুটলো কিনা বুঝলাম না। চারদিকে সাদা। একবার মনে হলো আমি সাদা একটা মহাকাশে ভাসছি। আবার মনে হলো আমি দিক শূন্য একটা স্থানে। যে দিকেই ফিরি না কেন, সেটাই আমার আগের দিক।
পদার্থবিজ্ঞানে ভয়াবহ কোনো প্যাঁচ লেগে গেছে। ভয় যে পাচ্ছি না তা নয়। চারদিকে সব সাদা আর সব অন্ধকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যতক্ষণ না সেখানে দ্বিতীয় কিছু থাকছে। তবে আলো থাকার সুবিধা হলো আমি আমার হাতটা অন্তত দেখতে পাচ্ছি। মরে টরে যাইনি তো?
‘তুমি সুস্থ আছো তুষার।’
‘আমার নাম..।’
‘আমার কাছে তোমার যে ডাইমেনশনাল তথ্য আছে… আচ্ছা, বাদ দাও। আমি কৃ। বলতে পারো.. কৃদের দলনেতাদের একজন।’
‘আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?’
‘কারণ আমি তোমার প্রসঙ্গ কাঠামোর বাইরে। তোমার স্পেস টাইমের সঙ্গে আমাদের মেলে না। এখন তোমার ভাষায় তোমাকে যতটা সম্ভব বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি।’
‘জ্বি আমি বুঝতে পারছি। বলুন।’
নিজেকে মনে হচ্ছে এক টুকরো কাগজে আঁকা একটা কার্টুনের মতো, যার সঙ্গে কথা বলছে স্বয়ং শিল্পী। উপমাটা ঠিকঠাক হলো কিনা জানি না। তবে স্বস্তি পেলাম।
‘যাকে তুমি কৃ বলে জেনেছো তার নাম..।’
যে শব্দটা কানে এলো সেটাকে ঠিক অক্ষর দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। আপাতত ওটা একটা ফ্রিকোয়েন্সির মতো মনে করি।
‘তুমি বেশ বুদ্ধিমান। আশা করি তুমি বুঝতে পারবে।’
‘আমার এত বোঝাবুঝির কাজ নেই। আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন। একটু পর রেনু এসে চিল্লাফাল্লা করবে।’
‘ও এখন আসবে না। ও কখন আসবে না আসবে সেটা নির্ভর করছে তোমার সময় কাঠামোর ওপর। তোমার হাতঘড়িতে তাকাও।’
আমি খুব একটা অবাক হলাম না। হাতঘড়ি থাকার কথা নয়। কিন্তু যেটা আছে সেটাও চলছে না। হয়তো ব্যাটারি নষ্ট। এতে কী যায় আসে! সময় তো যাচ্ছে। সময় মানে তো সেকেন্ডের টিক টিক না।
‘রেনু তোমাকে পছন্দ করেছে। এটা নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও অনেক কৃ এ অন্যায় করেছে। আমাদের জাতি..।’
‘অন্যায়?’
ভরাট কণ্ঠস্বরটা অন্যায় শব্দটার প্রতি একটু বেশিই জোর দিয়েছে। মেজাজ গেল বিগড়ে।
‘দেখো, রেনু তোমাকে পছন্দ করে। তাই কিছু করা হচ্ছে না তোমাকে। রেনু আমার ক্রিমানিব্রাসিয়া। এর মানে বুঝবে না।’
আমাকে বোঝাতে হলো না। আমি বুঝতে পারলাম, এটা এক ধরনের সম্পর্ক। একজন মানুষ একটা ছাগলকে ঘাস চেনাতে পারবে, কিন্তু মামাত ভাই বা চাচা শ্বশুর জিনিসটা কী সেটা চেনাতে পারবে না। বিষয়টা ওই রকমই। নিজেকে ছাগলের সঙ্গে তুলনা করায় নিজের প্রতিই রাগ হলো।
‘আমি আগেই বলেছি তুমি বুদ্ধিমান। তবে খুব ছেলেমানুষ। তুমি রেনুর মায়া ত্যাগ করো। তাকে আঘাত করো। তাকে ছেড়ে..।’
‘তার আগে হারামজাদা সামনে আয় একবার। মানুষ দেখেছিস, মানুষের ফাঁদ দেখিসনি।’
কোনো শব্দ শোনা গেল না। আমি পকেট হাতড়াতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম জিনিসটা। নোটবইয়ের একটা পাতা আগেই মার্ক করে রেখেছিলাম। আওড়ে যেতে লাগলাম মন্ত্রটা। সুস্থির একটা ফ্রিকোয়েন্সি বজায় রেখে। দুলে উঠতে শুরু করলো সব। আমি ঘুরতে লাগলাম বন বন করে। তারপর আবার হারিয়ে গেলাম অন্ধকারে। তারপর চোখ মেলে তাকালাম।
‘এক শ পাঁচ ছিল, এখন তিন। সাপোজিটরি দিতে হয়েছিল।’
আমার ইচ্ছে হলো রেনুকে মাঝারি জোরে একটা চুমু খেতে। কিন্তু ঠোঁট ফুলে ঢোল হয়ে আছে। চুমু খেতে পারলাম না। তার হাত শক্ত করে ধরে রাখলাম। তারপর খানিকটা উপহাসের কণ্ঠে বললাম, ‘তোমার ক্রিমানিবাস না অমনিবাস, কী যেন হন উনি। তার সঙ্গে একটু আগে দেখা হলো।’
কেঁপে উঠল রেনুর হাত।
‘কে হয় তোমার? বাবা টাইপ কিছু নাকি?’
‘হুমম। ওই রকমই বলতে পারো।’
‘আমাকে তো বেশ হুমকি ধামকি দিল। তোমাকে নাকি ছেড়ে দিতে হবে।’
রেনু নাক সিঁটকালো। একদম মানুষের মতোই। এসবের তোয়াক্কা করবে না ঠিক করেছে ও। বাহ, এমন প্রেমিকা কে হাতছাড়া করবে শুনি!
‘তবে আমার মনে একটা বড় ফাইট দিতে হবে। একটা ঝড় আসছে কী বলো। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তুমি কোথায় গিয়েছিলে।’
‘তুমি মাথা ঘুরে পড়ে গেলে। এরপর দেখি জ্বর। আমি গেছি থার্মোমিটার আনতে।’
‘এর মধ্যে এতকিছু ঘটে গেল।’
‘কিছু না। স্বপ্ন দেখেছো। স্বপ্নও তো দেখার জিনিস। মগজ দেখায়। প্রজেকশন টাইপ। স্বপ্নটাও একটা মহা জটিল ব্যাপার। পৃথিবীতে জটিল জিনিসের ছড়াছড়ি।’
‘মোটেও জটিল কিছু না। তুমি জটিল করে তুলছো। সহজ সরল জিনিসটা হলো আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
‘তুমি তো তোমার নীল ফুল পেয়েই গেছো। এখন কী হবে?’
রেনু হাসল। রহস্যময় হাসি না। ছেলেভোলানো টাইপ হাসি। আমাকে কী ভোলাতে চাইল সেটাই বুঝলাম না।
‘নাকি ফুল এখনো বহু দূর।’
‘নাহ, আসলেই বহু দূর। তোমার সঙ্গে হিজলের বনে ঘুঘুর ডাক শোনা হয়নি, ফাল্গুনের রাতে ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ দেখা হয়নি, সব হয়ে গেলে জীবনানন্দের মতো একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায় ঝরে যাব। আচ্ছা, কৃ দের কি সব শেষ হবে একদিন? মানুষের মতো।’
‘বক বক করো না। কিছুই শেষ হয় না। কিছুই শুরু হয় না।’
‘তুমি যে বললে আগে…।’
‘সব ভুলে যাও। মিথ্যে বলেছি।’
এবার আমি মেয়েভোলানো হাসি হাসলাম। মানে রেনুর কথা একবর্ণ বিশ্বাস করলাম না। এরপর আবার চোখে নেমে এলো রাজ্যের অন্ধকার। ঘুম নয়, ভয় নয়, এ এক অন্য আঁধার। মাথার ভেতর অসংখ্যা মানুষের কথা। সব বদলে যাচ্ছে। বদলে কোথায় যাচ্ছে তা জানি না। অনেকগুলো মানুষের কথা শুনতে পাচ্ছি। থেমে থেমে যাচ্ছে। আটকে যাচ্ছে। চিকুনগুনিয়া জ্বর হলে ভয়াবহ এ অনুভূতিটা হয়। আমার হয়েছিল। এবারও কি ওরকম কিছু?
কোনো ব্যথা পাচ্ছি না। আমার মনে হচ্ছে আমি একটু কিছু করেছি, সেটাই ঘটতে যাচ্ছে। বিড়বিড় করে সেই মন্ত্রটাই আবার পড়তে লাগলাম। কেন মন্ত্র পড়ছি আমি? আমি নিশ্চয়ই পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছি। মাথায় পানির ঠাণ্ডা স্রোত পড়তেই আবার সব ঠিক। চোখ মেলে তাকালাম। নাহ, কৃ এখনো দেখতে অবিকল লুনার মতোই। হাসছে। স্পষ্ট শুনলাম, জ্বর তো চলে গেছে। চলো একটু উড়িয়ে নিয়ে আসি তোমাকে।
১৭
ঘুম ভাঙলো ঘাসের খোঁচায়। রাতে আমাকে নিয়ে কোথাও আসার আগেই সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পকেটে ফোন বেজে উঠতেই দেখি রেশমার বাবা।
‘তুষার, হ্যালো তুষার! ঘটনা কী কওতো আমারে।’
ঘটান যে কী ও কত প্রকার উনাকে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। কৃর কে যেন একজন এসেছিল আমার কাছে। তিনি আমাকে অনেক কিছুই বোঝাতে পারেননি। অগত্যা ফোন কেটে দিলাম।
এদিক ওদিক তাকালাম। কৃ নেই। পরিচিত সেই কাশবন। তারমানে ঢাকার খুব দূরে যাইনি। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর মনে হলো একটা কিছু হয়েছে।
বাস পেলাম একটা। দৌড়ে উঠে পড়লাম। আপাতত বাসায় যেতে হবে। বাসা ছাড়া যাওয়ার আর জায়গাই বা কোথায়।
ঘুম পাচ্ছে খুব। এত ভোরে ওঠার অভ্যাস নেই। গাড়ির মৃদু কম্পনের সঙ্গে ঘুমের গভীর সম্পর্ক আছে। ঘুম ভাঙল আমার বাসার সামনের স্টপেজে। এরপর রিকশায় চড়ে এলাম বাসায়।
বেডরুমে এলাম। রেশমা নেই। কিন্তু তার ছাপ রয়ে গেছে এখনো। জিনিসপত্র রয়ে গেছে অনেকগুলো। তারমানে পুরোপুরি চলে যায়নি। আবার ফিরে আসতে পারে। জীবনানন্দের সেই শালিকের বেশে আসলেই ভালো। মানুষ হয়ে আসলে মহা ঝামেলা। ডিভোর্সের কথাবার্তা তুলতে হবে। তাকে সাংসারিক ঝামেলা থেকে একটা চিরস্থায়ী মুক্তি দেওয়া জরুরি হয়ে গেছে। যদিও তাকে আমি বেঁধে রাখিনি। কিন্তু ও হয়তো সেটাই ভাবছে।
কৃকে দেখলাম নাশতা বানাচ্ছে। আলু পরোটা নামের একটা সুস্বাদু বস্তু। সঙ্গে আরো কী কী যেন। টক দই দিয়ে সসের মতো একটা জিনিসও আছে। ওটা দিয়ে ভিজিয়ে খেতে হবে।
‘তোমার ঘটনাটা কী বলতো? এই সাত সকালে গিয়েছিলে কোথায়? তোমাকে তো জগিং করা পাবলিক বলে মনে হয় না।’
‘নিয়েই গেলে যখন, তখন উড়িয়ে নিয়ে আসতে। বাস জার্নিটা করতে হতো না।’
কৃ অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। যেন আমার কথা একবর্ণ বুঝতে পারছে না। তারপর আবার নাশতা বানানোয় মন দিল।
‘বাইরে গেলেই যখন তখন বাজার করে আনতে। ঘরে মাছ সবজি কিছু নেই।’
আমি শেষ কবে বাজার করেছি মনে পড়ে না। কৃর মুখেও কখনো এসব শুনিনি।
কলিং বেল বাজল। চমকে উঠলাম। তবে কৃকে বিচলিত হতে দেখলাম না।
কী-হোলে চোখ রাখতেই অপরিচিত একটা মুখ। যাক, বাঁচলাম। নিশ্চয়ই ভুল বাসায় এসেছে।
দরজা খুলতেই মেয়েটা আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে।
‘জ্বি বলুন।’
মেয়েটার চোখ আশ্চর্যরকম টলমল টাইপের। আমাকে আরো অবাক করে টপ করে দুফোঁটা পানি পড়েও গেল।
‘কে আপনি! কী হয়েছে আপনার? কোনো সমস্যা?’
‘তুমি আমাকে চিনতে পারছো না? সাত দিন না যেতে ভুলে গেছো? সাত বছরের সংসার আমাদের।’
নানা ধরনের প্রতারণার কথা শুনেছি। নিত্য নতুন আইডিয়া নিয়ে হাজির হয় প্রতারক দল। ঠাস করে দরজাটা লাগানোর আগেই মেয়েটা হুড়মুড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। প্রতারকের কান্নার মতো মনে হলো না। প্রতারণার কান্নায় এক ধরনের তাল লয় আছে। আসল কান্নায় থাকে না। এত নিখুঁত করে কান্নার দমক ওঠারও কথা নয় কোনো প্রতারকের। আমি সাবধানে মেয়েটাকে ছাড়ালাম।
‘আপনি বোধহয় ভুল করছেন। কী নাম আপনার?’
‘কী হয়েছে তোমার তুষার! আমি রেশমা! আমাকে চিনতে পারছো না!’
শব্দ শুনে এগিয়ে এলো কৃ। ঝামেলার ওপর সোয়া ঝামেলা। কৃকে দেখে কান্না থেমে গেল রেশমার। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ যাকে বলে। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার পরবর্তী কাজ কী হবে। কৃ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি রেশমাকে বলোনি আমাদের কথা?’
‘কাকে?’
‘ওকে.. রেশমাকে?’
‘কিন্তু এ..।’
মাথা চেপে বসে পড়লাম। গোটা মহাবিশ্ব গ্যালাক্সি ব্ল্যাকহোল সব কিছুকে মনে হচ্ছে একটা ময়দার দলা। রুটি বানানোর আগে যেমন ইস্টের গুড়ো মিশিয়ে দলাটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা হয় ওই রকম। এখন কেউ একজন সেই দলাটাকে ধরে মলতে শুরু করেছে। আর বেচারা আমি চাপ খেয়ে ভর্তা হচ্ছি। জটিলতর অবস্থা।
মানুষ হিসেবে নিজেকে ভীষণ ক্ষমতাবাণ ভাবার চেষ্টা করলাম। সব কিছু সহজে নিতে শিখতে হবে। দ্রুত সামলে নিলাম। কিছুই হয়নি এমন ভাব করে রেশমাকে ভেতরে আসতে বললাম। ও হতভম্বের মতো এখনো কৃর দিকে তাকিয়ে আছে।
‘তোমরা বিয়ে করেছো?’
‘ও.. ও হচ্ছে মালতি।’
আমার মাথায় আর কোনো নাম এলো না। কেউ কোনো মেয়ের নাম জানতে চাইলে কেন যেন মালতি নামটাই চলে আসে।
‘আমি মালতি না। আমি লুনা। আমরা বিয়ে করিনি এখনো। তবে করবো। আপাতত লিভ টুগেদার করছি। আপনি তো ওকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন। ডিভোর্সও হয়ে গেছে। আবার ফিরে এসেছেন কেন?’
কৃর কণ্ঠ কেমন স্বাভাবিক শোনাল। কিন্তু ও ওর নাম লুনা বলল কেন? তার মুখে কেমন যেন মানুষ মানুষ টাইপ কথাবার্তা। কৃ তো এমন ছিল না। রেশমা নাম বলা মেয়েটা চোখ মুছতে মুছতে হুট করে কঠোর হয়ে গেল।
‘আমার কিছু জিনিস আছে। সেগুলো নিতে এসেছি। এরপরই চলে যাব।’
আমার অবচেতন মন ভীষণ ব্যস্ত। পিক আওয়ারে কাজ শুরু করেছে যেন। ছুটে গেলাম ড্রয়ারে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করে দিলাম জিনিসটা। মাঝে একবার কৃ জানতে চাইল কী খুঁজছি, তাকে বললাম, বাড়ি ফেরার ঠিকানা। লাল রঙের একটা নোটবই। পারলে খুঁজে দাও।
‘তোমার কালো প্যান্টের পকেটে দেখো। কী সব হাবিজাবি লিখে রেখেছো। তোমার মাথা দেখানো দরকার। যাবে নাকি ডাক্তারের কাছে?’
নোটবইটা পেলাম অবশেষে। পাতা ওল্টাতেই আমার মাথার ভেতর যেন বোমা ফাটল। পুরো নোটবই জুড়ে আমারই হাতের লেখা। কোনো মন্ত্র ফন্ত্র নেই। সব কবিতা। কোথাও দুই লাইন শায়েরি, কোথাও তিন লাইনের জাপানি হাইকু স্টাইলের কবিতা, আবার কোথাও এক লাইন। একটা মন্ত্রও নেই! একেবারে শেষ পাতা পর্যন্ত ওল্টালাম। তাতে বেশ গুছিয়ে লিখেছি, ‘নিরিবিলি পুকুর, ঝ^পাং করে লাফ দিল ব্যাঙটা, আবার নিরব নিথর।’ মানে কী এসবের! গোটা মহাবিশ্ব আমার সঙ্গে ফাজলামো শুরু করেছে? নাকি মহাবিশ্বের চেয়েও বড় কিছু।
অন্তত গোটা দশেকবার চোখ বোলানো হলো নোটবইটায়। নতুন চেহারার রেশমা কিংবা কৃ কোন ফাঁকে লুনা হলো তা নিয়ে ভাবছি না। কারণ আমার নিজের সব কিছু মনে আছে। ওদের নেই। সবশেষ মন্ত্রটা আওড়ে গিয়েছিলাম আমি নিজেই। তারপর শুধু অন্ধকার আর স্বপ্নের মতো অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছিল। আমার মনে পড়েছে সেই প্রথম রাতের কথাও। কিন্তু অল্পের জন্য মনে হচ্ছে ভজগট পেকে গেছে। কৃ যদি মনে করতে না পারে সে কৃ, তবে আমার কৃকে আমি হারাবো। এটা মেনে নিতে পারছি না। মানুষ মানেই স্মৃতি। স্মৃতি ছাড়া মানুষ হয় না।
সময় বা বাস্তবতার তালগোল পাকাক ইচ্ছেমতো। কৃকে আমার চাই।
এমন সময় আবার কলিং বেল বাজল। ছুটে গেলাম। দরজা খুলতেই ফের স্থবির হয়ে গেলাম। এবার ভর করলো আরেক অশরীরি আতঙ্ক। দরজার ওপাশে স্বাস্থ্যবান হাসিখুশি লোকটা আর কেউ নয়, কালিপ্রসন্ন প্রামাণিক!
১৮
আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল, এবার দেখলেন তো ঘটনা। তারপর পকেট থেকে হুবহু আমারটার মতোই আরেকটা নোটবই বের করে বলল, আপনে যেটা খুঁজতেসেন সেটার আসল কপি এইখানে আছে। এবার সইরা খাড়ান। ডাকিনিরে বিদায় করি।
‘বিদায় করি মানে? কীসের ডাকিনি!’
‘মানে ওদের মরণ তো আর মানুষের মতো না। বহুত ঝামেলা। এমন ভাবে সরাইতে হবে, যাতে আর কারো জীবনে ব্যাঘাত ঘটাইতে না পারে। সরেন, ঢুকতে দেন। আমি আপনার মঙ্গলের জন্যই এসেছি।’
আমি সিন ক্রিয়েট করি না। এ শব্দটাকে রীতিমতো ভয় পাই। যাকে বলে স্যোশাল ফোবিয়া। এ টাইপের লোকজনের রাগ উঠলে কাঁপতে থাকে। আমারও তাই হতো। তবে কৃ আসার পর অনেক কিছু বদলে গেছে। আমার সাহস বেড়েছে অনেক। তাই আমি খপ করে কালিপ্রসন্নের শার্টের চেপে ধরলাম। এক ধাক্কায় সামনের দেয়ালে ছিটকে পড়ল। এত শক্তি আমার! অবাক হয়েছি খুব। সেকেন্ডের ব্যবধানে আবার ছুটে গিয়ে খপ করে ধরে ফেললাম ওর দুই পা। এসব আমাকে কেউ শিখিয়ে দেইনি। নিজে নিজে বের করেছি। আক্রমণের শিকার হওয়া লোকটার ব্রেইনটাকে অপ্রস্তুত করে দিতে। সে হয়তো আশা করছিল আমি ঘুষি বাগাবো। তা না করে পা ধরে দুপাশে ছড়িয়ে ধরবো, সেটা আশা করেনি। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মোক্ষম সেই লাথি। কালিপ্রসন্নের কী অতীতের সেই স্মৃতি মনে পড়ল? না পড়লে নেই। এক লাথিতেই কাজ হয়েছে। নাক চেপে বসে পড়েছে হারামজাদা মন্ত্রবাজ।
গোটা জগৎ যেখানে এলোমেলো হয়ে গেছে সেখানে পুলিশি ঝামেলা নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাচ্ছি না। এ কারণেই বোধহয় আলাদা একটা মানসিক শক্তি তৈরি হয়েছে। চাইনিজরা যাকে বলে ‘চি’ ক্ষমতা। ভারতে বলে প্রাণা। কালিপ্রসন্নের এসব ভালোই জানার কথা। তার প্রাণায়ামের আগে প্রাণবায়ু বের করে দিতে হবে। কিন্তু এ যাত্রা কাজটা সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। প্রামাণিককে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিতে চাইলাম। কীভাবে যেন ব্যালেন্স করে নিল ব্যাটা। মাধ্যাকর্ষণকে ফাঁকি দেওয়ার মন্ত্র জানে নাকি! অনেকটা উড়ে এসে আঘাত করলো আমাকে। সোজা চেপে ধরল গলা। ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো একটা অনুভূতি হলো।
‘তুই আমার দুলাভাই লাগস না যে তরে আমি বাঁচামু। তবে ওই পেত্নিটারে ছাড়ূম না।’
পেত্নি বিশেষণটা শুনে আমার হাসি পেলেও সেটা আটকে গেল। কারণ গলায় প্রামাণিকের কঠিন হাত।
ঠন করে একটা শব্দ হলো। লুটিয়ে পড়ল প্রামাণিক। বাড়িটা মেরেছে কৃ।
আমি গলা ডলতে ডলতে বললাম, ‘পেত্নি বলায় খেপে গেলে নাকি। আরো আগে আসলেই পারতে।’
প্রামাণিকের জ্ঞান কখন ফিরবে বোঝা যাচ্ছে না। তাকে খাটের হাত বেঁধে রাখা হয়েছে। নোটবইটা নিয়ে নিলাম।
‘ঘটনা কী বলতো? কে এই লোক। দেখেতো সাধু সন্ন্যাসী মনে হচ্ছে।’
‘ঘটনা সত্য। সে এসেছিল তোমাকে ভ্যানিশ করে দিতে।’
‘পাগলের মতো বকো না। আমি পুলিশে ফোন করছি। বড় মামাকে বললেই হবে।’
আমি চোখ কুঁচকে তাকালাম। ‘বড় মামা?’
এবার আমার কাছে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে চলেছে সব। নোটবইয়ের একটা মন্ত্র আমি পড়েছিলাম। তাতেই বদলে গেছে বাস্তবতা। নতুন এক রেশমা এসে হাজির যে এখনো আমার বেডরুম শুয়ে ফোঁপাচ্ছে। সম্ভবত একটু পর কাপড়চোপড় গোছাবে। এর মধ্যে বাস্তবতা আবার বদলে দিতে পারলে ভালো হতো। মেয়েটার জন্য মায়া লাগছে। আমার একটা ভার্সন হয়ত এ জগতে এভাবেই থাকবে। হয়তো আবার ওই আমি এই রেশমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসবে। চট করে বুদ্ধিটা এলো মাথায়।
‘রেশমা! রেশমা!’
ইচ্ছে করে চেঁচিয়ে ডাকলাম। ডাক শুনে তাড়াহুড়ো করে এলো। চোখের পানিতে কাজল লেপ্টে আছে।
‘শোনো, মন দিয়ে শোনো। আসলে তোমাকে সব বলা হয়নি। ও মালতি নয়। ওর আসল নাম তোমাকে বলা যাবে না। অফিসিয়াল সিক্রেট। আমি দুঃখিত। প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাকে কিছু বলবো না। এখন বলছি। তুমি এখুনি জামাকাপড় গুছিয়ে আবার তোমার বাবার কাছে চলে যাবে। গিয়ে বলবে, তুষার একটা বড় ঝামেলায় পড়েছে।’ আবার ভাবলাম কয়েক সেকেন্ড। ‘বলবে পুলিশি ঝামেলায় পড়েছে।’
‘তুমি সত্যি করে বলো কী হয়েছে। আর এই মেয়েটা…।’
‘না এই মেয়েটা আমার বউ না। আমার কলিগ। তার পরিচয় দেওয়া যাবে না। টপ সিক্রেট।’
কৃ কী মনে করে যেন ফোনটা হাত থেকে রেখে স্ট্যাচুর মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ। আমার প্ল্যানটা ধরতে পারার কথা নয় তার।
রেশমা চলে গেল দ্রুত। আমি তাকে কথা দিলাম যে ঝামেলা মিটলে আমি গিয়ে তাকে নিয়ে আসবো।
এবার কৃকে বোঝানোর পালা।
‘তোমার নাম লুনা? একেবারে সার্টিফিকেট নাম?’
‘আমার নাম লুনা! যার পেছন পেছন তুমি ঘুর ঘুর করতে! যার জন্য তুমি হাত কেটে নামটাম লিখতে। যাকে জ্বালাতে জ্বালাতে শেষপর্যন্ত তুমি পটিয়ে ফেলেছিলে। যার জন্য তুমি কেঁদে বুক…।’ আর বলতে পারলো না। তার আগেই ডুকরে কেঁদে উঠল কৃ। আমার কৃ। এখনকার মতো কান্নাটা উপেক্ষা করতেই হলো।
‘আচ্ছা। তুমি উড়তে জানো তো?’
‘অবশ্যই জানি। এখন উড়ে উড়ে আমি চলে যাব। রেশমা গেছে। আমিও যাব।’
‘তারমানে তুমি আসলেই জানো না?’
‘তুমি ভুলে যাচ্ছো সব তুষার। প্লিজ মনে করার চেষ্টা করো। তোমার কি আলঝেইমার্স বা শর্ট টার্ম মেমোরি লস…।’
‘ওসব কিছু না।’ কালিপ্রসন্নকে দেখিয়ে বললাম, ‘এই লোকটাকে চিনতে তুমি?’
‘না, জীবনেও দেখিনি।’ কান্না থামাল কৃ ওরফে লুনা। কঠিন মেয়ে ছিল লুনা। কান্নাকাটি তাকে মানাত না। এই লুনাকেও দেখে মনে হচ্ছে কান্নাকাটিতে অভ্যস্ত নয়। কোনো পার্থক্য দেখছি না।
‘তবে মনে হয় এ লোকটা আমাকে ফলো করতো। পাত্তা দিতাম না। আমি মামাকে ফোন করছি।’
‘না, না। দরকার নেই। আমি ওর ব্যবস্থা করছি।’
প্রামাণিকের নোটবইই এখন ভরসা। বাস্তবতা বদলাতে হবে আবার। কিভাবে কী বদলাবো জানি না। তবে একজন হয়তো জানতে পারে। তাকে ডেকে আনলে কেমন হয়। কী যেন নাম। রিরিসা!
কৃরও তো একই ক্ষমতা আছে। সে তো নিখুঁতভাবে হিসেব নিকেশ করে বদলে দিতো বাস্তবতা। আমার স্মৃতি আমারই থাকতো। সমস্যা হলো আমি এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে বড় ভুল করে ফেলেছি।
আচমকা মনে হলো প্রামাণিক আমাকে আবার পেঁচিয়ে ধরেছে। ওহ না, কৃ। আমাকে পেঁজা তুলোর মতো করে তুলে নিল। তারপর সোজা নিয়ে গেল বেডরুমে। আমি প্রামাণিকের দিকে তাকালাম।
‘ও থাকুক ওর মতো। সকালে পুলিশে দেব। বলবো চুরি করতে এসেছিল। ধোলাই দিয়ে আটকে রেখেছি।’
‘কিন্তু আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছো কোথায়?’
‘তুমি না বললে আমি উড়তে পারি কিনা। এখন দেখবে তোমাকে কিভাবে ওড়াই।’
কৃর রূপক অর্থে ওড়ানোর কথা শুনে আমার মাথায় শায়েরি চড়তে লাগল, ‘ওহে বোকা মদ। মাতাল হওয়ার আনন্দ তুমি কী করে বুঝবে!’
আমার নিজেকে মনে হচ্ছে সেই মদ। যা পান করতে চলেছে নতুন লুনা। কৃ নয়। লুনার প্রতি টানটা অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। তবে কৃর জন্য ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। আবার মনে হলো কৃ-ই নিজেকে লুনা ভাবছে। এ বাস্তবতা আগাগোড়া মিথ্যেয় ঢাকা। কিন্তু এ মিথ্যেটাও এক প্রকারের সত্যি।
আধ ঘণ্টা পর। আমার মনে হলো আমি সত্যিই উড়ছি। খুব হালকা লাগছে, সঙ্গে ক্লান্তিও। কৃ আমাকে তার বুকে চেপে ধরে শুয়ে থাকতে চেয়েছিল। দম আটকে আসছিল দেখে খানিকটা সাইড পেলাম। জড়িয়ে ধরে রাখলাম ওর পেলব শরীরটা। এই একই বিশেষণ দিয়েছিলাম সেন্ট মার্টিনে থাকতে। ওই স্মৃতি নিশ্চয়ই এখন এই লুনার নেই। হায় স্মৃতি! মানুষ এই স্মৃতির কাছে কত অসহায়! কবিতা নয়, কঠিন বিজ্ঞানসম্মত কথা।
লুকানে শক্ত করে চেপে বোঝার চেষ্টা করলাম, কোনো অনুভূতির কণার আদান-প্রদান ঘটে কিনা। কণা টের পেলাম না। পেলাম একগাদা উত্তাপ।
ড্রয়িং রুমের খুটখাট শব্দে সচকিত হই। ছুটে গেলাম। আশঙ্কা সত্য হলো। প্রামাণিক ব্যাটা ভেগেছে। ড্রয়ারে থাকা ওর মন্ত্র লেখা নোটবইটাও নিয়ে গেছে। তবে আমার কবিতাওয়ালা নোটবইটা মেঝেতে পড়ে আছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম।
১৯
কৃ ওরফে নতুন লুনার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাকে ঠিক দাম্পত্য বলা যায় কিনা জানি না। তবে একটা কিছু যে নেই সেটা আমি দিনের পর দিন বুঝতে পেরেছি। আমার একটা চেষ্টা ছিল যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার।
তবে একটা দিনও বাদ যায়নি যে আমি কালিপ্রসন্নকে খুঁজিনি। লোকটার একটা আনুমানিক স্কেচ এঁকে সন্ধান দিন টাইপের পোস্টারও ছেপেছিলাম। তাতেও কাজ হয়নি।
সম্ভবত এভাবে বছরখানেক কেটেছে। আমার কয়েকটা চুল পেকেছে। যার কারণে আমি বুঝতে পারলাম, এবার বুঝি সময়টা নিজস্ব গতিতে চলতে শুরু করেছে।
আমি আরেকটু হলে হয়তো এটাকেই আমার আসল বাস্তবতা বলে মেনে নিতে শুরু করতাম। কিন্তু যা ঘটল তাতে আমি একই সঙ্গে পুলকিত ও চিন্তিত হয়ে পড়লাম। রাতে অফিসে বসে বসে ম্যাগাজিনের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। ফোন এলো কৃর। সে আবার এর মধ্যে একটা স্কুলে চাকরিও জুটিয়েছে। ভীষণ ভয় পেয়েছে এমনভাবে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাসায় আসো। জলদি!
‘কী হয়েছে!’
‘একটা ঘটনা ঘটেছে।’
‘বাসায় চুরি হয়েছে?’
‘না। তুমি আসো। আসলে দেখবে। জলদি আসো।’
‘ফোনে বলো। টেনশনে বাসায় আসার আগেই দেখা যাবে হার্টফেল করে বসে আছি।’
কৃ আমাকে আরো বেশি টেনশনে ফেলার জন্যই বোধহয় লাইনটা কেটে দিল। আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এটা কৃর একটা চালাকি হতে পারে। কীসের চালাকি সেটাও আঁচ করতে পারছি। আমাকে মাঝে মাঝে তার এসব আহ্লাদ মেনে নিতে হয়। আগের কৃ হলে আমার কোনো সমস্যা ছিল না। পারলে উড়ে উড়ে চলে যেতাম। কিন্তু যতক্ষণ আমি আমার হারানো কৃ’কে ফেরত পাচ্ছি, ততক্ষণ স্বস্তি পাচ্ছি না আসলে।
একবার ভেবে দেখুন যে আপনার জীবনসঙ্গীর মস্তিষ্কটা কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের মতো ফরম্যাট হয়ে গেল। তার মাথায় ভরে দেওয়া হলো অন্য কোনো মেয়ের স্মৃতি। তারপর আবার নতুন করে তাকে আপনার সঙ্গে একটা সম্পর্কে যেতে হলো। আপনার সঙ্গী কি আগের মতো থাকবে? জটিল এ মুহূর্তগুলো আমি এতদিন কিভাবে পার করেছি জানি না। তবে বাসায় আসার পর মনে হলো একটা বিরাট সমাধান পেয়ে গেছি।
কয়েকবার কলিং বেল চাপার পর যখন কৃ দরজা খুলল না। তখন মনে পড়ল পকেটের এক্সট্রা চাবিটার কথা। দরজা খুলে ড্রয়িং রুমে ঢুকেই হা হয়ে গেলাম। কৃ ভাসছে। বেলুনের মতো শূন্যে ভাসছে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজের ব্যালেন্স ঠিক করার। নিচে নামতে গিয়ে আবার উঠে যাচ্ছে। আমি ছুটে গিয়ে খপ করে ধরে ফেললাম তাকে। তারপর ওকে চমকে দিয়ে দীর্ঘ চুম্বন। মনে পড়ে গেল হৈমন্তীর সেই লাইন। আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।
কিন্তু কৃকে ঠিক পাওয়া গেল না শেষ পর্যন্ত। কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না। তার ধারণা বাসা জিন-ভূত টাইপের একটা কিছু ঢুকেছিল। ওরাই তাকে ভাসিয়ে রেখেছিল। ভাগ্য ভালো যে ওই সময় তার হাতে ফোন ছিল। আমি কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না যে সে নিজেই জিন-ভূত টাইপের একটা কিছু।
কৃকে বললাম, মনটাকে স্থির করে ফোকাস করতে। তারপর ওড়ার কথা ভাবতে। কিন্তু কোনো টোটকা সিনেমাটিক পদ্ধতিতে কাজ হলো না। সে ফোকাস তো দূরের কথা উল্টো বলল, আমার মাথাটাই নাকি গেছে।
একবার ভাবলাম কৃকে ছাদ থেকে ফেলে দিলে কেমন হয়? শেষ মুহূর্তে নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে সে আবার উড়তে জানবে।
‘কী উল্টোপাল্টা ভাবছো তুমি! খবরদার আমাকে আর ওই নামে ডাকবে না!’
আমি এবার জোকারের মতো গাল চওড়া করে হাসলাম। কৃ আমার হাসির কারণ ধরতে পারল না।
‘কী হলো, এভাবে হাসছো কেন? তুমি আমাকে ছাদ থেকে সত্যিই ফেলে দেবে?’
‘তার আগে বলো তুমি আমার মনের কথা বুঝলে কী করে! আমি তো মুখে কিছু বলিনি।’
খানিক পর মাথা আঁকড়ে ধরলো কৃ। আমি আলগোছে তাকে বুকের কাছে টেনে নিলাম। একটু নাটুকে হলেও দৃশ্যটা মন্দ হলো না। কৃর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর ভাবছি, আমি তোমাকে জীবনেও ধাক্কা দেব না। তুমি না উড়লেও আমার ক্ষতি নাই। যেভাবে আছি সেভাবেই চলুক না সব।
মাথা তুলল কৃ।
‘আই অ্যাম স্যরি। আমি একটু তোমাকে.. ইয়ে মানে.. ভয় পেয়ে গেছিলাম। তুমি চাইলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে টেস্ট করতে পারো। আমি উড়তে পারি কিনা।’
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
‘চলো ছাদে যাই, তোমাকে ধাক্কা দেব।’
কৃর চোখ আবার বড়বড় হয়ে গেল। স্যরি বলে ভুল করে ফেলেছে এমন একটা ভাব।
‘ঠিকাছে চলো!’
আমি আর তাকে আমার মন পড়ার সুযোগ দিলাম না। হিজিবিজি ভাবতে লাগলাম।
ছাদে অর্ধেক চাঁদের আলো। কার্নিশের কাছে এসে দাঁড়ালাম দুজন। নিচে তাকিয়ে গলা শুকিয়ে গেল। যে প্ল্যানটা করে এসেছি সেটা বাদ দেব কিনা ভাবছি। আগের বাসাটা ছিল পাঁচ তলার। এখন এ জগতের বাসা দেখি বারো তেল তলা। নিচে পিঁপড়ের মতো মানুষ।
অন্ধকারে কেউ দেখবে না।
‘কই ধাক্কা দাও। আমি চোখ বন্ধ করছি। এক দুই তিন গুনবে, নাকি হুট করে ধাক্কা দেবে?’
আমি আবার কৃর দিকে তাকিয়ে জোকারের মতো হাসলাম। তারপর হুট করে খুলে দিলাম মনের দরজা। কৃ আমার দিকে চোখ বড় বড় তাকিয়ে আছে। ওর ‘না..’ বলে চিৎকার কানে আসার আগেই সেকেন্ডে নয় দশমিক আট মিটার ত্বরণে নিচে পড়তে লাগলাম আমি। চিৎ হয়ে পড়ছি। পা নিচে থাকলে বেঁচে থাকার একটা সম্ভাবনা আছে। তাতে আরো বড় ঝামেলা। চোখ বন্ধ করলাম। ঠিক দুই সেকেন্ডের মাথায় ঘটনাটা ঘটল। কড়া একটা ব্রেক টের পেলাম। তারপর উঠছি তো উঠছি।
‘থামো! আরেকটু উঠলে স্ট্রাটোস্ফিয়ার পার হয়ে যাবে। পরে দম আটকে মরবো! নামো জলদি।’
নেমে এলাম মাওয়া ঘাট থেকে মাইল খানেক দূরের একটা চরে। জায়গাটা আমি চিনি। অনেক আগে এসেছিলাম। সামনে পদ্মার বালিয়াড়ি। চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে পানি। কৃ আমাকে এখনো ছাড়েনি। আমি নিশ্চিত ছাড়ার পর কী ঘটবে। আমার ধারণা একটু বেশিই সত্য প্রমাণ হলো। আমাকে ছেড়েই প্রথম এলোপাতাড়ি চড় থাপ্পড়। তারপর কিল ঘুষি। তারপর চুমুর পর চুমু। কৃকে এখন আসলেই পেত্নির মতো দেখাচ্ছে। চুমুটা ঠিক উপভোগ করতে পারলাম না। তার শক্তিশালী চড়ে সম্ভবত কোনো একটা দাঁত নড়ে গেছে।
কপাল খারাপ। সে রাতে কৃ আর শত চেষ্টা করেও উড়তে পারলো না। আশপাশে উঁচু ছাদও নেই যে লাফ দেব। আর আমাকে বাঁচানোর তাগিদে কৃ ওড়া শিখে যাবে। যাই হোক লাফ দেওয়ার চিন্তা বাদ। রাতটা কাটিয়ে দিলাম খিদে নিয়েই। ধু ধু চর। কোথাও কেউ নেই।
বীরপুরুষের মতো কৃর দিকে তাকালাম, ‘ভয় করছে?’
‘না করার তো কারণ নেই। এখন ডাকাত ধরলে কী করবে!’
‘ডাকাতের হাত থেকে রামদা কেড়ে নিয়ে তার কল্লা ফেলে দেব।’
‘অ্যাঁ.. আসছে আমার… আচ্ছা.. এমনটা কি আগে.. না না দূর.. কী ভাবছি।’
অন্যমনষ্ক হলো কৃ। আপাতত এটাই দরকার ছিল।
এটাই সুবর্ণ সময়। আমি নিজেকে যতটা সম্ভব সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের মতো উপস্থাপন করে প্রথম থেকে সব বলে গেলাম কৃকে। তাকে কৃ বলেও ডেকেছি কয়েকবার। রাগ করলো না। তবে লুনা হিসেবে তার এতদিনকার স্মৃতি যে মিথ্যা, এটা সে মানতে একদমই রাজি না। আমারও মনে হলো এসব স্মৃতি মিথ্যে নয়। স্রেফ অন্য জগতের অন্য এক লুনার ভেতর ঢুকে পড়েছে কৃ। সম্ভবত এটাকেই বলে ‘ভর করা’। নিজের অদ্ভুত যুক্তিতে নিজেই হেসে ফেললাম।
রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি দুজন জানি না। ভোরের দিকে গায়ে জোয়ারের পানি লাগতেই উঠে পড়ি। একটা নৌকাও দেখি দোল খাচ্ছে। মাঝি নৌকার ভেতরে সকালের নাশতা বানাচ্ছে। তার সঙ্গে খাতির জমালাম। বললাম বিপদে পড়েছি। রুটি আর চা মিলল। নৌকায় দুলতে দুলতে এমন মজার নাশতা আর খেয়েছি কিনা মনে পড়ে না। কৃ কোন ফাঁকে আবার নদীতে গোসলও সেরেছে। শাড়ি ভেজা। ভেজা শড়িতে তাকে দেখাচ্ছে গ্রামের সেই রেনুর মতো।
উড়তে না পারলেও মানুষের মন পড়াটা কৃর জন্য এখন সহজ কাজ। উঠতে বসতে সবার মন পড়তে পড়তে যখন তার নিজের মনটাই বিষিয়ে উঠল তখন বাদ দিল। আর তখুনি ঝট করে আমার মাথায় আইডিয়াটা এলো। কালিপ্রসন্নকে ধরার একটা রাস্তা পাওয়া গেছে! জটিল কিন্তু নির্ঝঞ্ঝাট রাস্তা!
‘শোনো, ভালো করে মনে করার চেষ্টা করো ওর চেহারাটা।’
‘করলাম। ফর্সা করে চেহারা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বেঁটে করে। ভুড়িওয়ালা। আর বর্ণনা করত পারবো না! চেহারা আমার বেশ মনে আছে।’
এবার কৃকে নিয়ে গেলাম বাসার নিচের রাস্তায়। আমার বুদ্ধিতে সবার মাথার ভেতর একবার করে ঢুকছে ও। লোকটা পালিয়েছে রাতের বেলায়। রাস্তার লোকজনের খেয়াল করার কথা নয়। তবে সারাদিন খায়নি ও। আশপাশের রেস্তরাঁগুলোতেই গেলাম আগে। কৃকে বললাম, প্রামাণিকের চেহারায় ফোকাস করতে। লোকে অনেক কিছু ভাববে, সেসব অগ্রাহ্য করতে। রাস্তার লোকেদের মন পড়তে পড়তে ভীষণ ত্যক্ত বিরক্ত কৃ, সন্দেহ নেই। তবে একটা রেস্তরাঁর সামনে গিয়ে ইশারা করলো। এখানকার এক ওয়েটারের মগজে প্রামাণিকের স্মৃতিটা আছে। সে প্রামাণিককে একটা বাসে উঠতে দেখেছে। কৃ তার কপালের দুপাশে চেপে ধরলো। স্মৃতিটা আরো পরিষ্কার করতে চায়। পরে আমাকে সে জানাল, বাসের ড্রাইভারের চেহারাও দেখেছে সে। আমরাও ওই রুটের ওই ড্রাইভারকে খুঁজতে বের হলাম। ভাগ্যক্রমে পেয়েও গেলাম। লাস্ট ট্রিপ দিচ্ছিলেন তিনি। কথা না বলে উঠে পড়লাম। উত্তরা পর্যন্ত যেতে হবে কিনা জানি না। তবে কন্ডাক্টরের দিকে তাকিয়েই হাসল কৃ। আহা! মানুষ হিসেবে আমার যে এত বুদ্ধি এটা যদি কৃরা জানত!
কন্ডাক্টরের স্মৃতির কোনো এক জায়গায় প্রামাাণিক রয়ে গেছে, কারণ সে ভাড়া দেয়নি। তার সঙ্গে বাক বিতণ্ডা হয়েছিল। প্রামাণিক নেমে গিয়েছিল বনানীর দিকে। আমরাও নামলাম। পাশের দোকানদারদের স্মৃতিতে নেই। হালকা এক টুকরো স্মৃতি পাওয়া গেল মোড়ের এক ট্রাফিক পুলিশের মস্তিষ্কে। সেটার ওপর ভরসা করে রাস্তা পার হয়ে একদিকে হাঁটতে লাগলাম। আচমকা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল কৃ। আমি তাকে ধরে আইল্যান্ডে বসালাম।
‘ওই লোকটা, কী যেন নাম। একটা কিছু করছে। সে আশপাশেই আছে। নজর রাখছে। আমাদের ওপর।’
আমার মানবমস্তিষ্ক আবার তৎপর হয়ে উঠল। কৃকে ধরে দাঁড় করালাম। খানিকটা হাঁটলেই একটা বসার মতো জায়গা। এমন সময় তিন যুবক পথ আগলে দাঁড়াল। বুঝলাম ছিনতাইকারী। কিন্তু কে তাদের এত রাতে বোঝাবে যে…। আমার কিছু বলার আগেই কৃ তিনজনের দিকে তাকাল। ‘আশফাক, তুমি কি চাও আমি তোমার শিরিন আপাকে সব বলে দেই। কাল থেকে যদি প্রমিজ করো এসব বাদ দেবে, তা হলে আমি কাউকে কিছু বলবো না। আর হ্যাঁ, রিয়াজ তুমি যে আমাদের খুন করার প্ল্যান করছো সেটাও বাদ দাও।,এখানে পাঁচটা সিসিটিভি ক্যামেরা আমাদের দিকে তাক করা। ভালো চাও তো কেটে পড়ো।’
যাক আপদ বিদেয় হতেই ভাবনায় মন দিলাম। প্রামাণিক বনানীর মতো অভিজাত জায়গায় থাকতেই পারে। ওর ক্ষমতা অনেক। টাকাপয়সা বানানো দুই মিনিটের কাজ।
আমি কোথায় যাচ্ছি জানি না। কৃ আমাকে পথ দেখাচ্ছে। নাকি আমরা যেতে প্রামাণিকের কোনো ফাঁদে পা দিতে চলেছি। সেটাও হতে পারে। কৃকে বেশ দুর্বল মনে হচ্ছে। ওই হারামজাদা নিশ্চয়ই আবার মন্ত্রটন্ত্র পড়তে শুরু করেছে।
‘কৃ, চলো আমরা ফিরে যাই।’
‘নাহ.. তোমার বাস্তবতা তোমাকে..।’
‘জাহান্নামে যাক বাস্তবতা। আমার এখন তোমাকে নিয়ে রিকশায় ঘুরতে ইচ্ছে করছে।’
‘মিথ্যে বলো না, তোমার এখন প্রামাণিকের কাছ থেকে নোটবইটা নেওয়ার ফন্দি ঘুরছে মাথায়। তবে তোমার মাথায় একটা কিছু পেয়েছি আমি। তোমার অবচেতন মনে।
‘বলো কী! কী পেয়েছো।’
‘তোমার নিজের নোটবইটা।’
‘ওতে তো হাবিজাবি সব কবিতা লিখেছি। আমি নিজেও জানি না কখন লিখেছি।’
‘কোনো একটা বাস্তবতায় ওটা তুমি লিখেছিলে। তুমি যখন নোটবইটা হারাতে যাচ্ছিলে। তার আগে তুমি কবিতার কোড আকারে লিখেছো। সম্ভবত কোনো একটা বাস্তবতায় আমরা অনেক বছর বেঁচেছিলাম, সেখানে তুমি বসে বসে মন্ত্রের পাঠোদ্ধার করে সেটাকে কবিতার মতো সাজিয়েছো।’
কৃর এসব জানার কথা না। আমার মাথাতেই কোথাও না কোথাও এসব ইনফরমেশন সে পাচ্ছে। এখন দরকার সাইফারের কোড। মানে অনেকগুলো তালার একটা চাবি। সেটা কি বের করতে পারবে কৃ?
একটা অ্যাপার্টমেন্ট। নিচে গেট খোলা। দারওয়ান নেই। সেটাতেই আমাকে নিয়ে অনেক জোর করে ঢুকে পড়ল কৃ। মনে হলো তার নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই। যথারীতি লিফটে উঠে চেপে দিল টপ ফ্লোরের সুইচ। আমরা গিয়ে উঠলাম ছাদে। ছাদের এক প্রান্তে আমাদের দিকে পেছন ফিরে আরামে দাঁড়াও স্টাইলে দাঁড়িয়ে আছে প্রামাণিক। তার হাতে সেই খঞ্জর। বাঁকানো ছোরা। যেটা দিয়ে সে রেনুকে মারতে চেয়েছিল!
আগের মতো হাসিমুখের বালাই নেই। চোখজোড়া যেন সাদা পাথর। কৃর দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন। এগিয়ে আসতে শুরু করেছে কালিপ্রসন্ন। বিপদের সময় সবার আগে কাজ হলো বড় করে শ্বাস নেওয়া। মাথায় যতটা সম্ভব অক্সিজেন পাঠাতে হবে। মানুষের মগজের শিরায় শিরায় বুদ্ধি। বেশিরভাগই কুবুদ্ধি। যেগুলো আমাদের মাঝে মাঝে মহাবিপদ থেকে বাঁচায়।
কৃ নড়ছে না। সম্মোহীতের মতো তাকিয়ে আছে তান্ত্রিকের দিকে। আমি আলতো করে আমার ব্যাকপকেটে হাত রাখলাম। মানিব্যাগের আড়ালেই ছিল নোটবইটা। বের করে আনলাম দ্রুত। মনে মনে কৃকে সঙ্কেত দিলাম, আমার মাথার আনাচে কানাচে ঢুকে বের করে আনতে বললাম, ঠিক কোন চাবিটা আমি লুকিয়ে রেখেছি আমার লাইনগুলোতে। কৃও আমার ভেতর ঢুকে ফিসফিস করে একটা নাম বলল, ‘কবিতা!’
নোটবই ওল্টালাম। লাইনগুলো আগে কেন পরিচিত লাগছিল পরিষ্কার হলো। এসবই যে আমার কবিতার লাইন তা নয়। অনেকগুলো জীবনানন্দের। চট করে ধরে ফেললাম মন্ত্ররহস্যের বিষয়টা। যখনই কেউ কবিতা বুঝতে যাবে, তার মগজ থেকে একটা সিনক্রোনাইজড তরঙ্গ বের হবে। আমি জানি না। হতে পারে সেটাই আমাদের সঙ্গে অন্য কোনো জগতের এক অদ্ভুত সেতু খুলে দেয়। তাল লয় সুর ঠিক রাখা চাই!
আমার আর কৃর মনে মনে কথা চলছে খুব দ্রুত। প্রামাণিক আর পাঁচ হাত দূরে হবে। তার এগিয়ে আসার ধরনটা স্লো মোশন টাইপ। হাতে সময় আছে কিছুটা।
কৃ দাঁড়াতেই পারছে না। আমার কাঁধে মাথা রেখেছে হাঁপাচ্ছে। এতদিন সে আমাকে হাজারটা বিপদ থেকে বাঁচিয়ে এসেছে। আজ আমাকে একটা কিছু করতেই হবে। অদ্ভুত কিছু। প্রামাণিক ব্যাটাকে কবজায় আনতে হবে।
‘পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দুজনার মনে;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে, আকাশে আকাশে।’
ভুল হলো না। নোটবইয়ের এমন এক পাতায় লেখা কবিতাটা, যার ওপর ছোট্ট করে প্রামাণিকের নামটা লেখা।
থেমে গেল তান্ত্রিক। আমার দিকে ফিরল। আহত চোখে তাকাল। হাত থেকে খসে পড়ল খঞ্জর। তারপর বিড়বিড় করে পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। ওরা চায় না কৃকে বাঁচিয়ে রাখি।’
‘ওদের গিয়ে বল, পৃথিবীর একজন কবি আমার আলসার বানিয়ে দিয়েছে।’
লুটিয়ে পড়ল প্রামাণিক। এই সুযোগ। ছুটে গিয়ে আলগোছে তুলে নিলাম ওকে। পেছনে কৃ একটা কিছু বলতে চাইল। কে শোনে কার কথা। সোজা দশ তলা থেকে ছুড়ে ফেলে দিলাম ময়লার বস্তার মতো। গভীর রাত। নিচে রাস্তায় কারো গায়ে পড়ার চান্স নেই ভেবে নিশ্চিন্ত হলাম। ফিরে এলাম কৃর কাছে। আগের চেয়ে সুস্থ দেখাচ্ছে তাকে। বরং বলা চলে একেবারে সুস্থ।
‘একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না?’
‘আরে নাহ, হারামজাদা একটা বিড়াল। আবার ফিরে আসবে। বিড়ালরা সহজে মরে না। তবে আর কেয়ার করি না। আসুক!’
ধড়াম করে আমাকে জড়িয়ে ধরল কৃ। ধড়াম করে বললাম কারণ জড়িয়ে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ব্যালেন্স হারিয়ে ছাদে পড়ে গেলাম। আকাশ ভর্তি তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মনে হলো কোনো এক গ্রহ থেকে এলিয়েনরা আমাদের কাণ্ড দেখছে এখন। বড় লজ্জার কথা। অবশ্য আসল এলিয়েন তো আমার গায়ের ওপরই। আমি সবুজ ঘাসের দেশে দারুচিনি দ্বীপের ভেতরটা দেখার মতো অন্ধকারে দেখছি কৃর শরীর। আগে কখনো এতটা মায়াবী মনে হয়নি তাকে। আস্তে আস্তে উপরে উঠতে শুরু করলাম আমরা। ছাদ ছাড়িয়ে আরো উঁচুতে। নিচের স্ট্রিট ল্যাম্পগুলোর আলো মলিন হতে লাগল। এখন শুধু আমাদের মুখোমুখি থাকার অন্ধকারটুকু থাকলেই হয়।
‘বনলতা সেন?’
‘চিনি না। কে সে?’
‘আমি কে তোমার?’
‘তুমি আমার নীল ফুল। আমার এক সমুদ্র নীল ফুল।’
‘আর তুমি আমার অন্ধকার। অন্ধকার রজনী।’
২০
আমি জানতাম সময়টা আসবে। সময়কে এর মাঝে কত কিছুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আমার হাতের হাতঘড়িও বদলেছে অনেকবার। তবু সময়টা কী করে যেন ফসকে গেল।
‘কতদিন উড়ি না আমরা।’
‘এখন উড়তে গেলে তোমার হাড় ভেঙে ফেলতে পারি। এই বয়সে হিপ বোন ভাঙলে বুঝবে কী যন্ত্রণা।’
‘হুমম। তোমার আসল বয়সটা জানা হলো না।’
‘এত শখ কেন, শুনি!’
‘আমি তো বুড়ো হয়ে গেলাম।’
‘আমি হইনি? গোটা এক জীবন কাটিয়ে দিলাম তোমার সঙ্গে। সিনেমা হলে গিয়ে বলিউডের সিনেমাও দেখলাম। বাকি রাখিনি কোনো নদী। বিচিত্র সব খায়েশ আধবুড়োদের।’
‘তারপরও শেষ বলে কিছু নেই।’
‘ইশশ.. এই সত্তরেও শখ মেটেনি?’
‘কে বলবে তুমি কৃ। মানুষ হয়ে গেছো একদম!’
‘বয়সের কথা বললেই মানুষ?’
‘তুমি কি তোমার সেই নীল ফুলের খুব কাছে?’
বিষন্ন হয়ে গেল কৃ। আমি তার ভাঁজ পড়া হাত ধরলাম। আমারও হাতও শুকিয়ে কাঠ। তবু মাঝে মাঝে এখন ইলেকট্রোম্যাগনেটিক আবেশের আদান-প্রদান ঘটে আমাদের মাঝে।
‘চিন্তুা করো না। তোমাকে তোমার নতুন বাস্তবতার সঙ্গে একটা উপহারও দিয়ে যাব।’
‘আমি তোমার সঙ্গে…।’
‘সেটা তো সম্ভব না মশাই। আমার আর আপনার জীবন এক নয়, মৃত্যুও এক নয়। আমি আমার সব রেখে যাব তোমার জন্য।’
‘আমার আসল বাস্তবতা? যেটাতে আমি যেতে চাই না?’
‘তোমাকে ঘাড় ধরে পাঠানো হবে।’
‘কৃ! প্লিজ!’
কৃ আমার কথার পাত্তাই দিল না। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এ নিয়ে আমাদের অনেকবার কথা হয়েছে, আলাপ হয়েছে, যুক্তিতর্ক, ঝগড়া কত কী। এর মাঝে সেই রিরিসা এসেছিল আরেকবার। পাঁচ ছয় বছর পর পর এসে কী যেন বলে যেত কৃকে। কৃ পাত্তাই দিত না। ততদিনে জীবনানন্দ মুখস্থ করে ফেলেছিল ও। রিরিসাকে একটুও ভয় পেত না। রিরিসার চোখে আমি এক ধরনের ব্যথা দেখতাম। মানুষের মতো নয়। মানুষের মনের ব্যথায় রাগ থাকে না, থাকে লুকানো প্রেম।
কৃ আমাকে সেভাবে কিছু বুঝিয়ে বলতো না। আমিও তেমন বুঝতে চাইতাম না। আমাদের জীবন চলছে ঠিক আগের মতোই।
হাসপাতালের শেষ দিনগুলোতে কৃ আমার পাশে বসে থাকত। সারাক্ষণ বক বক করতো। শেষের দিকে সেও ভুলে যেতে শুরু করলো অনেক কিছু। মানুষের দেহে থাকতে হচ্ছে বলে মানুষের পরিণতিটাই তার হচ্ছিল।
আমি ভয়াবহ সব ভাবনা খুব সহজে ভাবতে লাগলাম। কৃ কি মারা যাবে? কৃ মারা গেলে কী হবে? আমার কী হবে? কৃ আমাকে সবকিছু দিয়ে যাওয়ার কথা বলতো। সেই সব কিছু কী? প্রেম তো সে যা দেওয়ার দিয়েছেই। এক জীবনে এমন নিখুঁত ভালোবাসা আর কোথায় পাবো?
আমার শ্বাস নেওয়াই দায় হয়ে গিয়েছিল শেষের দিকে। ওই সময় আবার সেই পুরনো কৃকে ফিরে পেলাম। আমার হাত ধরে হাউ মাউ করে কান্না। নার্সরা ভয় পেয়ে ছুটে আসতো। জলদি করে চেক করতো আমার হার্টবিট আছে কিনা। আমি তাদের দিকে সলজ্জ চোখে হাসতাম। বেঁচে থাকার জন্য খানিকটা লজ্জিত বোধ করতাম।
কৃকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো কৌশলই খাটত না। তার দিকে তাকাতে পারতাম না। সে তার নীল ফুল ছুঁয়ে ফেলার খুব কাছে চলে এসেছে। সমস্যা হলো নীল ফুলটা মরবে নাকি কৃ হারিয়ে যাবে সেটা পরিষ্কার না।
তারপর একদিন সেই মুহূর্তটা চলে এলো। আমি বুঝতে পেরেছি ডাক্তারদের মুখের দিকে তাকিয়ে। কৃ পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখা হতো তাকে। তার কষ্ট দেখে আবার বাঁচার হাহাকার যে আমায় জেঁকে ধরতো না, তা নয়। কিন্তু আজীবন বেঁচে থাকাটা বোধহয় আমাদের এই প্রেমের পরিণতি হতে পারে না। এ এক সূক্ষ্ম প্যারাডক্স।
সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। আমি আসলে জানি না চাঁদটা কত বড় ছিল। তবে হাসপাতালের জানালা দিয়ে আলো আসছিল যথেষ্ট।
কৃ আমার কাছে এসে দাঁড়াল। ঠিক যেমনটা তাকে প্রথম দেখেছিলাম। অবিকল লুনার মতো। বয়সটাও ঝপ করে নেমে এসেছে পঁচিশ-ছাব্বিশের ঘরে। এরপর তার হাত ধরে আমার বলার সময় হলো, ‘তোমার মুখ যেন আমাকে নিয়ে জীবনের অনেক সহজ সৌন্দর্যের ওপর হাত রাখে।’
‘এই এক জীবনানন্দ তোমার মাথা খেয়েছে।’
কৃ আমার কপালে হাত ছোঁয়াল। আজ কি সেই বিশেষ ক্ষণ? মানে আজ সে আমাকে একটা কিছু দিয়ে যাচ্ছে? কৃর চোখে মুখে নেই কষ্টের ছাপ। নাকি এটাও তার প্ল্যান করা। আমাকে হাসিমুখে বিদায় দেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র। অনেক আগের সেই অনুভূতির কণা টের পাচ্ছি আবার। লাল নীল কণাগুলো আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে ক্রমশ। কানে ঘোলাটে হয়ে প্রতিধ্বণিত হচ্ছে নার্স ডাক্তারদের কথাবার্তা। এরপর একরাশ আলোকিত অন্ধকার যেন আমাকে গ্রাস করে নিল।
২১
চোখ মেলতেই মনে হলো, মাঝে মাঝে এভাবে চোখ মেলেই ঘুমিয়ে থাকা যায়। শর্ত হলো, পাশে কোমল মায়াবি এমন একটা মুখ থাকতে হবে। ঘূর্ণিজলের মতো চোখ মেলে যে কিনা এখন তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি তার গাল স্পর্শ করলাম। সে চোখ বন্ধ করলো না। সেও আমার গাল স্পর্শ করলো। আমি তার চিবুক ধরলাম। সেও। এ এক মজার খেলা বটে।
‘খবরদার, যদি উল্টোপাল্টা..।’
‘আমার কী দোষ। শুরু করেছো তুমি!’
‘ঘুমের মধ্যে কার নাম বিড় বিড় করছিলে শুনি? প্রথম প্রেমিকা?’
‘প্রথম প্রেমিকা মানেই স্পেশাল কিছু এটা কে বলল? তুমিও আমার প্রথম প্রেমিকা। প্রতিটা প্রেমই প্রথম প্রেম।’
‘এটা বাস্তবতা না, বুঝলে সোনা?’
এবার তার ঘাড়ে হাত রাখলাম। বাস্তবতা শব্দটার সঙ্গে যেন বুকের কোণে একটা হাহাকার বেজে উঠলো। সেই হাহাকারটা আবার অন্ধকার নদীর ওপাশে একটা পাখির মতো হারিয়ে গেল। আমি গভীরভাবে তাকিয়ে আছি রেশমার চোখে। তার চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। কেমন যেন একটা প্রবল প্রেম আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আজ সাহস করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। রেশমাও মজা পেয়ে গেল। আরো কাছে নিয়ে এলো মাথা। চোখাচোখি শব্দটা বেশ কঠিন। তাই আমরা এর নাম দিয়েছি চোখচুম্বন।
এরপর রেশমা আমায় শক্ত করে আঁকড়ে খুব কাছ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমার চোখ ফেরানোর জো নেই। তাকিয়ে থাকতেই হবে।
আলতো করে রেশমার পেটে হাত রাখলাম। এটা আমার ইদানীংকার রুটিন। তার গর্ভে আমাদের সন্তান। ইদানীং হাত-পাত ছোড়াছুড়ি শুরু করেছে। ছেলে হলে কী নাম রাখব জানি না, মেয়ে হলে রাখব রেনু। নামটা কেন যেন মাথায় ঢুকে গেছে। যেন এই নামটা মাথার কোনো এক কোণে বেঁচে আছে। একটা নাম হয়ে।