Site icon গল্প

আলীকদম জিপ সার্ভিস

মুহাম্মদ এলমুল বাহার : লম্বা পাহাড়ের পাশঘেঁষা বিলের মাঝে ৪টা সেমিপাকা ঘর। এই ৪টা ঘর নিয়েই এই বাড়িটা। বাড়ির পাশঘেঁষে সরু আইলের মতো একটা রাস্তা চলে গেছে।

আইলের একপাশে জমিতে কলমি শাকের চাষ হয়েছে, অন্যপাশে ধান। সেই রাস্তা দিয়ে একটু হাঁটলেই আলীকদম পানবাজার। রাস্তার সাথে লাগানো ঘরটাতে চোখে চশমা দেওয়া, মুখভর্তি দাঁড়িওয়ালা হ্যাংলা করে যে ছেলেটা আছে তার নাম জাবির আর লম্বা করে গোলগাল চেহেরার মেয়েটা জোহরা। ওরা স্বামী-স্ত্রী, বিয়ে করেছে কয়েকমাস হলো।

বছর দেড়েক প্রেম করে বিয়ে করে পালিয়ে এসেছে। শহরের বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে প্রেমনদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই পাহাড়ের কিনারায় এসে তরী ভিড়িয়েছে দু’জনে।

তাদের ভালোবাসা দুই পরিবারের কোনো পরিবারই মেনে নেয়নি। মেনে নেবেই বা কেন? যে সমাজে কিনা প্রেম করা অন্যায় সেখানে তারা শুধু প্রেম করেই ক্ষান্ত হয়নি, নিজেদের ধর্ম ছেড়ে দুইজনেই চলে এসেছে ইসলাম ধর্মে। জাবিরের জন্মগত নাম জয়দ্বীপ, হিন্দু।

জোহরার জন্মগত নাম প্রমি বড়ুয়া, বৌদ্ধ। অতএব এই বিয়ে মেনে নিতে কোনো পরিবারই রাজি নয়। সে কারণে পালিয়ে এসে তারা এই পাহাড়ের ভেতরেই বসতি গড়েছে।  ওদের পাশেই যে ঘরটার জানালা সবসময় বন্ধ থাকে সেটাতে আমি থাকি। আমার নাম বেকার সেলিম।

অবশ্য এখন আমি আর বেকার নেই। একটা এনজিওতে চাকরি হয়েছে আমার, মাসে তের হাজার তিনশ টাকা বেতন। দীর্ঘদিন বেকার ছিলাম বলে গ্রামের সবাই আমাকে বেকার সেলিম নামেই চিনে।

আমার পুরো নাম সেলিম মাহমুদ, বাবার নাম রাগিব মাহমুদ, দাদার নাম আদিল মাহমুদ।আমার নাম, বাবার নাম, এমনকি চৌদ্দ গুষ্টির নাম বললেও কেউ চিনবে না। কেননা এলাকায় আমাকে একটা নামেই সবাই চিনে, সেটা হলো বেকার সেলিম। আর আমার বাবাকে বলে বেকার সেলিমের বাবা।

আমাদের বাড়ির নাম আমি নিজেও ভুলে গেছি। এখন আমাদের বাড়ির নাম বেকার সেলিমের বাড়ি। বত্রিশ বছর বয়সে এসে নামের সামনে থেকে বেকার শব্দটা কাটার সৌভাগ্য হলেও গ্রামের মানুষের মুখে বেকার সেলিম নামটা রয়ে গেছে।

আমার পাশের ঘরটাতে থাকে কোরবান আলী ও তার পরিবার। কোরবানের ঈদের দিন জন্ম হয়েছে বলে উনার নাম রাখা হয়েছিল কোরবান আলী। উনার বউকে সবাই বাতাসী আপু ডাকে, কিন্তু কেন ডাকে কেউ জানে না। উনাদের ঘরটা ছোটখাটো একটা বাচ্চাদের গুদাম। ঘরে কয়টা ছেলেমেয়ে আছে সেটা মাঝেমাঝে কোরবান আলী নিজেই ভুলে যায়।

ন্যাংটা বাচ্চা থেকে শুরু করে বিবাহযোগ্য মেয়ে পর্যন্ত সবধরণের ছেলেমেয়ে উনাদের আছে। এটাকে উনারা সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ বলে মনে করেন। আমাদের সকাল শুরু হয় বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে, দিন শেষ হয় তাও বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজে। কখন উনাদের কোন বাচ্চাটা কান্না করে সেটা বুঝাও মুশকিল।

আমরা কাকডাকা ভোরের পরিবর্তে বাচ্চাডাকা ভোর দেখি। উনাদের পাশের বাসায় থাকে শাওন। সেও একটা এনজিওতে চাকরি করে। দীর্ঘদিন ধরে বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছে ওর পরিবার। কিন্তু সবদিক দিয়ে মিলছে না। আর এদিকে বয়সও বেড়েই চলেছে।

তাই তাকে কেউ বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে মনেমনে খুব রাগ করে। এই পৃথিবীর মানুষগুলো এমন যে, যাকে যেটা জিজ্ঞেস করা উচিৎ না তাকে সেটাই জিজ্ঞেস করবে সবাই। কে, কখন বিয়ে করবে তাতে কার, কী যায় আসে? তারপরেও কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে কিছু মানুষ বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকবে এসব। বলবে, পাশের বাড়ির অমুখের বাচ্চা স্কুলে পড়ছে, অথচ তুমি এখনো বিয়ে করলে না। তারা কেন বুঝতে চায় না যে, এই পৃথিবীটা নিজের মনের মতো করে চলে না, মনকে পৃথিবীর মতো করে নিতে হয়। আমরা যখন যা চাই, তাই যদি পেয়ে যাই তবে এই বিশাল পৃথিবীতে রঙ বলে কিছুই যে থাকবে না।

অথচ সৃষ্টিকর্তা চায় যে, এই পৃথিবী রঙিন থাকুক, সুখ থাকুক, দুঃখ থাকুক। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কারো কিছু করার কী সুযোগ আছে? মানুষ এই সহজ সত্যগুলো কেন যে বুঝতে চায় না। অন্যকে কাঁদিয়ে এই ধরণীর মানুষেরা এক ধরণের স্বর্গীয় সুখ অনুভব করে। তাই মানুষ চায়, তার পাশেরজন সবসময় কান্না করুক।

আমার বাসা থেকে ৪৫ ডিগ্রি কোণে উত্তরদিকে কয়েকশত মিটার দূরে যে পেয়ারা গাছটার উপর চড়ুই বসে আছে, সেই গাছের সাথে লাগানো পাকা ঘরটায় হাবিবরা থাকে। আচ্ছা চড়ুই পাখিদের কী মানুষের মতো সুখ-দুঃখ থাকে? তারাও কী মানুষের মতো হাসে, কাঁদে? মাঝেমাঝে ইচ্ছা করে চড়ুই হয়ে এ ডাল থেকে ঐ ডালে উড়ে বেড়াই।

তখন অন্তত উড়ে বেড়ানোর জন্য স্বাধীন একটা আকাশ পেতাম, যে ডালে ইচ্ছা সে ডালে বসতে পারতাম। উড়ে যেতাম এ পাড়া থেকে ঐ পাড়ায়, এ আকাশ থেকে অন্য আকাশে।

মাটির জায়গাগুলো মানুষেরা ভাগাভাগি করে নিজেদের নামে করে নিয়েছে। মানুষেরা এমনভাবে জায়গা ভাগ করে নিয়েছে যে এক টুকরো জায়গাও হয়তো আর সৃষ্টিকর্তার নামে নেই। তারচেয়ে আকাশ ভালো। আকাশটুকু এখনো ভাগ বাটোয়ারা হয়নি সেভাবে।

চড়ুই হতে পারলে এই পুরো আকাশে উড়ে বেড়ানোর সময় কেউ বলতে পারতো না যে এই আকাশটুকু আমার, এদিকে তুমি এসো না। চড়ুইটা কয়েকবার কিচিরমিচির করে উড়ে গেল।

সে তাদের ভাষায় কী বললো জানি না। আজকাল মানুষের ভাষা ঠিকঠাক বুঝতে পারি না, সেখানে চড়ুইপাখির ভাষা বুঝার সাধ্য কী আমার আছে? আমাদের এই চারটা বাসার মালিক হাবিব। ওর বাবার কেনা জমি ভরাট করে এই চারটা সেমিপাকা ঘর তৈরি করা হয়েছে। হাবিবের বাবার নাম লিয়াকত আলী। তিনি যখন মারা গেছেন তখন হাবিব নবম শ্রেণিতে পড়ে। আলীকদমের সবাই লিয়াকত আলীকে বেশ সম্মান করে। মারা যাওয়ার এতো বছর পরেও আলী সাহেবের জন্য মানুষের অন্তরে মায়া জন্মে আছে। বারো বা তের বছর আগে আজকের মতো এক বিকেলে হাবিব আর লিয়াকত আলী নিজেদের গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছিল।

তাদের সাথে ছিল ব্যাগভর্তি লাখ দশেক টাকা। মাঝ রাস্তায় কয়েকজন এসে ফটফট করে গুলি করতে লাগলো। গাড়ির গ্লাস ভেঙে ছারখার। লিয়াকত আলীর শরীর রক্তেভেজা। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তে পড়তে আলী সাহেব চোখ বন্ধ করল।

পাশেই ছোট্ট হাবিব বেহুশ হয়ে পড়ে রইল। সেদিন হাবিব বেঁচে গিয়েছিল, কিন্তু আলী সাহেব সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দিলেন। সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া না দেওয়ার সামর্থ্য মানুষের নেই। সেদিনের সেই ছোট হাবিব আর ছোট নেই।

ঘরের বড় ছেলে হিসেবে পুরো ঘরকে আগলে রাখে সে। কাজের ফাঁকেফাঁকে প্রেম করে। হাবিবের প্রেমিকা রাইমা, সম্পর্কে তার আপন খালাতো বোন।

সেই ছোটবেলা থেকে রাইমাকে ভালো লাগতো হাবিবের। এই ভালোলাগা কখন যে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে হাবিব টের পায়নি। আস্তে আস্তে তাদের ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর হতে হতে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা।

বিয়ে করলেও রাইমাকে এখনো ঘরে তোলা হয়নি হাবিবের। সে চায় ধুমধাম করে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরে তুলে আনবে রাইমাকে। কিন্তু একের পর এক সমস্যা তার সামনে আসার কারণে এখনো ঘরে তোলা হয়নি রাইমাকে।

টাকা পয়সা খরচ করে বিয়ের অনুষ্ঠান না করলে আবার মানুষ নাক ছিঁটকায়। বিয়ে নিয়ে সমাজের বিভিন্ন ফালতু নিয়ম-কানুনের জন্য বিয়ে করা দিনদিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। শুধু একটা বিয়ের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে দুইটা পরিবারকে পথে বসতে হয় এ সমাজে। কনেপক্ষ সবচেয়ে বেশি ঘানিপেষা হলেও বরপক্ষের দুর্ভোগও কম নয়। তারপরেও এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ছাড় দিতে নারাজ।

ব্যাপারটা এমন যে, প্রয়োজনে আমার একটা চোখ অন্ধ হয়ে যাক, তবু অন্যজনের দুইটা চোখ অন্ধ থাকুক। নিজের ক্ষতি করে হলেও অন্যের কান্নায় আমরা বড় আনন্দ পাই। অবশ্য হাবিবের ক্ষেত্রে সে সমস্যা নেই। হাবিব চাইলে এসব ঝামেলা না করেই রাইমাকে ঘরে তুলতে পারে। কিন্তু সে চায় ধুমধাম করেই তার ভালোবাসার মানুষটাকে ঘরে তুলে আনতে।

                      নুরুদ্দীন হোটেলে ভাত খাচ্ছি। দুপুর, রাতে ভাত খাওয়ার জন্য আমার একমাত্র ভরসা নুরুদ্দীন হোটেল। আমার বাসার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা পানবাজারে গিয়ে মিলেছে সেটার মাথায় নুরুদ্দীন হোটেল। নুরুদ্দীন হোটেলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, এই হোটেলে মাছ, মাংস আলাদা করা গেলেও মাছ, মাংসের ঝোল আলাদা করা যায় না। কোনটা মাংসের ঝোল আর কোনটা মাছের সেটা বুঝা বেশ কষ্টের এখানে। তারপরেও আমার মতো ব্যাচেলর মানুষের একমাত্র ভরসা এই নুরুদ্দীন হোটেল।

হোটেলে ভাত খাওয়ার ফাঁকেফাঁকে মোবাইল টিপছি, এদিকে টিভি চলছে হোটেলে। আজ টিভিতে নিউজ চ্যানেলগুলো বেশ গরম। আগামীকাল থেকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।  বেশ কয়দিন ধরে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামীকাল থেকে সবকিছু বন্ধ থাকবে। এ যেন জ্বালার উপর জ্বালা।  হোটেল বন্ধ থাকলে খাবো কোথায়? রান্না করতে মোটেই পারি না আমি। কাল থেকে আমাদের অফিসও বন্ধ। সুতরাং বাসায় থাকতে হবে। বাসায় থাকাটা সমস্যার নয়, কিন্তু খাবারের ব্যবস্থা করাটা ভাবনার। খাবারের ব্যবস্থা থাকলে বাসায় থাকতে সমস্যা নেই। বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলাম। ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। অতএব এই বিষয় নিয়ে ভেবে কোনো লাভ নেই।

               আজ লকডাউনের প্রথম দিনে শাওন রান্না করেছে। সে ডিমভাজি করতে গিয়ে অন্যরকম এক তরকারি তৈরি করেছে। রান্না করা যে কতো কঠিন তা রান্না করতে না গেলে বুঝা যায় না। অথচ মেয়েরা আমাদের জন্য প্রতিদিন রান্না করেই চলেছে।

তাদের রান্নাটাকে কাজ হিসেবেই ধরা হয় না। আমার তো এখন মনেহচ্ছে পৃথিবীতে সেই মেয়েটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ভালো রাঁধতে পারে। আমি আর শাওন লেবুর রস আর ডিমভাজি দিয়ে কোনো রকমে পেটের জ্বালা মেটালাম। আমাদের এই কঠিন অবস্থা দেখে বাতাসী আপু আগামীকাল থেকে উনাদের সাথেই খেতে বললেন। আজ রাতে দাওয়াত পেয়েছি জাবিরদের বাসায়। জোহরা খুব ভালো বিরিয়ানি রান্না করে। লকডাউনের প্রথম দিন উপলক্ষে আমাদের কথা ভেবে সে বিরিয়ানি রান্না করছে আজ।

আমাদের সাথে বিরিয়ানির দাওয়াত পেয়েছে হাবিব, মিনার আর উইন মারমা। মিনার আর উইন মারমা দুইজনেই আমার সহকর্মী। মিনার, আমার দেখা ভদ্র মানুষদের একজন। ভদ্রতা জিনিসটা কী, সেটা তার কাছে শেখা উচিৎ। লম্বা, ফর্সা ছেলেটা এখনো বিয়ে করেনি। তবে বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে।

আমরা সবাই তার বিয়ে খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। উইন মারমার বয়স ৫২, কিন্তু তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে তার এতো বয়স হয়েছে। একসময় খুব ভালো ফুটবল খেলতো। বয়স বাড়লেও শরীর এবং মন কোনোটাতেই বয়সের চাপ পড়েনি এখনো। আমরা এই পাঁচজন দাওয়াত পেয়েছি। অবশ্য দাওয়াত বলা যায় না, কারণ জাবিরদের বাসা আমরা নিজেদের বাসা বলেই মনে করি। বেশিরভাগ আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া সব এখানেই হয়। জাবির, জোহরা দুইজনে আমাদের জন্য রান্না করতে করতে হয়রান হয়ে যায় তবুও কখনো মুখের হাসিটা ম্লান হয় না।

                     আজ শনিবার। আমাদের সবার ছুটির দিন। ছুটির দিনে আড্ডাতেই আমাদের সময় কাটে। করোনাকালীন লকডাউনের কারণে দোকানপাট সব বন্ধ। তারপরেও কয়েকটা দোকান পুলিশের সাথে লুকোচুরি করে খোলা রাখে এখানে।

পুলিশ টহলে এলে কোনো রকমে সামলানো যায়, কিন্তু দিনে দুইবার করে সেনাবাহিনী আসে টহল দিতে। এদেশের মানুষ পুলিশকে ততোটা ভয় না পেলেও সেনাবাহিনীকে বাঘের মতো ভয় পায়। সেই ভয়ের কারণেই দোকান বন্ধ আছে। নুরুদ্দীন হোটেলের পাশের দুই দোকান পরে নুরুল ইসলামের দোকান।

নুরুল ইসলামের দোকান বাইরে থেকে বন্ধ থাকলেও ভেতরে বসা যায়। ভেতরে অনেকেই বসে। তবে আমরা নিয়মিত বসি। বাসায় আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়? আমরা সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে মিনারের ফোন বেজে উঠলো।

মিনারকে আমাদের ম্যানেজার ফোন করেছে। ফোন করে বলেছে সে যেন তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যায়। গত পরশুদিন আমাদের অফিসের সবাই করোনার টেস্ট করেছিলাম। আজ টেস্টের রেজাল্ট আসার কথা। হয়তো মিনারের করোনা পজেটিভ এসেছে, তাই ম্যানেজার তাকে বাসায় চলে যেতে বললো।

অবশ্য ম্যানেজার কেন তাকে বাসায় যেতে বলেছে সেই কারণটা বলেনি। আমরা ভেবে নিলাম যে মিনারের করোনা হয়েছে। আমার হয়তো করোনা হয়নি তাই আমাকে ফোন দেয়নি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সবাই মিনারের নিকট থেকে দূরে সরে গেল। বিষয়টা দেখে আমার খুব খারাপ লাগলো। এতক্ষণ আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম, অথচ মুহুর্তেই কিভাবে সবাই আলাদা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ কিভাবে পারে এতো দূরে সরে যেতে। আমি মিনারকে ভয় পেতে মানা করলাম। ওকে বললাম আমার বাসায় চলে আসতে। কারণ করোনাকালীন দেখাশুনার জন্য একজন মানুষতো দরকার। এরপর মিনারকে টমটমে তুলে দিয়ে আমরা আরও কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। আড্ডাশেষে বাসায় ফিরে শুনলাম, মিনার নয়, আমি করোনা পজেটিভ। তখন এশার আযান দিচ্ছে। আমার মোবাইলে একের পর এক ফোন আসতে লাগলো।

ফোন রিসিভ করতে করতেই বিরক্ত হয়ে উঠলাম আমি। রাতের মধ্যে আমাদের চারপাশ বন্ধ করে দেওয়া হলো। মানুষ কিভাবে পারে কাউকে হঠাৎ করে এতো পর করে দিতে। আমার করোনা হওয়ার কথা শুনে হাবিব কোয়ারাইন্টাইনে ঢুকে গেছে।

আমাকে শাওন, জাবির, জোহরা সবাই মিলে অভয় দিলো। অবশ্য আমার মনে ভয় ঢুকেনি তেমন। তবে খাওয়া দাওয়া নিয়ে ভয় ঢুকেছে। বেঁচে থাকতে হলে তো খেতে হবে। আমি মোটেই রান্না করতে পারি না। রাতে বাতাসী আপু ভাত পাঠালো। শাওন, জাবির, জোহরা মিলে রান্না করার জন্য যা যা দরকার আমার জন্যে এসবের ব্যবস্থা করলো। আমার একা থাকতে ভালো লাগে। কিন্তু এভাবে একদম একা হয়ে যাবো কখনো ভাবিনি। আমাকে বাসার জানালা খুলতেও নিষেধ করা হয়েছে। আর বাসায় কারও আসা নিষেধ। জাবিরের কাছে স্টুডেন্টরা পড়তে আসে। তাদেরকে আসতেও নিষেধ করা হয়েছে।

                   একা বাস করা যে কতটা কঠিন সেটা করোনা আক্রান্ত না হলে বুঝতাম না। যখন  আমার পাশে এমন কোনো মানুষ দরকার যারা আমাকে সাহস যোগাবে, সেই সময়টাতে করোনার কারণে আমার পাশে সবাইকে আসতে মানা করে দেওয়া হয়েছে। এ যেন নির্মম বনবাস কিংবা কারাবাস। জানি না কারাগারে সূর্যের আলো পৌঁছায় কিনা, কিন্তু আমার রুমে সূর্যের আলো পৌঁছানোর কোনো সুযোগ নেই। জানালা খুলতেও নিষেধ করার কারণে সূর্যের আলো দেখার সুযোগ আমি হারিয়েছি।

এ যেন নতুন এক জগৎ। যে জগতে নিজের সাথে নিজেই বাস করি। আমার রুমে চারপাশের চার দেয়াল, ছাদ আর আমি এই ছয়জন বাস করছি। মানুষ বলে, দেয়ালের নাকি কান আছে।

কানের সাথে যদি মুখ থাকতো তাহলে বেশ ভালো হতো, আমি দেয়ালের সাথে কথা বলতে পারতাম। দুপুরে আলু ভাজি করতে গিয়ে সেগুলো অনেকটা আলুর চিপসের মতো হয়ে গেল আর ভাতগুলো চাউলের চেয়ে কিছুটা নরম হলেও ভাত হয়নি। ডিম সিদ্ধ করেছি, সেটা ভাঙার পর গড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

ডিমটা সিদ্ধ হয়নি। ঘড়ি না থাকলে এখন সময় কত বুঝার কোনো উপায় নেই। একটা দিন যে কতটা দীর্ঘ হয় সেটা যারা করোনা আক্রান্ত হয়েছে প্রত্যেকেই জানে। রাতের আঁধার হালকা নামতে নামতেই দরজায় আওয়াজ হলো।

আমি কিছুটা ভয়ে ভয়ে দরজা খুললাম। আমাকে দরজা, জানালা খুলতে নিষেধ করা হয়েছে। তাই দরজা খুলতেও ভয় করছে এখন। দরজা খুলতেই দেখি বাইরে শাওন দাঁড়িয়ে আছে। আমি অনেক করে মানা করলাম আমার রুমে না আসার জন্য। সে শুনবে না আমার কথা। করোনা হলে হবে সে এসবের পরোয়া করে না। মনেমনে কিছুটা খুশি হলাম আমি।

সেই সকাল থেকে একা থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছি। শাওন আমার খাবারের অবস্থা দেখে হাসলো। সে, জাবির আর জোহরা মিলে নাকি সব পরিকল্পনা করে রেখেছে। রাত থেকে আর খাবারের চিন্তা করতে হবে না।

কেউ না দেখে মতো আমার জন্য খাবার আনা হলো। জোহরার রান্না খেয়ে পেটের কষ্ট আর মনের কষ্ট কমে গেল আমার। আসলে জীবনের কঠিন সময়গুলোতে কিছু প্রিয়জন খুব বেশি দরকার। বিপদ থেকে মুক্ত করতে না পারুক, কিন্তু পাশে দাঁড়িয়ে অন্তত এইটুকু বলুক যে, চিন্তা করো না, আমি আছি তোমার পাশে। ভরসা জিনিসটা খুব বেশি দরকার আমাদের। শাওন, জাবির, জোহরা চাইলে অন্যদের মতো আমাকে দূরে ঠেলে দিতে পারতো, কিন্তু ওরা সেটা করেনি। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে ভালোবেসেছে। ভালোবাসা জিনিসটা অন্যরকম, ভালোবাসা মৃত্যুকে ভয় করে না। মৃত্যু ভালোবাসার কাছে হেরে যায়। ভালোর সাথে আলো থাকে, আঁধার কাটে। ভালোবাসা আমাদের জীবনের অন্ধকার দূর করে দিয়ে আলোর ছোঁয়া দেয়। এই পৃথিবীতে আর কিছু থাকুক না থাকুক, অন্তত ভালোবাসা থাকুক। আজকাল পৃথিবীতে ভালোবাসার বড্ড অভাব।

                       গতকাল হঠাৎ করে শাওনের বদলির আদেশ এসেছে। তাই আজ সে চলে যাচ্ছে। আমার এই কঠিন সময়ে সে থাকাতে মনে ভরসা পেতাম। সে চলে গেলে আমি একদম একা হয়ে যাবো। আমি বন্ধ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ওর সাথে কথা বললাম। দিনের বেলায় সে আমার বাসায় ঢুকে না। কারণ বাইরের মানুষ জানলে কড়াকড়ি বেড়ে যাবে। এমনিতেই আমি করোনা আক্রান্ত হওয়ায় এদিকে মানুষজন আসে না তেমন। হঠাৎ করে শাওনের চলে যেতে হবে ভাবিনি। জীবনটা আসলেই এমন।

জীবন কখনো নিজের মনের মতো হয় না, মনকে জীবনের মতো করে নিতে হয়। মনকে জীবনের মতো করে নেওয়া বেশ কষ্টের। শাওন খুব হাসাতে পারে মানুষকে। কিভাবে যে সময়গুলো কেটে গেছে বুঝতেই পারিনি। যখন খুব মন খারাপ থাকতো, ওর সাথে আড্ডা দিতাম। সে এতো এতো হাসির কথা বলতো যে, মন খারাপ রাখা যেতো না।

                   করোনার কারণে বের হওয়ার সুযোগ নেই। তাই আমার একমাত্র সঙ্গী ফেসবুক। অলস সময় কাটানোর জন্য ফেসবুকের চেয়ে উত্তম কিছু নেই। ফেসবুক ব্রাউজ করতে করতে একটা আইডিতে চোখটা আটকে গেল। প্রোফাইলে সুন্দর একটা পুতুলের ছবি দেওয়া আইডিটার নাম নীলপরী। নীলপরী নামটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম।

কিছুক্ষণ পর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সচেপ্টের নোটিফিকেশন আসার পর ‘Hi.“ লিখে মেসেজ পাঠালাম। মেসেজের উত্তরের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও উত্তর পেলাম না।

                    আজ মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। অনেকদিন পর সূর্যের আলো দেখছি। অবশেষে আমি করোনামুক্ত হলাম। মনেহচ্ছে কারাগার থেকে বেরিয়েছি। পানবাজারের দিকে যেতেই সবাই কেমন যেন আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। মনে বেশ কষ্ট পেলাম। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এলাম। অনেকদিন পর জাবির আর জোহরার সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি।

শাওন থাকলে আড্ডাটা আরও ভালো জমতো। ওকে মিস করছি আমরা। আমাদের সাথে আড্ডা দিতে কোরবান আলী আর বাতাসী আপুও এসেছে। সবার পেটে অনেক কথা জমে আছে। কথার ছড়াছড়ি চলছে। আলীকদম আসার আগে এদের সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি, অথচ মনেহচ্ছে সবাই আমার অনেকদিনের চেনা। এই কয়টা দিন ওদের সাথে আড্ডা দিতে না পেরে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। আজ নিজেকে আকাশের মুক্ত পাখির মতো মনেহচ্ছে।

                 কোরবান আলীর বড় দুই মেয়ের নাম আসিফা আর নুসপা। আসিফা ৮ম শ্রেণিতে আর নুসপা ৭ম শ্রেণিতে পড়ে। কয়েকদিন আগে আসিফার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। মেয়েটার বয়স টেনেটুনে ১৪ তে নেওয়া যায়, কিন্তু আঠারোতে নেওয়া সম্ভব না।

তারপরেও বাতাসী আপু কিভাবে কিভাবে মেয়েটার বয়স আঠারো বানিয়ে বিয়ে ঠিক করেছে। ছেলে চাষবাস করে। ছেলেটার বয়সও টেনেটুনে সতের পর্যন্ত নেওয়া সম্ভব, এর বেশি নয়। এই এলাকায় বাল্যবিবাহ বলতে কোনো জিনিস নেই।

কারণ এরা বাল্যবিবাহ বুঝে না। বেশিরভাগ মেয়েকেই ১৩/১৪ তে বিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকটা শিক্ষিত পরিবার ছাড়া বাকি পরিবারগুলোর অবস্থা এমন। তাদেরকে বুঝালেও বুঝতে চায় না। সারাদিন বোঝানোর পরেও তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয় না। অতএব কোরবান আলী আর বাতাসী আপুকে বুঝানো বৃথা চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারপরেও আমি, জাবির আর জোহরা মিলে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলাম। এতটুকু চেষ্টা করলে হয়তো পাথরের বুকে ফুল ফুটতো, কিন্তু উনাদের বিবেকের ফুল ফুটলো না। আসিফা বিয়েতে রাজি নয়, তবে বাবা-মায়ের মুখের উপর না বলার সাহস তার নেই।

মুখের উপর ‘না’ বলেও অবশ্য লাভ নেই। লকডাউনের কারণে বড় করে আয়োজন করা হবে না। তবে আয়োজনের টাকা বেঁচে যাবে সেটা ভাবারও দরকার নেই। পাত্রপক্ষকে সেই টাকাটা উপহার হিসেবে দিতে হবে।

আমাদের সমাজ বিয়ের ব্যাপারে এতোসব নিয়মকানুন তৈরি করে রেখেছে যে, ঘরে মেয়ে জন্ম নিলে সাথে সাথেই একটা টাকার গাছ লাগিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। মেয়ে বিয়ে দিতে গিয়ে কতো পরিবার যে পথে বসেছে তার হিসেব নেই। বিয়ে দিয়েই কনের বাবার দায়িত্ব শেষ হয় না, বরপক্ষের দাবী চলমান।

জানি না সমাজের এই নিয়মগুলো কবে পাল্টাবে। এই নিয়মগুলো যে তৈরি করেছে তাকে সামনে পেলে ধপাস ধপাস দুইটা থাপ্পড় দিয়ে মনটাকে শান্ত করতাম।

                    অফিস শেষ করে বাসায় ফিরছি। বাসার দরজা খোলার আগেই জোহরা ডাক দিলো। তার চোখেমুখে ভয়। তাকে দেখে আমার নিজের মনটাও মোচড় দিয়ে উঠলো।

কী হয়েছে, জোহরা?”

দুপুর থেকে আসিফা আজব আজব সব কাণ্ড করছে।”

কী রকম?”

‘সে দুপুরে ঘুমাচ্ছিল। তখন কে যেন ওকে গলা চেপে ধরেছে।”

‘হয়তো ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছে।”

‘না, ভাইয়া। সে নাকি ঘুম থেকে উঠার পরেই চেপে ধরেছে। রুম অন্ধকার ছিল বলে কাউকে দেখেনি সে। এরপর থেকে সে কেমন কেমন করছে।”

আমি কুরবান আলীদের বাসায় গিয়ে আসিফাকে দেখে আসলাম। আসলেই মেয়েটা বেশ ভয় পেয়েছে। জানি না কী হয়েছে, কিন্তু আমাদের সবার মনেই ভয় বাসা বাঁধলো। কয়েকদিন আগে আমাদের বাসার পাশে কোরবান আলী সাদা কাপড় পড়া একটা মানুষ দেখেছে। টর্চলাইট মারার পর সেই মানুষটা অদৃশ্য হয়ে যায়। সবকিছু মিলিয়ে আমরা বেশ আতঙ্কিত হয়ে গেলাম। আমরা সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। এমনিতেই আমরা সবাই একেকটা ভীতুর ডিম। তার উপর এই ঘটনাগুলো আমাদের কলিজা আরও নরম করে দিয়েছে। কোথাও একটু শব্দ হলেই মনে হচ্ছে কলিজাটা ছিঁড়ে যাবে। কোনোরকমে রাতটা পার করলাম। সকালসকাল হাবিব এসে আমাদেরকে অভয় দিলো। হাবিব বললো, এসব কোরবান আলীদের সাজানো ঘটনা। আর তাই সে তাদেরকে এই বাসা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে বললো। তারা প্রথমে রাজি না হলেও পরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। এই সিদ্ধান্তের ফলে আমি, জোহরা, জাবির ছাড়া এখানে থাকার মতো আর কেউ রইলো না।

                     অনেকদিনপর আজ পানবাজারের সেই ব্যস্ততা ফিরে এসেছে। লকডাউনের কারণে পানবাজার অনেকটা মরা নদীর মতো হয়ে গিয়েছিল। লকডাউন তুলে দেওয়ার সাথে সাথে চিরচেনা সেই পানবাজারের ব্যস্ততা চোখে পড়ছে। আজ থেকে নুরুল ইসলাম আর মনে ভয় নিয়ে দোকান চালায় না। লকডাউন উঠলেও আমাদের আগের সেই আড্ডা আর জমছে না। জমবেই বা কী করে শাওন চলে গেছে অনেক আগে। এদিকে মিনার আর উইন মারমাও ট্রান্সফার হয়ে গেছে। আজকাল হাবিব বেশ ব্যস্ত থাকে। তাই পানবাজারে আর বসা হচ্ছে না। সন্ধ্যায় জাবিরদের বাসায় হালকা পাতলা আড্ডা চলে। কোরবান আলীরা চলে যাওয়ায় চারপাশে শূন্যতা বিরাজ করছে। কোরবান আলীদের পরিবারটা এতো বড় ছিল যে, সবসময় চিৎকার চেঁচামেচি লেগে থাকতো। এখন আমাদের বাসা নিস্তব্দ, কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। দেশ থেকে এখনো করোনা যায়নি, তবে এই কয়দিনে দেশটাকে পাল্টে দিয়েছে। মানবজাতিকে ছোট একটা ভাইরাস এভাবে পাল্টে দেবে কেউ কখনো ভাবেনি। অনেকদিন বাড়িতে যাওয়া হয় না আমার। এখন বৃহস্পতিবারের জন্য অপেক্ষা করছি। সামনের বৃহস্পতিবার বাড়িতে যাবো।

                      সন্ধ্যা নামছে। দূরে একটু একটু আলোর রেখা দেখা গেলেও সেটা অন্ধকার গিলে ফেলছে। আমি চকরিয়া যাওয়ার জন্য জিপের টিকেট কাটলাম। আমার সাথে আমার ৩জন সহকর্মী আছে। এই জিপগুলোতে ২জনের সিটে ৪জনকে বসানো হয়। প্রতিজনের ভাড়া ৭০টাকা। ঠিকমতো বসে যেতে হলে ২টা সিট নিতে হয়। বিশেষ করে মেয়েরা যখন যায়, তখন ২টা সিট নিতে হয়। কারণ ছেলেদের সাথে ছেলেরা গাদাগাদি করে বসতে পারলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয় না। গাড়িতে মোট ১৩টা সিট থাকে। আমাদের ৪সিটসহ মোট ১২টা সিটের টিকেট বিক্রি শেষ। আরেকটা টিকেট বিক্রি হলেই গাড়ি ছাড়বে। আমরা উঠে বসলাম গাড়িতে। আমার সিট সবার পেছনে। কারণ পেছনে বসতে একটু কষ্ট হলেও হাঁটু ব্যাথা করে না। প্রথম দুই সারির আটটা সিটে যারা বসে তাদের পায়ের হাঁটু ব্যাথা হয়ে যায়। দ্বিতীয় সারিতে আমার ৩জন সহকর্মী বসলো। আরেকটা সিট খালি, সেটার টিকেট এখনো বিক্রি হয়নি। হঠাৎ একটা মেয়ে এলো তাড়াহুড়ো করে। মেয়েটার হয়তো কোথাও যেতে দেরী হয়ে যাচ্ছে সেটা তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। লাল হিজাবের সাথে মুনগ্লাস পড়া মেয়েটার ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভদ্র ঘরের মেয়ে। এখন তিনজনের পাশে যেটুকু জায়গা আছে সেটুকুতে মেয়েটার বসা কোনোভাবেই সম্ভব না। মেয়েটা বেশ সংকোচের মধ্যেই পড়ে গেল। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমার একটা সহকর্মীকে পেছনে চলে আসতে বললাম। কিন্তু সমস্যা হলো পেছনেতো সিট নেই। পেছনের চার সিটের মধ্যে আমরা তিনজন মানুষ, আরেক সিটে কিছু জিনিসপত্র রাখা হয়েছে। যিনি জিনিসপত্রের জন্য সিট নিয়েছেন উনাকে বললাম, ‘ভাই মেয়েটা বিপদে পড়েছে, আপনি একটা সিট ছেড়ে দিন। জিনিসগুলো অল্প আপনার কোলের উপর রাখেন আর কিছু আমাকে দেন। তেমন বেশি কিছুতো না।” তখন মেয়েটা বললো, ‘আমি আসলে ২টা সিট চেয়েছিলাম। কিন্তু একটা সিট-ই বাকি আছে। এদিকে আমার খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। খুব নিরুপায় হয়ে উঠেছি। যদি পারেন একটা সিট ছেড়ে দেন। আমি আপনাকে সিটের ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি।” কিন্তু মানুষটা কঠিন লেভেলের গোঁয়ার। উনি সিট ছাড়ছেন না। অবশেষে আমি নিরুপায় হয়ে উনাকে সিট ছাড়তে বাধ্য করলাম। আমার সহকর্মী বসলো লোকটার পাশে। লোকটা কিছুক্ষণ পরপর আমার দিকে বিরক্তিমাখা চেহারা নিয়ে তাকাচ্ছে আর মুখের ভেতরে পান চিবানোর মতো করে কী কী যেন বলছে। আমি সেদিকে নজর না দিয়ে সহকর্মীদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠলাম। আড্ডা দিতে দিতেই স্টেশন এসে গেল। আমি গাড়ি থেকে ধপাস করে নেমে হাঁটা শুরু করলাম।

                       বাসায় আমার দুইটা কাজ হয়তো ফেসবুকে গুঁতাগুঁতি করা নয়তো ঘুমানো। ফেসবুক চালানোটা ডায়াবেটিসের মতো হয়ে গেছে, নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাময় অসম্ভব। একবেলা ভাত না খেয়ে থাকা গেলেও একবেলা ফেসবুক ব্যবহার না করে থাকা সম্ভব না। এটা আজকাল আমাদের নিঃশ্বাসের সাথে নেওয়া অক্সিজেনের মতো হয়ে গেছে। তবে ফেসবুকের উপকারিতাও কম নয়। এটা আমাদেরকে একটা জায়গায় নিয়ে এসেছে। মনেহয় সবাই একসাথে বসে আছি। প্রতিদিন পরিচিত সকলের সাথে ফেসবুকের মাধ্যমে অন্তত একবার হলেও দেখা হচ্ছে। তবে সমস্যাটা হলো, কোনো জিনিসের প্রতি আসক্তি খারাপ। এটা এখন আমাদের নেশায় পরিণত হয়েছে। নেশা জিনিসটা মোটেই ঠিক না, সেটা যে জিনিসের নেশাই হোক। আপাতত ফেসবুকে আছি। এখন রাত ০৯:১১। একটা মেসেজ এলো, সেই Ôনীলপরী’ আইডি থেকে।

‘ধন্যবাদ। সেদিন সম্ভবত আপনি আমাকে গাড়িতে সাহায্য করেছিলেন।”

আমার বুঝতে বাকি রইলো না, সেদিন জিপে দুইটা সিট নিয়ে দেওয়া সেই মেয়েটা Ôনীলপরী’। অবশ্য আমি জানতাম না, এই আইডির মালিক ঐ মেয়েটা। কারণ ওর প্রোফাইলে কোনো ছবি নেই। প্রোফাইলজুড়ে সব পুতুলের ছবিতে ভরা।

‘আমি????”

‘হুম।”

‘কোন গাড়িতে?”

‘আলীকদম। আমি জানতাম না, আপনি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড।”

‘আপনার ভুল হচ্ছে মনেহয়। আপনার সাথে কখনো দেখা হয়নি আমার। আর আপনার প্রোফাইলে ছবিও নেই।”

‘একমাত্র মেয়ে ছিলাম আমি আর আপনি আমাকে ২টা সিট নিতে সাহায্য করেছিলেন।”

‘আমি কিভাবে সাহায্য করবো। আপনার ভুল হচ্ছে।”

‘আপনার বাড়ি কি আলীকদম?”

‘না, আমার বাড়ি চকরিয়া।”

‘তাহলে আমার ভুল হয়েছে।”

‘আপনি আলীকদম থাকেন? সামনেরবার থেকে যাওয়ার সময় বাসে যাবেন। বাসের সিট জিপের চেয়ে অনেক ভালো, এতো চাপাচাপি করে বসতে হয় না।”

‘আমাকে না চিনলে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেওয়া আর সামনেরবার থেকে বাসে যাওয়ার প্রশ্ন এলো কেন?”

‘সেদিন জানতাম না Ôনীলপরী’ আইডির মালিক আপনি। তো কোথায় যাচ্ছিলেন?”

‘আমি হঠাৎ ফেসবুকে আপনার ছবি দেখে মনে পড়লো সেদিনের হেল্পের কথা। ধন্যবাদ।”

‘হেল্পের জন্য ধন্যবাদ দিতে হয় না। কোনো একদিন অন্য কেউ বিপদে পড়লে আপনিও হেল্প করিয়েন।”  

‘এটা তো বলা লাগবে না।”

‘কী করেন আপনি?”

‘পড়ালেখা করি।”

‘কিসে পড়েন?”

‘দশম শ্রেণিতে।”

‘হা, হা, হা।”

‘হাসার কী আছে?”

‘কিসে পড়েন?”

‘ভুলে গেছি।”

‘ভুলে যাওয়া ভালো। বেশি মনে থাকলে মন খারাপ হয়।”

‘অনার্স ২য় বর্ষ।”

‘কোন বিষয় নিয়ে অনার্স করছেন?”

‘ইংরেজি।”

‘ভালোই তো। কোন জায়গা থেকে করছেন অনার্স?”

‘কক্সবাজার সরকারি কলেজ।”

‘ভালোই। তো শ্বশুরবাড়ি কোথায় আপনার?”

‘আপাতত জানি না। তবে বাপের বাড়ি আলীকদম।”

‘আলীকদম কোন জায়গায়?”

‘উপজেলার পাশে।”

‘ওহ আচ্ছা। আমি পানবাজার থাকি।”

‘বউ, বাচ্চা সহ?”

‘না, একা থাকি। এখনো বউ, বাচ্চা আসেনি জীবনে।”

‘ওহ। আচ্ছা সেদিনের জন্য আবারও ধন্যবাদ।”

‘বারবার ধন্যবাদ কেন?”

‘সেদিন আপনার আচরণটা দেখে মন ছুঁয়ে গেছে সিরিয়াসলি। তাই আপনাকে ফেসবুকে দেখে সাথাসাথেই মেসেজ দিলাম। আমি ফেসবুকে আসি না তেমন।”

‘কী এমন করলাম যেটার জন্য এতো ধন্যবাদ দিতে হবে। আচ্ছা ধন্যবাদ না দিয়ে পারলে কফি খাওয়াবেন একদিন।”

‘উপকার এর প্রতিদান চান? কেমন মানুষ আপনি? হুম???”

‘আপনি যেহেতু বারবার ধন্যবাদ দিচ্ছেন, তাই কফি খাওয়ালে আপনার মাথা থেকে কৃতজ্ঞতার বোঝাটা নেমে যাবে। তাই বললাম।”

‘ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ধন্য করলাম।”

‘আমি কফি খেয়ে ধন্য হতে চাই। আচ্ছা খাওয়াতে হবে না। আপনি ভয় পাচ্ছেন কফি খাওয়াতে।”

‘খুশি হলাম।”

‘আমি মন থেকে খাবো না বলিনি। আপনি ভয় পাচ্ছেন দেখে খাবো না বললাম।”

‘আপনি খুব মজার মানুষ। সেদিন গাড়িতে আপনার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া দেখে বুঝেছি।”

‘আমি আপনাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম আপনার ফেসবুকের নামটা দেখে। নামটা খুব সুন্দর। আপনার আসল নাম কী?”

‘সুমনা জান্নাত। সবাই সুমনা বলেই ডাকে।”

‘বাহ! খুব সুন্দর নাম। আপনার নামটা আপনার মতোই সুন্দর।”

‘আমি সুন্দর? বাহ! ভালো লাগলো।”

‘সুন্দর না?”

‘জানি না।”

‘অনেক সুন্দর আপনি। চশমা দিলে আরো বেশি সুন্দর লাগে।”

‘প্রোফাইল পিকচারটা কার্টুন, আমি না। আর চশমাটাও কার্টুনের দেওয়া।”

‘তাই নাকি? তাহলে আপনার ছবি পাঠান একটা।”

‘দিতে পারবো না।”

‘মন নরম করে চেষ্টা করলে পারবেন।”

‘আমার মনটা অনেক কঠিন। নরম করতে না পারলে আমি কী করবো?”

‘কঠিন খোলসের আবরণে কিন্তু মুক্তা জন্ম নেয়।”

‘বাহ! আপনি অনেক বুদ্ধিমান।”

‘পৃথিবীর সব মানুষ-ই বুদ্ধিমান আবার সব মানুষ-ই বোকা।”

এভাবেই শুরু আমাদের। সুমনা যতটা সুন্দর, ততটাই চঞ্চল। তার চঞ্চলতা আমাকে মুগ্ধ করতে শুরু করে। আমার একঘেয়ে জীবনটা আস্তে আস্তে রঙিন হতে শুরু করলো। আকাশের চাঁদ থেকে শুরু করে রাস্তার পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ঘাসফুল, পৃথিবীর সবকিছু আমার সুন্দর লাগতে শুরু করলো। জীবনের কষ্টগুলো ভুলে গিয়ে আমি সুখের সন্ধান পেতে শুরু করলাম। সুমনার সাথে রাত জেগে চ্যাটিং করার অভ্যাস গড়ে উঠলো আস্তে আস্তে।

‘আপনার নম্বরটা দেওয়া যাবে, সুমনা?”

‘যাবে। কিন্তু অনুমতি ছাড়া ফোন দেওয়া নিষেধ।”

‘আচ্ছা ঠিক আছে।”

‘০১৩………”

“ধন্যবাদ।”

‘আচ্ছা এখন আপনাকে ব্লক দিচ্ছি।”

‘কেন?”

বলতে না বলতেই মেসেঞ্জারে সে ব্লক করে দিলো আমাকে। আমি বুঝতেই পারলাম না, কেন সে ব্লক করলো। মনটা বেশ মোচড় দিয়ে উঠলো। নম্বরটা না চাইলেই হয়তো ভালো হতো। ভালোইতো যাচ্ছিল সময়। কিছুক্ষণপর ওর মেসেজ দেখে তাড়াতাড়ি মেসেঞ্জারে ঢুকলাম।

‘আপনি অনুমতি ছাড়া ফোন দিচ্ছেন কিনা পরীক্ষা করলাম।”

‘কী বলেন? আমিতো ভয় পেয়েছিলাম।”

‘কিসের ভয়?”

‘আপনাকে হারানোর।”

‘কী বলেন। এটা তো মোটেই ভালো না।”

‘হয়তো।”

‘আচ্ছা সরি। বোকামি করলাম এটা।”

‘কোনটা?”

‘ব্লক দিয়ে আপনাকে পরীক্ষা করাটা ঠিক হয়নি আমার।”

‘তো পরীক্ষায় ১০০ তে কত পেলাম?”

‘হা হা হা। ১০০ তে ১।”

‘মাত্র ১?”

‘হ্যাঁ। পরীক্ষায় একসাথে সব নম্বর পাওয়া ভালো না। আরও অনেক পরীক্ষা আছে।”

‘তাই নাকি? তো কফি খাওয়াবেন কখন?”

‘সময় হোক।”

আজ সন্ধ্যায় সুমনাকে ফোন করেছিলাম। প্রথমবার তার সাথে ফোনে কথা বললাম। কোনো মেয়ের কণ্ঠ এতো মিষ্টি হতে পারে আমার জানা ছিল না। আমি ওর কণ্ঠ শুনছিলাম আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম। সে ঐপাশ থেকে এক নাগাড়ে কথা বলেই যাচ্ছিল আর আমি শুনছিলাম। এভাবে ওর কথা শুনতে শুনতে জীবনের পুরোটা সময় হয়তো কাটিয়ে দেওয়া যাবে। ওর কথাগুলো এতো যে মধুর লাগছিল সেটা বুঝানোর ভাষা আমার জানা নেই। কথা বলতে বলতে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম দেখা করার। কাল বিকালে আমরা দেখা করবো। আমার সময় ফুরোচ্ছেই না। সকাল হওয়ার আগেই আমি বিকালের জন্য অপেক্ষা করছি। রাতের প্রতিটা মুহুর্ত আমাকে বলে বলে শেষ হচ্ছে। একটা রাত যে এতো দীর্ঘ আর সুন্দর হয় সেটা জানা ছিল না। আসলে সুন্দর জিনিসগুলো আমাদের আশেপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। কিন্তু সেই সৌন্দর্যের দেখা আমরা পাই না। আজ রাতে কোনো জ্যোৎস্না নেই, তবু পূর্ণিমা রাতের চেয়ে সুন্দর এই রাত। অন্ধকারের সৌন্দর্যটা অন্যরকম। একদিকে চাচ্ছি এই রাতটা তাড়াতাড়ি শেষ হোক, যাতে কাল বিকালটা তাড়াতাড়ি আসে। অন্যদিকে মন বলছে আজকের রাতটা আরো দীর্ঘ হোক, এতো সুন্দর রাত আর নাও আসতে পারে। আমাদের মনের ভাবনাগুলো পাহাড়ি ঝর্ণার মতো, এক স্থান হতে উৎপন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে হাজার নদীতে। মনের এই সুন্দর ভাবনাগুলো জীবনকে অনেকবেশি সুন্দর করে তোলে। ভাবনাগুলোতে যখন সুমনার মতো কেউ জায়গা দখল করে তখন ভাবনাগুলো আরো সুন্দর হয়ে উঠে, এই সৌন্দর্য স্বর্গীয়। যার ভাবনার রাজ্যের রাজকন্যা যতবেশি দূরন্ত, তার রাজ্য ততোবেশি পুষ্পসজ্জিত।

                         আজ সুমনার সাথে দেখা হবে। ঠিক বিকাল ৪টায় সে ব্রিজে আসার কথা। আমি ৪টার আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছি। ব্রিজের নিচে মাতামুহুরি বয়ে চলেছে। তেমন একটা পানি নেই এখন মাতামুহুরিতে। পাহাড়ের কোলঘেঁষা এই নদী আমার অনেক প্রিয়। এই নদীর দিকে তাকিয়ে থাকলে মনটা কেমন যেন ফুরফুরে হয়ে যায়। একটু দূরে তাকালেই মনেহয় নদী, পাহাড় আর আকাশ জড়িয়ে ধরেছে একজন আরেকজনকে, যেন ওদের ভালোবাসা জনম জনমের। নদী, পাহাড় আর আকাশ নিয়ে ভাবতে ভাবতে প্রায় ৫টা বেজে গেছে খেয়াল করিনি।

সুমনা এখনো আসেনি। ওর জন্য অপেক্ষা করতে মোটেই বিরক্ত লাগছে না। বরং ভালো লাগছে অনেক। কিছু অপেক্ষা হয় ভালোলাগার। ওর সাথে প্রথম দেখা করছি। মনের মধ্যে অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করছে। অবশ্য প্রথম দেখা বলা যায় না, কারণ জিপে ওর সাথে দেখা হয়েছে প্রথম। কিন্তু তখন সে অপরিচিত ছিল। আজকের সুমনা আর সেদিনের সুমনা এক হতে পারে না। একটা টমটম এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। টমটমের পেছনের সিটে বসে আছে সুমনা।

বোরকার সাথে হিজাব পড়েছে সে। শুধু চোখজোড়া দেখা যাচ্ছে। এই দুটো চোখ সাধারণ কোনো চোখ নয়। এই চোখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে জীবন দেওয়া যাবে। এত সুন্দর চোখ আমি আর কখনো দেখিনি। দুটো চোখ যেন পাহাড়ি ঝর্ণা। চোখজোড়া আমাকে ইশারা করলো। আমি ওর পাশের সিটে বসতে যাবো, তখন সে মানা করলো। আমি ড্রাইভারের পাশেই বসলাম।

টমটম চলছে। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে টমটম থামলো। আমরা সামনাসামনি বসে আছি। আমি ওর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছি না। সে চঞ্চল, কথা বলেই যাচ্ছে। মাঝেমাঝে আমাকে ভেঙাচ্ছে। আমার ভালো লাগছে।

কথা বলতে বলতে সে নিকাব খুললো। মনেহলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রমনীর রূপ আমি দেখলাম। কাজলকালো চোখ, ফর্সা মুখ, একগাল টোলপড়া হাসি। হয়তো আমি ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম এতোদিন।

‘কী ভাবছো?”

‘তোমাকে।”

‘আমাকে?”

‘তুমি এতো সুন্দর কেন?”

‘সুন্দর কোথায়?”

‘অনেকবেশি সুন্দর।”

‘কেন, জীবনে আর কোনো সুন্দর মেয়ে দেখোনি?”

‘দেখেছি। কিন্তু এমন সৌন্দর্য দেখা হয়নি কখনো। তুমি আসলেই সুন্দর। অনেকবেশি সুন্দর।”

‘হয়েছে, আর বলতে হবে না। চলো উঠি এবার। অনেক দেরী হয়ে গেছে। “

‘আর কিছুক্ষণ থাকি? এই সময়টা হারাতে ইচ্ছা করছে না।”

‘সময়কে কী ধরে রাখা যাবে? আরেকটু দেরী হলেই বাসায় বকা শুনতে হবে। মিথ্যা বলে এসেছি আম্মুকে।”

‘চলো তাহলে হাঁটতে হাঁটতে যাবো।”

‘আচ্ছা।”

আমরা দু’জন হাঁটছি। আমি জীবনে যতো হেঁটেছি তারমধ্যে আজকের সময়টা সেরা। পুরোটা জীবন যদি এভাবে হাঁটতে পারতাম।

একটা পরী নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে

তার চোখজোড়া যেন অতল সমুদ্র

তার চোখের গভীরতায় হারিয়ে যাওয়া ডুবুরি আমি

হারাতে চাই যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী।

‘এতোবেশি হারাতে হবে না। হারিয়ে যাওয়া ভালো না। সামনেই আমাদের বাড়ি। তুমি চলে যাও। আরেকটা কথা।”

‘হ্যাঁ, বলো।”

‘সামনেরবার থেকে আমার সাথে দেখা করতে এলে একটা করে চিঠি লিখে আনবে।”

‘আনবো।”

কবিতার পংক্তির মতো সুন্দর দুটো চোখ

চুলগুলো যেন বেয়ে চলা পাহাড়ি নদী

সদ্য ফোটা গোলাপের পাপড়ির মতো দুটো ঠোঁট

গাল বেয়ে রক্ত ঝরবে, হাত ছোঁয়াই যদি।

সে হাঁটলে মনেহয় যেন দুরন্ত হরিণ ছুটছে

হাতগুলো হাত নয়, নকশা কোনো শিল্পীর আঁকা

মুখের ভাষা শুনায় কবিতার আবৃত্তির মতো

আঙুল নয়, যেন হাতে দশটা কাশফুল রাখা।

সাইক্লোনের মতো গালে টোল পড়া ভুবনজয়ী হাসি

হাসতে দেখে নির্ভয়ে করা যাবে আটাশটা খুন

তার একটুখানি ইশারায় লেগে যাবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ

যতটুকু সুন্দর সে, তারচেয়ে চঞ্চল শতগুণ।

                        প্রেম মানুষের মনকে প্রশান্ত করে, জীবনের ভালোলাগার অধ্যায়গুলোকে চোখের সামনে নিয়ে আসে, হাসতে হাসতে বাঁচতে শেখায়। মানুষ প্রেমে পড়লে নিষ্পাপ শিশুদের মতো হয়ে যায়, কঠিন বিষয়গুলোকে সহজ করে ভাবতে শিখে, অন্ধকারেও আলোর রেখা দেখতে পায়।

প্রেম হয় স্বর্গীয়, রঙধনুর মতো রঙিন। প্রেম মানুষের মনকে উন্নত করে। একমাত্র প্রেমই পারে মানুষকে সর্বোচ্চ সুখের সন্ধান দিতে। জীবনের রঙ চেনার জন্য প্রেম করা দরকার। প্রেম জীবনকে গল্পের মতো করে সাজিয়ে তোলে। আমিও প্রেমে পড়েছি।

সুমনা আমার জীবনে আসার পর থেকে আমার জীবনটা বদলে যেতে লাগলো। আমি ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছি প্রায় ৩০মিনিট ধরে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি মানুষের মনকে রোমান্টিক করে তোলে। মনের ভেতরের আবেগকে জাগিয়ে দিতে এক ফোঁটা বৃষ্টিই যথেষ্ঠ। নদীর জলে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে আর নদীর সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সুমনা টমটম থেকে আমার সামনে নেমে দাঁড়ালো। ততক্ষণে হালকা অন্ধকার নেমে এসেছে। দূর থেকে আবছা আবছা লাইট জ্বলে উঠছে।

বৃষ্টির জল, সন্ধ্যার অন্ধকার আর লাইটের ঝাপসা আলো সুমনাকে আরো বেশি সুন্দর করে তুলেছে। এ যেন বিলের মাঝে ফোঁটা লাল পদ্মফুল, যার সৌন্দর্যে পুরো বিলটাই সুন্দর হয়ে উঠেছে। সুমনার সৌন্দর্যেই আজকের বৃষ্টি এতো সুন্দর। মনেহচ্ছে এইমাত্র আসমান থেকে একটা পরী নেমে এলো আমার সামনে। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওর দিকে।

‘কী দেখছো এভাবে? আমাকে নতুন দেখছো মনেহয়?”

‘তুমি আমার কাছে সবসময় নতুন। প্রতিদিনের সকালের মতো তুমি সুন্দর আমার কাছে। আমার জন্ম হয়েছে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য।”

‘হয়েছে, বলতে হবে না আর। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না। আম্মুর জন্য ঔষধ কিনতে এসেছিলাম। বেশি দেরি করলে আম্মু বকা দেবে। আর বৃষ্টিও পড়ছে। তুমি ছাতা আনোনি কেন?”

‘আমার খুব ইচ্ছে তোমার সাথে ভেজার।”

‘ইচ্ছেপূরণ করতে গিয়ে গায়ে জ্বর বাধাবে।”

‘তোমার সাথে ভেজার জন্য জ্বরতো অনেক কম, মরে যেতেও রাজি আমি।”

‘চুপ। আর কখনো এমন অলক্ষণে কথা বলবে না।”

আসার সময় একটা সাদা গোলাপ নিয়ে এসেছিলাম, সেটা পকেটে লুকিয়ে রেখেছি। পকেট থেকে গোলাপটা বের করে সুমনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে গোলাপ আর প্রেমপত্রটা দিলাম।

‘প্রিয় সুমনা,

তুমি হীরার মতো উজ্জ্বল নও, পূর্ণিমার চাঁদের মতো সুন্দর নও, রঙধনুর মতো রঙিন নও, তুমি তোমার মতো। তুমি পরীদের মতো নও, তুমি আমার মনের মতো। তুমি চঞ্চল, তুমি দুরন্ত, এই তুমিটাকেই ভালোবাসি। জানি না কতোটা ভালোবাসি, জানি না পৃথিবীর অন্যসব মানুষের মতো করে ভালোবাসতে জানি কী না, জানি না এই ভালোবাসায় তোমার পোষাবে কী না, শুধু এইটুকু জানি, আমার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে তোমাকে ভালোবাসি।

আজকাল আমার ধমনী, শিরার প্রতিটি রক্তকণা তোমার ভালোবাসায় প্রবাহিত হয়, তোমাকে ভালোবেসে আমার ফুসফুস প্রতিটা নিঃশ্বাস গ্রহণ করে। আমার ভালোবাসা কবিতার মাধ্যমে বর্ণনা দেওয়ার মতো নয়, গান গেয়ে প্রকাশ করার মতো নয়, আমার ভালোবাসা ঝিনুকের বুকে লুকিয়ে থাকা মুক্তোদানার মতো। আমি সুন্দর করে ভালোবাসার কথা লিখতে পারিনি হয়তো, তবে আমার হৃদয়ের আবেগটুকু বুঝে নিও। আমার হৃদয়জুড়ে শুধু তুমিই আছো। এই ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই, এই ভালোবাসা পবিত্র, এই ভালোবাসা বিশুদ্ধ। জীবনের সুখ-দুঃখগুলো তোমার সাথে ভাগ করে নিতে চাই। ভালোবাসি তোমাকে।

তোমার প্রেমে মগ্ন

সেলিম।”

‘হা হা হা। গাধা একটা। সাদা গোলাপ দিয়ে কেউ প্রপোজ করে? মানুষ প্রপোজ করে লাল গোলাপ দিয়ে কত সুন্দর করে কাব্যিক হয়ে। তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না।”

‘লাল গোলাপ পাইনি যে, সরি।”

‘আচ্ছা মন খারাপ করতে হবে না। দুষ্টুমি করলাম আমি। ভালোবাসার কথা বলতে হয় না। চোখ দেখে বুঝে নিতে হয়। মানুষের চোখ তার মনের কথা বলে দেয়। বুঝেছো?”

‘কিন্তু আমিতো চোখের ভাষা পড়তে জানি না।”

‘কিভাবে জানবে? তুমি তো একটা গাধা। আমিও তোমাকে ভালোবাসি।”

সুমনার মুখে কথাটা শোনার পর আমার পায়ের নখ থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত আনন্দে নাঁচতে লাগলো। হাতের কেশগুলো মনেহয় নৃত্য করছে। চোখমুখ আনন্দে নাঁচছে। আজকের এই মুহুর্তটা আমার জীবনের সেরা মুহুর্ত। এই একটা মুহুর্তের জন্যেই আমার এতদিনের অপেক্ষা।

‘ঐ গাধা। এতো খুশি হওয়ার কী আছে? আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। আমি যাই এবার?”

‘তোমার হাতটা ধরতে খুব ইচ্ছা করছে আমার।”

‘আহা! শখ কতো? ভালোবাসি বলার সাথেসাথে তার আবার হাত ধরতে হবে।”

‘প্লিজ।”

‘ধরতে দিতে পারি, কিন্তু এক শর্তে?”

‘কী শর্ত?”

‘তুমি আমার হাত যতক্ষণ ধরে থাকবে, ততক্ষণ আমি তোমার হাতে চিমটি দেবো অনেক জোরে। দেখি চিমটির ব্যাথা সহ্য করে কতক্ষণ আমার হাত ধরে রাখতে পারো।”

‘আমি রাজি।”

আমি সুমনার হাতে হাত রাখলাম। ওর কোমল হাতে আমার হাত রাখতেই আমার মনটা কেমন যেন আনন্দে নেচে উঠলো। মানুষের জীবন এতো রঙিন হয় সেটা সুমনা আমার জীবনে না এলে আমি জানতাম না। সে খুব জোরেই চিমটি দিল, আর আমিও ওর হাতটা ধরে আছি। একটু পরে আমার হাত দিয়ে রক্ত বের হয়ে এলো। সে চিমটি থামালো। আমি তখনো ওর হাত ধরে আছি। সুমনার চোখ দিয়ে জল বেয়ে পড়লো। মেয়েরা কাঁদলে যে এতো সুন্দর লাগে আমি আগে কখনো খেয়াল করিনি। জলেভরা চোখগুলো সুমনাকে মায়াবতী করে তুললো। আমি ওর চোখের জল মুছে দিলাম। সে আমার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।

‘আচ্ছা তোমার দেরী হয়ে যাবে। টমটম ডাকি?”

‘হুম।”

আমি একটা টমটমের বাচ্চা থামালাম। সুমনা ছোট টমটমগুলোকে টমটমের বাচ্চা বলে।

                         জাবিররা কাল ওদের নিজেদের এলাকায় চলে যাবে। না, বাসায় মেনে নেয়নি ওদের এখনো। তবে ওরা নিজেদের জীবনটাকে গুছাতে চায়। এখানে পড়ে থাকলে ওদের সন্তানদের কী হবে সেটা ভেবে ওরা চলে যাচ্ছে। এক রুমের একটা বাসাও নাকি ঠিক করেছে। আপাতত ঐখানে থাকবে।

 পরে বাসা পাল্টাবে। আজ রাতে ওদের বাসায় বিরিয়ানির আয়োজন করা হয়েছে। জোহরা খুব ভালো বিরিয়ানি রান্না করে। আমরা সবাই আবার একত্রিত হয়েছি ওদের বিদায় উপলক্ষে। আমি, হাবিব, জাবির আর মিনার আলীকদম স্টেশনে শাওনের জন্য অপেক্ষা করছি। সে এখনো আসেনি।

সে এলে আমরা সবাই একসাথে মারায়ং তং মেলায় যাবো। এই মেলা মারায়ং তং জাদীতে প্রতিবছর মাঘ মাসে আয়োজন করা হয়। এই এলাকার বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের জন্য এটা অনেক বড় একটা উৎসব। মারায়ং তং জাদী আলীকদম থেকে প্রায় ১৬৫০ ফুঁট উঁচুতে। প্রায় দেড় ঘণ্টার হাঁটার পথ। হাঁটতে একটু কষ্ট হলেও চূড়ায় উঠার পর মনটা একদম প্রশান্ত হয়ে যায়। চোখ দুটো বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিলে পৃথিবীর বিশুদ্ধ বাতাসটুকু পাওয়া যায় এখানে।

আমি আজ চোখ বন্ধ করতেই সুমনার চেহারাটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। মেয়েটা আমার চারপাশে থাকে সবসময়। যখন যেখানেই যাই সেখানেই তার অস্তিত্ব থাকে। মেয়েটার মায়ায় জড়িয়ে আছি আমি। একেই হয়তো প্রেম বলে।

মারায়ং তং পাহাড়ের এই বিশুদ্ধ বাতাসের চেয়ে আমাদের প্রেম আরও বেশি বিশুদ্ধ, আরও বেশি সবুজ। ভালোবাসায় অন্যরকম এক শক্তি আছে, যা মানুষকে বদলে দেয়। আমার নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে আমি সুমনার অনুভব পাই আজকাল। আজকের আকাশটা অসাধারণ সুন্দর। জ্যোৎস্নার আলোতে সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। শীতের কুয়াশার কারণে কিছুটা ঝাপসা হলেও বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চারপাশ। শীতের কনকনে ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে মেলায় এসেছে হাজার হাজার মানুষ। মেলাটা বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের হলেও সব ধর্মের মানুষ এখানে এসেছে।

উৎসব কী আর ধর্ম মানে? আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। জ্যোৎস্নার আলোতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার বেশ ভালো লাগে। জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য যে একবার দেখেছে সে বারবার দেখতে চাইবে। এখন যদি আমার পাশে সুমনা থাকতো, কতো ভালো লাগতো। দুইজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্না দেখতে পারতাম।

সুমনা পাশে থাকলে হয়তো আমি আকাশ না দেখে সুমনার দিকেই তাকিয়ে থাকতাম। জ্যোৎস্নার আকাশ সুমনার চেয়ে সুন্দর নয়। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সুমনাকে ফোন করলাম।

‘কেমন আছো, সেলিম?”

‘জানি না।”

‘কেন? কোনো সমস্যা?”

‘ভালো, খারাপ থাকা মনের উপর নির্ভর করে। আমার মনটা যে তোমার কাছে। তুমিই বলে দাও আমি কেমন আছি।”

‘ইশশ! এতো ঢং করতে হবে না। কী করছো?”

‘জ্যোৎস্না দেখছি। মারায়ং তং এসেছি।”

‘মেলায় গেছো। সামনের বছর আমাকেও নিয়ে যেও সাথে। তোমার সাথে দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্না দেখবো।”

‘জ্যোৎস্নার চেয়ে তুমি অনেক বেশি সুন্দর।”

‘হয়েছে। বলতে হবে না আর।”

আমরা রাত ১০টায় বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। বাসায় জোহরা আমাদের জন্য বিরিয়ানি রান্না করেছে। আমরা সবাই মিলে একসাথে বিরিয়ানি খেতে খেতে আড্ডায় মেতে উঠলাম। এভাবে আর আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হবে কিনা কী জানি। সুন্দর সময়গুলো খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। কাল থেকে এখানে আমি একদম একা হয়ে যাবো। শাওন, কোরবান আলী চলে যাওয়ার পর এবার জাবিররা চলে যাচ্ছে। রয়ে যাচ্ছি শুধুই আমি। জানি না সময়গুলো কিভাবে কাটবে। কাল থেকে একা একা থাকতে হবে ভাবতেই মনটা মোচড় দিয়ে উঠছে। আসলেই জীবন কখনো মনের মতো হয় না, মনকে জীবনের মতো করে নিতে হয়।

                     পাহাড়ের মাঝখানে মাতামুহুরির উপর দিয়ে নৌকা এগিয়ে চলছে। আমার পাশে সুমনা বসে আছে। সে শাড়ি পড়েছে, নীল শাড়ি। নীল শাড়িতে তাকে অপূর্ব লাগছে। কিছু সৌন্দর্য প্রকাশ করার ভাষা থাকে না। নীল শাড়িতে সুমনার সৌন্দর্য ঐরকম। সে হাত দিয়ে পানি ছুড়ে মারছে আমার দিকে। একটু পরপর গালে টোল পড়া হাসি দিয়ে আমাকে পাগল করে দিচ্ছে।

‘আচ্ছা আমরা যদি আজীবন এভাবে নৌকায় থেকে যেতে পারতাম, ভালো হতো না?”

‘ধুর গাধা। নৌকায় থাকা যায় নাকি। “

‘তুমি আমার পাশে থাকলে আমি যেকোনো জায়গায় থাকতে রাজি।”

‘এতো ভালোবাসো?”

‘অনেকবেশি ভালোবাসি।”

‘ঐ যে নদীর পাড়ে হলুদ হলুদ, ঐগুলো কী ফুল?”

‘অলকানন্দা। তোমার খোপায় অনেক সুন্দর লাগবে ফুলটা। “

‘এনে দাও না।”

আমি নৌকা থামিয়ে সুমনার জন্য অলকানন্দা নিয়ে এলাম। সত্যিই অলকানন্দা ফুলটা হয়তো সুমনার খোপার জন্যেই ফুটেছে। কালো চুলের ভেতর হলুদ অলকানন্দা, সাথে বিকেলের মিষ্টি রোদ।

‘আমি কাল ভাইয়ার বাসায় যাবো, কক্সবাজার।”

‘কী বলো? তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার অনেক কষ্ট হবে।”

‘ধুর বোকা। আমি কী চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছি নাকি। কয়েকদিন পর চলে আসবো। না গেলে ভাইয়া রাগ করবে।”

‘তুমি তো ভাইয়ার বাসায় গেলে ফোনে কথাও বলতে পারো না। ভাইয়াকে অনেক ভয় পাও তুমি।”

‘হুম। কয়েকদিন পরেই চলে আসবো।”

‘আচ্ছা তুমি আমাকে কখনো ছেড়ে চলে যাবে না তো? আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।”

‘হঠাৎ এই কথা কেন বলছো?”

‘জানি না। ভালোবাসি।”

‘আমিও অনেক ভালোবাসি তোমাকে। আচ্ছা চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি।”

‘কাউকে না জানিয়ে?”

‘হ্যাঁ। জানালে যদি আমাদের পরিবার মেনে না নেয়?”

‘পরিবারের সবাই অনেক কষ্ট পাবে। আমরা পারিবারিকভাবেই বিয়ে করবো, দুই পরিবারের সম্মতিতেই। তুমি চিন্তা করিও না।”

‘আচ্ছা আমার যদি অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যায়, তুমি থাকতে পারবে?”

‘আমি বাঁচবো না তোমাকে ছাড়া।”

‘আমিও তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।”

                        সুমনার সাথে বেশ কয়েকদিন থেকেই কথা হচ্ছে না। সে ভাইয়ের বাসায় থাকলে বেশ চাপে থাকে, তাই কথা বলতে পারে না তেমন। এদিকে জাবিররাও চলে গেছে। সবমিলিয়ে আমি বেশ একাকীত্ব বোধ করছি। সময় কাটছেই না। সময় বড় কঠিন জিনিস। আপনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ১মিনিট কাটাতেই অনেক কষ্ট হয়ে যাবে, অথচ কতো হাজার মিনিট চোখের পলকেই কেটে যায় আমাদের। একা থাকা যে কত কষ্টের তা এই কয়দিনে আমি বেশ ভালোভাবেই বুঝছি। জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহুর্ত হচ্ছে একাকীত্বের মুহুর্তগুলো।

                        করোনার কারণে এনজিওতে লোক ছাটাই করা হচ্ছে। সেই তালিকায় আমার নামটাও এসেছে। বেকারত্বের কঠিন বোঝাটা আবার মাথার উপর চলে এলো আমার। এই কষ্টটুকু ভাগ করার মতো কাউকে পেলাম না পাশে। বেকার থাকা যতোটা কষ্টের, তারচেয়ে বেশি কষ্টের হলো চাকরি হারিয়ে বেকার হওয়া। এই পৃথিবীতে বেকারদেরকে সবচেয়ে নিচুস্তরের প্রাণী মনে করা হয়। এই কঠিন সময়ে সুমনা আমার পাশে থাকলে বেশ ভালো হতো। তার সাথে কষ্টগুলো ভাগ করে নিতে পারতাম।

আমার সব কষ্টের উপশম হচ্ছে সুমনা। সে সামনে থাকলে আমাকে কখনো কষ্ট ছুঁতে পারে না। জানি না মেয়েটার মাঝে কী এমন যাদু আছে। কিসের পরশে সে আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয় জানি না। সে যখন পাশে থাকে আমি শুধু তার কথাই ভাবতে পারি। পৃথিবীর অন্য কোনো বিষয় তখন আমার মাথায় ধরে না। সে যখন পাশে থাকে মনেহয় পৃথিবীতে আমরা দুইজন মানুষই আছি, আর কেউ নেই। সময়ের সাথেসাথে ওর প্রতি আমার ভালোবাসাটা বেড়েই চলেছে। আমি বেশ কয়েকবার ওকে ফোন করেও পেলাম না। হয়তো ভাইয়ের বাসায় কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না। কয়েকদিন পরেই চলে আসার কথা সে। অথচ প্রায় পনেরদিন হয়ে গেল। এই পনেরদিনে কথাও বলতে পারিনি তার সাথে। কোনো বিপদ হলো কিনা, সেই চিন্তাও আসে মনে। অবশ্য সে ভাইয়ের বাসায় থাকলে কথা বলতে সমস্যা হয় সেটা আমাকে অনেকবার বলেছে। ভাইয়ের বউ ওকে সবসময় চোখেচোখে রাখে।

                           চাকরি চলে যাওয়ায়, আলীকদম থাকার সুযোগটাও নেই। বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। এদিকে প্রায় এক মাস হয়ে গেলো সুমনার সাথে যোগাযোগ হচ্ছে না। জানি না সে কেমন আছে। কিছুটা হতাশার মধ্যেই সময় যাচ্ছে আমার। সে এতোদিন থাকার কথা না ভাইয়ের বাসায়। ওর সাথে অন্য কোনোভাবে যোগাযোগ করারও সুযোগ নেই। ফোন দিলে রিসিভ করে না। কী হলো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। আমি ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। চিরচেনা সেই বাড়ি, বেকার সেলিমের বাড়ি। মানুষের খোঁচা দেওয়া কথাগুলো আজকাল আমার সয়ে গেছে। এসব নিয়ে চিন্তা করি না। আমার চিন্তা হয় আমার বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে। উনার পেনশনের টাকায় আবার চলতে হবে। একটা বছর আমার চাকরির টাকায় সংসারটা মোটামুটি ভালোই চলেছে। কিন্তু এখন কিভাবে চলবে সংসার। চাকরি চলে গেছে সেটা এখনো বাড়িতে জানাইনি। বলতে গেলে এখনো কেউ জানে না চাকরি চলে যাওয়ার ব্যাপারটা। জানালে সবার আগে সুমনাকে জানাতাম। কিন্তু ওর সাথে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি না। সন্ধ্যার আঁধারকে পাশ কেটে আলীকদম জিপ সার্ভিস থেকে জিপ ছুঁটে চলেছে। জীবনের ক্লান্তিভরা সময় নিয়ে আমি বসে আছি জিপে। এই জিপেই সুমনার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। আলীকদম জিপ সার্ভিস আমার জীবনের বড় একটা অংশ হয়ে গেল। সুমনার সাথে দেখা না হলে আমি জীবনের এতো সুন্দর রূপ কখনো দেখতাম না। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ সুমনার ফোন এলো মোবাইলে। আমার মনটা আনন্দে মোচড় দিয়ে উঠলো। মেয়েটার সাথে আমার কেমন যেন একটা হৃদয়ের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। আমার খারাপ সময়গুলোকে তাড়িয়ে দিতে সে চলে আসে।

‘কেমন আছো, সেলিম?”

‘ভালো ছিলাম না। এখন বেশ ভালো আছি।”

‘কী হয়েছে? মন খারাপ কেন?”

‘দেখা হলে বলবো। এতোদিন পর ফোন দিলে তুমি?”

‘ভাইয়ের বাসায় অনেক ঝামেলার মধ্যে ছিলাম।”

‘এখন তুমি কোথায়?”

‘চকরিয়া।”

‘কী বলো? আমিওতো চকরিয়া যাচ্ছি, জিপে এখন। সেই জিপটাতে, যেটাতে আমাদের পরিচয় হয়েছিলো।”

‘এখনতো সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। দেখা করলে দেরী হয়ে যাবে না?”

‘শুধু তোমাকে একবার দেখবো।”

‘আচ্ছা আসো। কতক্ষণ লাগবে তোমার?”

‘এইতো কাছাকাছি আমি।”

‘আচ্ছা।”

জীবনের কষ্টগুলো ভাগ করার জন্য হলেও একজন প্রেমিকা দরকার সবার। সুমনা আমার জীবনে এসেছে বসন্ত হয়ে। আমার এই বসন্ত আজীবন লেগে থাকুক এই প্রার্থনাটুকুই করি সৃষ্টিকর্তার কাছে। ওর জন্য চিঠি লেখা হয়নি। দেখা হলে প্রথমেই চিঠি চাইবে সে। নয়তো গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। গাল ফুলিয়ে থাকলে ওকে অন্যরকম সুন্দর লাগে। সে হাসলেও সুন্দর, কাঁদলেও সুন্দর, রাগ করলেও সুন্দর। একটা মেয়েকে যে সবসময় সুন্দর লাগতে পারে সেটা ওর সাথে দেখা না হলে আমি জানতে পারতাম না। হাতে বেশিক্ষণ সময় নেই। আমার ব্যাগে সবসময় খাতা কলম থাকে। আমি ব্যাগ থেকে খাতা কলম বের করে লিখতে শুরু করলাম। আমার পাশে বসা যাত্রী অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছি। অবশ্য সেদিকে নজর দেওয়ার মতো সময় আমার নেই।

“প্রিয় সুমনা,

ভালোবাসা নিও। তুমি আমার জীবনে এসেছো স্বপ্নচারিণী হয়ে। তুমি না এলে আমার জীবন কখনো পূর্ণতা পেত না। এই একটা মাস তোমাকে ছাড়া কাটাতে অনেক কষ্ট হয়েছে। তুমি নিরূপায় হয়েই হয়তো কথা বলতে পারোনি সেটা আমি জানি। তারপরেও হৃদয়কে তো আর মানানো যায় না। প্রতিটা মুহুর্তে তোমাকে অনেক বেশি মিস করেছি। দূরত্ব মানুষের ভালোবাসা বৃদ্ধি করে। অবশ্য তুমি আমার মন থেকে কখনো দূরে নও। আমি তোমাকে সবসময় আমার বুকের সবচেয়ে দামী জায়গাটাতে লালন করি। গতমাসে আমার চাকরিটা চলে গেছে। তাই আজ বাড়ি ফিরছি নিরূপায় হয়ে। মনটা যখন খুব বেশি বিষণ্ণ, তখন তুমি ফোন দিলে। আমার কঠিন সময়গুলোতে এভাবেই ফিরে এসো বারবার। আজীবন এভাবে আমার চারপাশ রঙিন করেই থেকো।

ইতি

তোমার সেলিম।”

চিঠি লেখা শেষ হতে না হতেই ধপাস করে আওয়াজ হয়ে গাড়ির চাকাটা বসে গেল। আমরা এখনো হাঁসের দিঘী। আমি চটফট করে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে অন্য গাড়িতে উঠার চেষ্টা করলাম। একটাও খালি গাড়ি আসছে না। এদিকে সুমনা বারবার ফোন দিচ্ছে। অবশেষে একটা টমটমের বাচ্চা পেলাম। সেটাতে চেপে বসলাম। কিছুটা দেরী হয়ে গেল চকরিয়া পৌঁছাতে। চকরিয়া পৌঁছে সুমনাকে ফোন দিয়ে ফোন বন্ধ পেলাম। মেয়েটা হয়তো রাগ করে ওর চাচার বাসায় চলে গেছে। পাশেই নাকি ওর চাচার বাসা। কিন্তু আমি চিনি না। চিনলেও চাচার বাসায় যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেননা সেটা ওর চাচা খারাপভাবেই নেবে। আমি প্রায় ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম ওর জন্য। যতবার ফোন দিচ্ছি ওর মোবাইল বন্ধ পাচ্ছি। অবশেষে আমি বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

                          সকালে ঘুম থেকে উঠেই সুমনাকে ফোন করলাম। ওপাশ থেকে গভীর রাগাক্রান্ত কণ্ঠে সে বলে উঠলো,

‘তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই। আমি তোমাকে চিনি না। আর কখনো ফোন দেবে না আমাকে।”

‘আচ্ছা দেবো না। কিন্তু একটা কথা বলার ছিল। সেটা বলে রেখে দেই?”

‘না, কোনো কথা বলার দরকার নেই।”

‘একটা শব্দ শুধু। বেশিক্ষণ লাগবে না।”

‘আচ্ছা বলো। এরপর আর কথা বলবো না তোমার সাথে।”

‘ভালোবাসি।”

‘ভালোবাসি না আমি।”

‘আমি ভালোবাসি।”

‘তোমার মনে হচ্ছে না তুমি বাড়াবাড়ি করছো?”

‘হ্যাঁ, মনেহচ্ছে।”

‘ফোন রাখো এইবার।”

‘আচ্ছা রাখছি।”

‘রাখছি মানে কী?”

‘তুমি না বললে, কথা বলবে না।”

‘বলেছি বলে রেখে দিতে হবে নাকি। যাও কথা বলতে হবে না।”

‘তোমার জন্য চিঠি লিখেছি যে সেটা দিতে পারিনি।”

‘আচ্ছা দেখা করবো। তখন দিও।”

‘কখন দেখা করবে?”

‘কাল বিকালে।”

‘কোথায় দাঁড়াবো?”

‘ব্রিজে। মোট দুইটা চিঠি আনবে। একটা গতকালের, আরেকটা আগামীকালের। নয়তো আর কখনো কথা বলবো না।”

‘আচ্ছা আনবো।”

‘তুমি এতো ভালো কেন?”

‘তুমি ভালোবাসো বলে।”

‘সারাজীবন এভাবে ভালোবাসবে?”

‘তোমাকে ভালোবাসার জন্যেইতো আমার জন্ম হয়েছে।”

‘ভালোবাসি।”

সকাল সকাল মোবাইলের রিংটোন শুনে ঘুম ভাঙলো। সুমনা বেশ কয়েকবার ফোন করেছে। সে এতো সকাল সকাল ফোন করে না। এই সময়ে সে ঘুম থাকার কথা। ভাবতে ভাবতেই অচেনা আরেকটা নম্বর থেকে ফোন এলো।

‘হ্যালো, আমি সুমনা বলছি।”

‘এতো সকাল সকাল ফোন করলে যে।”

ওপাশ থেকে সুমনার কান্নারত কণ্ঠ ভেসে এলো। আমার বুকটা ধপ করে উঠলো। হঠাৎ ভূমিকম্প হলে মাটি, দালান সবকিছু যেভাবে কেঁপে উঠে সেভাবে আমার বুকটা কেঁপে উঠলো।

‘আমি বড় একটা সমস্যায় পড়েছি। তোমার হেল্প দরকার আমার।”

‘কী হয়েছে তোমার? সব ঠিকঠাক আছে? কাঁদছো কেন?”

‘একটা ছেলের সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। ছেলেটা গতকাল আমাদের বাসায় এসেছে। ভাইয়াও এসেছে। আমাদের ব্যাপারটা কিভাবে যেন ওরা জেনে গেছে।

বাসায় আমাকে খুব বকাবকি করছে। আমি বাসায় বলেছি, তুমি আমার বান্ধবী নিশাতের প্রেমিক। তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য আমি তোমার সাথে চ্যাট করেছি। নিশাতের অনুরোধ রাখার জন্যেই এসব করেছি আমি।”

‘কী বলছো এসব? নিশাতটা কে? আর কোন ছেলে এসেছে তোমাদের বাসায়? আর তোমার বিয়ে ঠিক হলো কখন?”

‘আমি তোমাকে পরে সবকিছু বুঝিয়ে বলবো। এখন আমি খুব বিপদে আছি। তুমি আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো প্লিজ। যদি তোমাকে আমার ভাইয়া ফোন করে তাহলে আমি যেভাবে বলেছি ঐভাবেই বলিও। আমাদের সম্পর্কের কথা যেন না জানে। জানলে অনেক বড় সমস্যা হবে। এইটুকু হেল্প করো প্লিজ।”

‘হুম।”

‘আচ্ছা শুনো, আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিও প্লিজ। আর আপাতত আমাকে ফোন দিও না তুমি। আমি পরে ফোন দেবো তোমাকে।”

‘হুম।”

‘ক্ষমা করেছো?”

‘হুম।”

আসলে ওর কথাগুলো শুনে কী বলবো বুঝতেই পারছিলাম না। হঠাৎ কী এমন হলো যে এসব বলছে সে। নাকি আমার সাথে দুষ্টুমি করছে কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে কেন যেন বুকের কাঁপুনিটা বাড়তে লাগলো আমার। মাথার ব্রেণ কাজ করছে না বললেই চলে। কার সাথে ওর বিয়ের কথাবার্তা ঠিক ছিল? আমি তো কিছুই জানি না। হয়তো সে দুষ্টুমিই করছে। যদি দুষ্টুমি না হয়ে কথাগুলো সত্য হয়? দুষ্টুমি করলে এভাবে কান্না করার কথা না।

ওর কান্নার শব্দ এখনো আমার কানে লেগে আছে। মনেহচ্ছে আমার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। এখন আমার কী করা উচিৎ? সুমনাকে আবার ফোন দেবো? সে তো ফোন করতে মানা করলো। ফোন করলে যদি কোনো সমস্যা হয়? নাকি ওদের বাসায় চলে যাবো? হয়তো ওর ভাইয়া ওকে চাপ দিয়ে এসব বলতে বাধ্য করেছে। ওদের বাসায় গিয়ে ওর ভাইয়ার সাথে কথা বলবো? কিন্তু আমার মতো একটা বেকারকে মেনে নেওয়ার কোনো চান্স দেখছি না। আর তাছাড়া সুমনা বলেছে আমি ওর বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড। সে এসব কেন বললো? আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।

                       আমার সুন্দর সকালগুলো, মিষ্টি বিকেলগুলো হঠাৎ করে সুমনার সাথে হারিয়ে গেল টের পাওয়ার আগেই। আমি কখনো ভাবিনি এভাবে সে চলে যাবে। আমিতো তাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেঁধে রাখার জন্যেই ভালোবেসেছিলাম। বিচ্ছেদে ভালোবাসা গাঢ় হয়। সেদিনের পর থেকে ওর প্রতি ভালোবাসা আরো বেড়ে গেছে। এমন মনে হচ্ছে যে, ওকে ছাড়া হয়তো আমার আর বেঁচে থাকা হবে না। সামনে যা কিছু দেখছি সবকিছুতেই সুমনার ছবি ভাসছে। রাস্তা দিয়ে নিকাব আর বোরকা পড়া কোনো মেয়ে হেঁটে গেলে তার চোখ দেখে মনেহচ্ছে এইতো সুমনার চোখ। হাজারো মানুষের ভিড়ে আমি শুধু তাকেই খুঁজছি। জীবনটা যে একজন মানুষের ভেতরেই আটকে যাবে সেটা সুমনা চলে না গেলে বুঝতাম না। তবে আমার এখনো মনেহচ্ছে সে হয়তো ফিরে আসবে। ওর ভাইয়ার চাপে সে হয়তো এসব বলেছে। আমি বিভিন্নভাবে ওর খবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কারও মাধ্যমে তার খবর পাচ্ছি না।

ভয়ে ফোন করতেও পারছি না, কী জানি কোন বিপদে পড়ে আবার সে। কিছুক্ষণ পরপর আমি শুধু মোবাইল হাতে নিচ্ছি আর সুমনার ফোন আসে কিনা দেখছি। একেকটা সেকেন্ড আমার পুরো কলিজাটাকে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে যাচ্ছে। ওর স্মৃতিগুলো খুব বেশি কাঁদাচ্ছে আমাকে। ওকে যতটা না মিস করছি তারচেয়ে বেশি মিস করছি ওর সাথে কাটানো সময়গুলো আর তার চঞ্চলতা।

যদি সে আবার ফিরে আসে তবে আমি তাকে আর কখনো যেতে দেবো না। আমার ইচ্ছা করছে উড়ে ওর কাছে চলে যায়। আমার পাশে এখন শুধু তাকেই প্রয়োজন।

আশেপাশের কারও কোনো কথা আপাতত আমার মাথায় ঢুকছে না। জীবনটা হঠাৎ করে এতো বড় ধাক্কা খাবে আমি কখনো কল্পনাও করিনি। তারচেয়ে করোনায় যদি মরেই যেতাম তাহলে অনেক ভালো হতো।

অন্তত আজকের দিনে আমাকে কাঁদতে হতো না। সুমনাকে ছাড়া একটা মুহুর্ত কাটানো জনশূন্য দ্বীপে একটা যুগ কাটানোর মতো মনে হচ্ছে। আবার সুমনার উপর রাগও হচ্ছে। সে কেন এমন করলো। আমি তো ওকে কম ভালোবাসিনি। বাসায় চাপ দিলে সে অন্তত আমার কথা বলতো।

আমাকে সে যদি বলতো, ‘আমি তোমাকে চাই সেলিম। তুমি আমাকে নিয়ে যাও।” আমি যে করেই হোক ওকে নিয়ে আসতাম। ওকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা আমার কাছে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে অন্তত একবার বলতো আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে  না। আমি জানি আমাকে ছাড়া সে ভালো নেই। অনেকবেশি ভালোবাসে আমাকে সে। ওর চোখে আমার জন্য যেই ভালোবাসা দেখেছি সেটা এতো সহজে মুছে যাওয়ার কথা নয়। সে হয়তো আমার কাছেই ফিরে আসবে, আবার আমার জীবনটাকে রাঙিয়ে দিতে। এবার সে ফিরে এলে আমি অনেকবেশি ভালোবাসবো আর তার সব আবদার আমি পূরণ করবো।

                            আজ শাওনের বিয়ে। অবশেষে তার একাকীত্ব কাটলো। আমাকে গতকাল বিকালে হঠাৎ করে ফোন দিয়ে বিয়েতে আসার নিমন্ত্রণ দিলো। সবকিছু নাকি হুটহাট করেই হয়েছে। তাই আগে জানাতে পারেনি।

আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে বিয়ে করছে। আমরা সবাই তার ব্যাচেলর জীবন নিয়ে সবচেয়ে বেশি মজা করতাম। অবশেষে সেও বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছে। আমি জোহরা আর জাবিরের জন্যে অপেক্ষা করছি। ওদেরকে নিয়ে একসাথে বিয়েতে যাবো। বিয়েতে তেমন কোনো আয়োজন করা হয়নি। কনের ঘরে ছোটোখাটো আয়োজন। জাবির আর জোহরার ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। জোহরা মেয়েকে কোলে নিয়ে এসেছে।

মেয়েকে দেখতে নাকি দুইজনের পরিবারের সবাই এসেছে। বলতে গেলে দুইজনকে অবশেষে মেনে নিলো পরিবার। রক্তের বাঁধন ছেঁড়াতো যায় না। মেঘ কেটে গেলে যেভাবে সূর্য দেখা যায়, তেমনি অভিমান কাটলে দেখা যায় ভালোবাসা। অভিমানের পর ভালোবাসাটা আরো গাঢ় হয়। সুমনা যদি আমার সাথে অভিমান করতো তবে হয়তো একসময় আরও বেশি ভালোবাসা নিয়ে ফিরে আসতো।

কিন্তু সে কেন আমাকে ছেড়ে গেল সেই কারণটুকুও আমি জানি না। নিজেকে আজকাল পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু প্রজাতির মনেহয়। শাওনের বিয়েতে সব মানুষের ভিড়ে আমার চোখ দুটো শুধু সুমনাকেই খোঁজে চলেছে। এখানে সে থাকার কোনো প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু তারপরেও সবার চেহারায় আমি শুধু সুমনাকেই দেখছি। শাওনের বউয়ের জায়গায় আমি সুমনাকে কল্পনা করছি। আমাদেরও স্বপ্ন ছিল এভাবে ছোটোখাটো করে বিয়ে করার। জাবির আর জোহরার মেয়ের মতো আমাদেরও একটা ফুটফুটে মেয়ে থাকবে। স্বপ্নগুলো বাস্তবে পরিণত হলো না আর। জানি না দোষটা কার। কিন্তু আমার ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই, সেটুকু আমি বলতে পারি। যতটা ভালোবেসেছি মন প্রাণ উজাড় করেই বেসেছি। সেই ভালোবাসায় কোনো কৃত্রিমতা নেই। শুধু স্বপ্ন আর স্বপ্ন আছে। আমিও চেয়েছিলাম ঘর বাঁধতে রঙিন করে।

সেই ঘর জুড়ে জ্যোৎস্না থাকবে, ভালোবাসা থাকবে। আজ এই পৃথিবীর এতো বিশাল জায়গাজুড়ে আমার জন্যে এক চিমটি ভালোবাসা নেই কোথাও। বিচ্ছেদের আগুন উনুনের আগুনের চেয়ে কয়েকশত গুণ তীব্রতর। ভাঙা হৃদয় নিয়ে বেঁচে থাকা যে কত কষ্টের তা শুধু যার হৃদয় ভেঙেছে সেই জানে। সেদিন সুমনা একবার যদি বলতো, ‘তুমি আমাকে নিয়ে যাও। যতো বাঁধা আসুক, আমি শুধু তোমাকে চাই। আমি তোমাকেই ভালোবেসেছি। এই ভালোবাসায় কারও অধিকার নেই।”

আমি পুরো পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করে হলেও তাকে নিয়ে আসতাম আমার ছোট্ট ঘরে। ভালোবাসার মানুষকে ছাড়া কাটানো একেকটা দিন বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের কাটানো দিনের চেয়ে অনেকবেশি ভয়াবহ। নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে কী পারা যায়? যাকে রেখেছি হৃদয়ের সবচেয়ে সুন্দরতম জায়গাটিতে সেখানে বসেই যদি সে কাঁটার আঘাতে জর্জরিত করে হৃদয়, তবে কী বেঁচে থাকা যায়? এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্টের কাজ হলো বেঁচে থাকা। আমার জন্য হয়তো সুমনার জীবন থেমে থাকেনি, কিন্তু আমার জীবন ঠিকই থেমে গেছে ব্যাটারীবিহীন ঘড়ির মতো। এই জীবন নিশ্চল, বেদনায় ভরপুর, কান্নায় জর্জরিত, ক্লান্ত।

                        আজকাল একেকটা দিনকে একেকটা বছর মনেহয়। বিভিন্ন উপায়ে সুমনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। আর এদিকে ওর প্রতি ভালোবাসা দিনদিন কষ্টটা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওকে ছাড়া বেঁচে থাকাটাও কঠিন হয়ে গেছে আজকাল। দূরত্ব ভালোবাসা বাড়িয়ে দেয়। ওকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছি ভাবতেই চোখ দিয়ে বন্যার জল বেরিয়ে আসে। ওর জন্য চিঠি লিখতে বসলাম। জানি না, তার কাছে পাঠাতে পারবো কী না।

“প্রিয় সুমনা,

তোমাকে ছেড়ে থাকতে হবে কখনো ভাবিনি। মাঝেমাঝে তুমি রাগ করে কয়েকদিন কথা না বললে খুব কষ্ট হতো আমার, কিন্তু এই কষ্টের কাছে সেই কষ্টগুলো কিছুই না। তুমি আর কখনো আমার জীবনে ফিরে আসবে না ভাবতেই কান্না আসে। তুমি একবার আমার হাতে চিমটি দিয়েছিলে দুষ্টুমি করে, হাতে নখের দাগ বসে গিয়েছিল। হাতের সেই দাগগুলোর দিকে তাকালেই তোমার হাতের কথা মনে পড়ে। আজকাল বৃষ্টি দেখলেই কান্না আসে আমার। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে তোমার সাথে ভেজার সুযোগ আর পাবো না ভাবতেই কলিজাটা ছিঁড়ে যেতে চায়। তুমি নিজের হাতে বানিয়ে আমাকে কফি খাওয়ানোর কথা ছিল। সেই কথাটাও তুমি রাখলে না। আজকাল শুধুই অতীতে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে আমার। অতীতে ফিরে যেতে পারলে তোমাকে আমি এমন শক্ত করে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করতাম যে, তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারতে না। তুমি যখন পাশে ছিলে তখন আমার জীবনে তোমার প্রয়োজনীয়তা টের পাইনি, আজকাল তোমাকে ছাড়া প্রতিটা মুহুর্তে একাকীত্বে হারিয়ে যাচ্ছি। আজকাল আমি কাঁদলে কেউ চোখ মুছে দেয় না। আমার কান্না দেখে কেউ বলে না যে, ছেলে হয়ে কাঁদছো, ছি! ছি! তোমার সেই টোল পড়া এক গাল হাসি খুব মিস করি। জানি না তুমি আমাকে ছেড়ে কেমন আছো, হয়তো ভালো নেই। আমার মতো করে কেউ তো তোমাকে ভালোবাসবে না, সেটা আমি জানি। আজীবন আমার পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলে তুমি, রইলে না। আজকাল রাস্তায় হিজাব পড়া কোনো মেয়ে দেখলেই মনে হয়, এইতো আমার সুমনা। কিন্তু তোমার সেই সুন্দর চোখজোড়ার সন্ধান আমি আর পাই না। আজকাল আমার স্বপ্নেই শুধু আসো, বাস্তবে কেন আসো না। আমি জানি তুমি ইচ্ছা করে আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না, তুমিও হয়তো পরিস্থিতির স্বীকার। আমার সাথে সবসময় এমন কেন হয় বলো তো। তোমাকে যে বিয়ে করতে চাচ্ছে সে তো চাইলে অন্য কাউকে বিয়ে করেও সুখী হতে পারবে, আমার তো তুমি ছাড়া কেউ নেই। তোমাকে শোনাবো বলে কত কত গান শিখেছি, কিন্তু তুমিতো শুনতে এলে না আর। তোমার খুব ইচ্ছা ছিল, বাইকে আমার পেছনের সিটে বসে ঘুরতে যাবে।

তোমাকে পেছনের সিটে বসাবো বলে বাইক কিনেছি, অথচ পেছনের সিট খালি রেখে তুমি চলে গেলে। আজকাল চোখের সামনে তোমার চেহারাটাই শুধু ভাসে। তোমার স্মৃতিগুলো আমার চারপাশ ঘিরে আছে। যেদিকেই তাকাই তোমাকে দেখতে পাই। সবসময় মনেহয় তুমি পাশে আছো। আমার এলোমেলো জীবনটা দেখে তুমি হাসছো আর বলছো, ‘এই ছেলে তুমি এতো বোকা কেন? আমার মতো চালাক হতে শেখো।” আরেকটু চালাক হলে হয়তো তোমাকে ধরে রাখতে পারতাম। তোমার সাথে আর কখনো কথা হবে না ভাবতেই কান্না আসে। তোমার দেখানো রঙিন স্বপ্নগুলো দিনদিন ধূসর হয়ে যাচ্ছে। দিনদিন আমার হৃদয়টা ফেঁটে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আমি আজীবন তোমার পথ চেয়ে থাকবো। যদি কখনো সুযোগ পাও তবে ফিরে এসো আমার কুঁড়েঘরে। অনেক যত্ন করে রাখবো তোমাকে। পূর্ণিমার রাতে তোমাকে নিয়ে জ্যোৎস্না দেখবো। জানি না, এই পত্র তোমার হাতে পৌঁছাবে কিনা। তোমাকে ছাড়া আমি একদম ভালো নেই। তোমাকে ছাড়া ভালো থাকার অভ্যাস আমার নেই। ভালো থেকো, আমার ভালোবাসা।

ইতি

তোমার সেলিম।”

চিঠিটা ওর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। হয়তো সে পাবে, অথবা পাবে না। এমনও হতে পারে যে, অন্য কারো হাতে চলে যাবে এই চিঠি। তারপরেও মন মানছে না আমার। অন্য কেউ পড়লে পড়ুক, অন্তত কেউ একজন তো জানবে আমার মনের ব্যাথাগুলো। মনের কষ্টগুলো পুঁষে রাখা সম্ভব হচ্ছে না আর।

                     আজ সুমনাকে অনেকবেশি মিস করছি। অনেকদিন ওকে ফোন দেইনি, ওর বাসায় সমস্যা হবে ভেবে। আজ আর পারছি না। আজ ফোন করে বলবো, যতো সমস্যা হোক না কেন তুমি আমার কাছে চলে আসো। নয়তো আমি গিয়ে তোমার পরিবারকে বুঝিয়ে বলি। এভাবে আর পারছি না আমি। ফোন দিতেই ওপাশ থেকে একটা ছেলের কণ্ঠ ভেসে এলো। আমি ভড়কে গেলাম। হয়তো ওর মোবাইল ওর ভাইয়ার হাতে। আমি কিছুটা ভীত কণ্ঠে হ্যালো বলার চেষ্টা করলাম। গলাটা কেমন যেন ধরে এলো। সুমনা আসলেই বিপদে আছে। ভাবতে ভাবতে ছেলেটা কথা বলে উঠলো,

‘আপনি সেলিম? সুমনা আমাকে আপনার কথা বলেছে। আপনি ফোন দিয়েছেন কেন?”

‘না, মানে, ওর সাথে কিছু কথা ছিল আমার। আপনি কী ওর ভাইয়া?”

‘ভাইয়া হতে যাবো কেন? আমি ওর স্বামী। ওর সাথে কিসের কথা আপনার? এই নম্বরে আর কখনো ফোন দেবেন না। আর কখনো ফোন দিলে খবর আছে কিন্তু।”

উনার মুখে সুমনার স্বামী কথাটা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তাহলে কী এই কয়দিনে সুমনার বিয়ে হয়ে গেল? সে আমাকে একবার জানালো না ব্যাপারটা। আমাকে ছেড়ে সে বিয়ে করতে পারলো কিভাবে। কয়েকদিনের ভেতরে আমাদের এতোদিনের ভালোবাসা মিথ্যা হয়ে গেল?

‘ওহ আচ্ছা। সুমনার বিয়ে হয়েছে সেটা আমি জানতাম না। আপনাদের কী এই সপ্তাহেই বিয়ে হয়েছে?”

‘এই সপ্তাহে বিয়ে হবে কেন? আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় দুই বছর। তাছাড়া আমাদের চার বছর ধরে প্রেম ছিল।”

‘কী বলছেন এসব। সে তো কখনো বলেনি এসব।”

‘আপনাকে বলার কী আছে। আর সুমনা আমাকে সব খুলে বলেছে। আপনি ওর বান্ধবীর সাথে প্রেম করেন। ওর বান্ধবী আপনাকে পরীক্ষা করার জন্য আপনার সাথে সুমনাকে চ্যাট করতে বলেছিল। কিন্তু পরে আপনাকে ওরা সব খুলে বলেছে। বলার পরেও আপনি সুমনাকে ডিস্টার্ব করছেন। এটা কিন্তু ঠিক না। আপনি কী জানেন, আপনার জন্যে আমাদের পরিবারে অশান্তি হতে পারে?”

‘হুম। সরি।”

আমি কী বলবো বুঝে উঠতে পারছি না। আমার এখন কী বলা উচিৎ। সুমনার দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছে সেটা মেনে নেওয়ার মতো শক্তি আমার নেই। আবার লোকটাকে আমাদের সম্পর্কের কথা খুলে বলার সুযোগও নেই। যদি আমাদের সম্পর্কের কথা খুলে বলি, আর সত্যিই সুমনার দুই বছর আগে বিয়ে হয়ে থাকে তাহলে তাদের ঘর ভেঙে যাবে। আমি জেনেশুনে ভালোবাসার মানুষটার ঘর কিভাবে ভাঙবো। দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছে কথাটাও বিশ্বাসযোগ্য না আমার কাছে। কারণ সুমনা আমার কাছে এতো বড় সত্য লুকাবে সেটা আমি মেনে নিতে পারি না।

‘সম্পর্কে সৎ হওয়ার চেষ্টা করুন। আপনার প্রেমিকা থাকা সত্ত্বেও আপনি সুমনার সাথে কথা বলে অন্যায় করেছেন। আচ্ছা যাই হোক, আপনাদের রিলেশনের কী অবস্থা বলুন।”

‘ব্রেক আপ হয়ে গেছে আমাদের। আসলে আমি সৎ ছিলাম না। আমি সুমনার প্রতি দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম।”

‘যা হওয়ার হয়ে গেছে। জীবনে সবসময় সৎ থাকার চেষ্টা করবেন। আর কখনো এই নম্বরে ফোন দিয়ে সুমনাকে ডিস্টার্ব করবেন না। তাছাড়া এই সিমটা এখন থেকে আমি ব্যবহার করবো।”

‘সত্যি বলতে কী, আপনার কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি সুমনাকে যতটুকু জানি, ওর বিয়ে হয়নি। অথচ আপনি বলছেন আপনাদের দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছে। আর আপনি এতোদিন কোথায় ছিলেন?”

‘বিশ্বাস না করার কী আছে? আমি কোথায় ছিলাম এসব আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়। আপনাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করছি না। আর তাছাড়া আপনার সাথে সুমনা আপনার প্রেমিকার কথায় চ্যাট করেছে, যা আপনি জানেন এখন। সুতরাং এই বিষয়গুলো নিয়ে আর কথা বাড়ানোর দরকার নেই।”

‘আচ্ছা আমি কী সুমনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?”

‘কেন কথা বলবেন? সে আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক না বলেই আমি ফোন ধরেছি। আপনি আর কখনো ফোন না দিলে খুশি হবো।”

‘হুম।”

ফোন কাটার পর থেকে আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। কিভাবে সম্ভব এসব। তাহলে কী সুমনা আমাকে এতোবড় ধোঁকা দিলো। আমার কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। মনেহচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি। সুমনার সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছা করছে আমার। সত্যটা জানতে ইচ্ছা করছে। সে কেন আমাকে ভালোবাসা শেখালো। এখন হঠাৎ করে কী হচ্ছে এসব। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। সুমনার ব্যাপারে খোঁজ নেবো এমন কাউকেও চিনি না। আমি কখনো ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার জানতে চাইনি তেমন। ওর কোনো বন্ধুর নম্বর পেলে বিষয়টা জানতে পারতাম। সে সুযোগও নেই। অনেক চেষ্টা করলাম, বিষয়টা সম্পর্কে জানার। কিছুই বের করতে পারলাম না। সুমনা আসলেই কী আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? শেষমুহুর্তে এসে নাটক সাজিয়ে আমাকে খারাপ বানিয়ে দিলো হয়তো। কিন্তু কেন করলো এসব। আমিতো ওর চোখে ভালোবাসা দেখেছিলাম। সেই ভালোবাসা কখনো মিথ্যা হতে পারে না। মনেহচ্ছে আমার পায়ের তলার মাটি দুই ভাগ হয়ে যাচ্ছে আর আমি শতশত ফুট মাটির গভীরে হারিয়ে যাচ্ছি। চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

                       চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছি। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। সামনে জানালা।  জানালা দিয়ে তাকালে চারিদিকে অন্ধকার আর অন্ধকার। এই অন্ধকার যেন জনম জনমের। ফ্যানের বাতাসে মোমবাতিটা নিভু নিভু করছে। রুমের লাইটটা নষ্ট হয়ে গেছে, ঠিক করা হয়নি। অবশ্য আজকাল অন্ধকার আমার বেশ ভালো লাগে। রূমের বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ছিটানো কাগজ। আমি এখনো সুমনার জন্য চিঠি লিখি। জানি, এই চিঠিগুলো কখনো ওর হাতে পৌঁছাবে না। তারপরেও যখন ওর জন্য চিঠি লিখতে বসি, মনেহয় সে আমার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছে, সে হাসছে টোলপড়া গালে। জানালার পাশে বসে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে থাকা সুমনাকে দেখি। যখন রাত আসে, শুধু তখনি তাকে আমি দেখতে পাই। তাই আজকাল রাত বেশ ভালো লাগে আমার। জানালার পাশে একটা সাদা গোলাপ গাছ আছে। এই সাদা গোলাপ দিয়ে আমি সুমনাকে প্রপোজ করেছিলাম। আর এই গাছটা যেদিন কিনেছিলাম সেদিন প্রথম সুমনার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তাই গাছটা আমার ভীষণ প্রিয়। রাতে জানালার পাশে গাছটা যখন বাতাসে দোল খায়, আমার চোখে সুমনার উড়ন্ত চুল ভাসে। আজকাল আমি কাঁদতেই ভুলে গেছি। নতুন একটা জগৎ তৈরি হয়েছে আমার চারপাশে, সেই জগতে সুমনা সবসময় আমার পাশেই থাকে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মনেহচ্ছে আকাশ থেকে কেউ আগুন ছুঁড়ে মারছে। সেই আলোর রেখার মাঝেই সুমনা দাঁড়িয়ে আছে। আলোর রেখায় সুমনাকে আরও বেশি সুন্দর লাগছে। আমি মোমবাতির দিকে তাকাই, হাতে মোমবাতি নিয়ে সুমনা বসে আছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আমি তাকে কবিতা শুনাচ্ছি।

আমার হৃদয়বনের শতবর্ষী লতানো এক বৃক্ষ

সেই বৃক্ষে বাসা বেঁধেছে নাদুসনুদুস চড়ুই

চড়ুইয়ের চোখে পুরো পৃথিবী দেখা যায়

তাই আমি শুধু তার চোখেই চোখ রাখি।

এই চড়ুইটা আর দশটা চড়ুইয়ের মতো নয়

সে কথা বলতে পারে, হাসতে পারে, গাইতে পারে

আমি জানালার পাশে বসে রোজ তার গান শুনি

সে হৃদয়বৃক্ষের প্রতিটা ডালে উড়ে বেড়ায়।

চড়ুইটা মাঝেমাঝে আমার হৃদয়ে ঠোকর দেয়

বুকটা যন্ত্রণায় ফেঁটে যেতে চায়, অসহ্য যন্ত্রণা

রক্ত ঝরতে ঝরতে পুরো শরীর লাল হয়ে যায়

রক্ত না ঝরলে ভালোবাসার সুখ কোথায়?

টিনের ছালে ঝুমঝুম বৃষ্টি পড়ছে। প্রচন্ড বাতাসে টেবিলের মোমবাতিটা নিভে গেছে। টিনের ছালে বৃষ্টির আওয়াজ বেশ মাদকতাময়ী, এ যেন সুমনার নূপুরগুঞ্জন। আমি চোখ বন্ধ করে সেই ধ্বনি শুনছি। আমার চোখজুড়ে পুরো রাজ্যের ঘুম।

                          আজ হাবিব আর রাইমার গায়ে হলুদ। করোনার কারণে বড় করে প্রোগ্রাম করা হচ্ছে না। ছোটোখাটো করে নাকি অনুষ্ঠান হবে। হাবিবের গায়ে হলুদে না গেলেই নয়। যদিও আলীকদমে যেতে একদম ইচ্ছা করছে না। কারণ সেখানে সবকিছুতেই সুমনার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেই স্মৃতিগুলো আমাকে অনেকবেশি কষ্ট দেবে। আজকাল এমনিতেই মরার মতো বেঁচে আছি। এভাবে বেঁচে থাকা যে কতোটা কষ্টের সেটা যারা এই সময়গুলো পার করেছে তারাই জানে। অন্যদেরকে এই কষ্ট বুঝানো সম্ভব নয়। আমি চকরিয়া স্টেশনে আলীকদম জিপ সার্ভিসের টিকেট কেটে দাঁড়িয়ে আছি। সবার শেষে আমার সিট। আরেকটা সিট খালি। সেই সিটের টিকেট বিক্রি হলেই আমাদের গাড়ি ছাড়বে। করোনার কারণে দুই সিটে একজনকে বসানো হচ্ছে। অবশ্য দুই সিটের দাম যাত্রীকেই দিতে হচ্ছে। করোনার কারণে হলেও অন্তত এই জিপে মানুষজন কোনো রকমে বসে যেতে পারবে। এই সিটগুলোতে দুইজন করে বসালে এতো বেশি চাপাচাপি হয় যে বলার মতো না। প্রায় ৩০মিনিট ধরে বসে আছি গাড়িতে উঠে। শেষ একটা সিটের টিকেট বিক্রি হচ্ছে না। এখানের নিয়ম হচ্ছে, সব কয়টা সিটের টিকেট বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি ছাড়া হবে না। সকাল থেকে বসতে বসতে দরকার হলে সন্ধ্যা হোক, কিন্তু সব সিটে যাত্রী হওয়া চাই। সুতরাং বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। অবশেষে সেই সিটের টিকেট কাটার জন্য যাত্রী এলো এবং সে আর কেউ নয়, আমার সুমনা। আবার তার সাথে দেখা হয়ে যাবে আমি কল্পনা করিনি। নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। সে গাড়িতে উঠে আমার সামনে বসতেই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। সেও হয়তো ভাবেনি আমার সাথে দেখা হবে এভাবে। সে কিছুটা ইতস্ততবোধ করছে।

‘কেমন আছো, সুমনা?”

‘ভালো আছি। তুমি?”

‘বেঁচে আছি।”

‘এভাবে বলছো কেন?”

‘Sorry.”

‘তুমি কেন Sorry বলছো। Sorry আমার বলা উচিৎ। আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি।”

‘Sorry বলে কী হবে আর। হারিয়ে ফেলা জীবনের আনন্দগুলোকে ফিরিয়ে আনা যাবে? জীবন্ত লাশটার ভেতরে প্রাণ ঢুকানো যাবে? তুমি হয়তো আমাকে ভালোবাসোনি, কিন্তু আমার হৃদয়ে যতটুকু ভালোবাসার শক্তি আছে সবটুকু দিয়ে তোমাকেই ভালোবেসেছি। যতটুকু ভালোবেসেছি মন-প্রাণ উজাড় করেই বেসেছি। আমার ভালোবাসায় একবিন্দু ভেজাল নেই।”

‘আসলে সবকিছু এমন হয়ে যাবে সেটা আমি ভাবিনি।”

‘তুমি যে বিবাহিত ছিলে সেটাতো আমাকে জানাতে পারতে?”

‘তোমার প্রেমটা এতো নির্মল ছিল যে, আমি নেশাগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম আমি। প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম, কয়েকদিন কথা বলার পর তোমাকে সবকিছু খুলে বলবো। কিন্তু পরে একসময় মনেহলো, তোমাকে সব বলে দিলে তুমি চলে যাবে।”

‘আচ্ছা চলো না, আমরা এখন ঘর বাঁধি। যা হওয়ার হয়ে গেছে।”

‘না, সেলিম। সেটা সম্ভব না। আমি অর্ণবকে অনেক ভালোবাসি।”

‘আমাকে ভালোবাসোনি?”

‘তোমার প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল। এক ধরণের মোহ কাজ করতো। নেশাগ্রস্ত ছিলাম তোমার প্রতি।”

‘তাহলে আমার সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন, জ্যোৎস্না দেখার সাধ, সবকিছু মিথ্যা ছিল?”

‘সত্য, মিথ্যা আমি জানি না।”

‘আচ্ছা যাই হোক। আমার শেষ একটা ইচ্ছা পূরণ করবে তুমি?”

‘কী ইচ্ছা?”

‘তুমি মারায়ং তং এ গিয়ে আমার সাথে জ্যোৎস্না দেখতে চেয়েছিলে মনে আছে?”

‘হ্যাঁ।”

‘আজ তো পূর্ণিমা। আমার সাথে জ্যোৎস্না দেখতে যাবে?”

‘এতো রাতে কিভাবে সম্ভব? “

‘বেশি রাত হবে না। তাড়াতাড়ি চলে আসবো।”

‘আচ্ছা যাবো। কিন্তু এরপর থেকে তুমি আমার সাথে আর কখনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।”

‘আচ্ছা।”

                      জ্যোৎস্নার আলোতে আমি আর সুমনা দাঁড়িয়ে আছি মারায়ান তং এর সবচেয়ে উঁচুতে। আমাদের সামনেই কক্সবাজার। এখান থেকে স্পষ্টভাবে কক্সবাজার দেখা যাচ্ছে। সুমনার সাথে আমার জীবনের শেষ জ্যোৎস্না দেখার মুহুর্ত এটি। আজকের পর থেকে আর কখনো জ্যোৎস্না দেখা হবে না আমাদের।

‘যদি আজীবন তোমার সাথে এভাবে জ্যোৎস্না দেখতে পারতাম, তবে আমার চেয়ে সুখী এই পৃথিবীতে আর কেউ হতো না।”

‘সেটা তো সম্ভব না। আজকের পর থেকে তুমি আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করবে না সেই শর্তেই আমি এখানে আসতে রাজি হয়েছি।”

‘হুম। আজকেই আমার শেষবারের মতো জ্যোৎস্না দেখা।”

‘মানে?”

‘তুমি ছাড়া জীবনটাতে আলো কিভাবে ঢুকবে আর। তোমাকে ছাড়া চারিদিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন আমার জীবন।”

‘এভাবে বললে কিভাবে হবে? তুমি অন্য কারও সাথে তোমার সবকিছু শুরু করো আবার।”

‘আমি জীবনে একজনকেই ভালোবেসেছি। এই জীবনে অন্য কারও জায়গা নেই। আমার প্রেম বিশুদ্ধ, জ্যোৎস্নার আলোর মতোই স্বচ্ছ, মারায়ং তং এর মতো বিশাল।”

‘আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমার কাছে ফিরে আসার কোনো সুযোগ আমার নেই।”

‘আমার হাতটা একটু ধরবে?”

‘আচ্ছা।”

‘চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নাও।”

আমরা দুইজন পরস্পরের হাত ধরে লম্বা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। পৃথিবীতে আমার নেওয়া সবচেয়ে ভালোলাগার নিঃশ্বাস এটি। সুমনার হাত ধরে টান দিয়ে মারায়াং তং থেকে নিচের দিকে লাফ দিলাম। সুমনা চোখ খুলতেই ভয়ে আঁতকে উঠলো। সুমনার চোখেমুখে ভয় আর ভয়। মানুষ ভয় পেলেও যে এতো সুন্দর লাগে তা আমার জানার ছিল না। সুমনাকে অপূর্ব লাগছে। আমি  অপলক দৃষ্টিতে ওর ভয়ার্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে আছি, অসাধারণ সেই চেহারা, পূর্ণিমার আলোর চেয়েও উজ্জ্বল।

লেখক

মুহাম্মদ এলমুল বাহার

জন্ম- ১৯ এপ্রিল, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার বরুমচড়া গ্রামে।

পেশা- সিনিয়র অফিসার, সোনালী ব্যাংক পিএলসি।

প্রকাশিত গ্রন্থ- একটি মধ্যবিত্ত রোদ্দুর ( গল্পগ্রন্থ), জলপাই রঙের দুঃখ (গল্পগ্রন্থ)

almulbahar@gmail.com 

Exit mobile version